সবেগে পানি নির্গত হওয়া বলতে কি কেবল পুরুষের পানিই বোঝায় নাকি নারীর পানিও এর অন্তর্ভুক্ত?
সবেগে নির্গত পানি বা বেগবান পানি বলার কারণ কী?
যা নির্গত হয় পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জেরর মধ্যে থেকে – এটা বলতে উদ্দেশ্য কী?
পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু কি পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থেকে বের হয়? আয়াতের তাৎপর্য কী?
উইন্ডো পিরিয়ডে নারীর দেহে কী কী পরিবর্তন ঘটে?
কী কারণে সন্তান দেখতে পিতার মত হয় অথবা মায়ের মত হয়?
বুখারীর হাদিসে আছে, পুরুষের পানি আগে স্খলিত হলে সন্তান বাবার মত হয় এবং স্ত্রীর পানি আগে স্খলিত হলে সন্তান মায়ের মত হয় – এ হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা কী?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
فَلْيَنْظُرِ الإِنْسَانُ مِمَّ خُلِقَ
অর্থঃ অতএব, মানুষ যেন দেখে সে কোন বস্তু থেকে সৃজিত হয়েছে [সূরা তারেক, আয়াত ৫]
তাৎপর্যঃ
فَـ : الْفَاءُ
এখানে تَفْرِيعٌ অথবা اِسْتِئْنَافٌ । মানে, এখান থেকে বাক্য নতুনভাবে শুরু হয়েছে বা বর্ণনার ধারা আগের বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে মোড় নিয়েছে।
لِيَنْظُرْ :
যেন দেখে। এটা নির্দেশবাচক ক্রিয়া। لِـ এর আগে কোনো অক্ষর না থাকলে যের হয়। আর এর শুরুতে কোনো অক্ষর থাকলে সাকিন হয়। আবার ক্রিয়ার শেষেও সাকিন হয়। এখানে দেখে বলতে উদ্দেশ্য হল, গবেষণা করা। কারণ, গবেষণা করার দ্বারা মানুষের মনে নতুন একটি জ্ঞান আবিষ্কার হয়। কিন্তু সাধারণভাবে দেখলে সে জ্ঞান আবিষ্কৃত হয় না। আর মানুষ তার নিজস্ব গবেষণায় যা লাভ করে সেটাকে সে কখনও অস্বীকার করতে পারে না। এখানে জন্ম নিয়ে গবেষণা করার উদ্দেশ্য হল দু’টি। একঃ যেহেতু আগে তার অস্তিত্ব ছিল না, সে একটি নব সৃষ্টি। তাই তার পুনরুজ্জীবন লাভ সম্ভব। দুইঃ একজন মানুষ অহংকারবশত ¯্রষ্টাকে অস্বীকার করে। কিন্তু যখন সে তার সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করবে, তখন তার মনে কোনো অহংকার থাকবে না। কারণ, তার সৃষ্টিই হল নিকৃষ্ট একটি পদার্থ থেকে। আর অহংকার না থাকলে সে এমনিতেই তখন ¯্রষ্টার প্রতি ঈমান আনবে।
الإِنْسَانُ :
মানে মানুষ। এ শব্দটির মূল ধাতু হল الْإِنْسُ অথবা النَّسْيُ। الْإِنْسُ মানে স্বচ্ছ মনের বন্ধু। الْإِنْسُ থেকে গঠিত হলে এর অর্থ হয়, মানুষ একটি সামাজিক জীব। সে অন্যের সাথে কথা বলার মাধ্যমে নিজের একাকীত্ব দূর করে। আর النَّسْيُ মানে ভুলে যাওয়া। النَّسْيُ থেকে গঠিত হলে অর্থ হয়, মানুষ একটি ভুলো প্রাণী। মানুষ ভুলে যায়। এ দু’টি বৈশিষ্ট্যই মানুষের মাঝে বিদ্যমান।
مِمَّ : مِمَّ
মূলত مِمَّا ছিল। এটা গঠিত হয়েছে مِنْ ও مَا সংযোগে। مِنْ অর্থ থেকে, আর مَا অর্থ কী বা কোনো বস্তু। এটা এখানে প্রশ্নবোধক শব্দ। مِنْ এর নূনের পর مَا এর মীম আসার কারণে নূনটি মীমের মধ্যে এদগাম হয়ে গেছে এবং مَا এর শুরুতে مِنْ অব্যয় পদ আসার কারণে مَا এর শেষের أَلِفٌ পড়ে গেছে। অতঃপর مِمَّ হয়েছে। মানে কী থেকে বা কোন বস্তু থেকে। এখানে প্রশ্নবোধক শব্দ ব্যবহার করার কারণ হল, মানুষকে সচেতন করা, সজাগ করা। অলংকার শাস্ত্র মোতাবেক এখানে مَجَازٌ مُرْسَلٌ مُرَكَّبٌ হয়েছে।( )
خُلِقَ :
সে সৃজিত হয়েছে বা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কে সৃষ্টি করেছেন -সেটা এখানে মূল লক্ষ্য নয়। কারণ, সে যখন বুঝবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তখন এটা এমনতিইে বোধগম্য হবে যে, কেউ তাকে সৃষ্টি করেছে। এখানে কোন বস্তু থেকে সে সৃজিত হয়েছে সেটাই হল মূল বিষয়। তাই স্রষ্টার কথা এখানে উল্লেখিত হয়নি। সৃষ্টি বলতে উদ্দেশ্য হল, পূর্বে এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কোনো কিছুকে অস্তিত্বহীন থেকে অস্তিত্বে আনা হল সৃষ্টি। যেহেতু এটা সম্ভব হয়েছে, সুতরাং সৃজিত বিষয়কে পুনরুজ্জীবন সম্ভব, বরং অধিকতর সহজ।
তাৎপর্যগত অর্থঃ মানুষ অহংকারবশত আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং অজ্ঞতাবশত পরকালকে অস্বীকার করে। মানুষের উচিত সে যেন তার সৃষ্টি বিষয় নিয়ে গবেষণা করে। সে যদি গবেষণা করে তাহলে তার নিকট এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, যিনি পানি থেকে মানুষ সৃষ্টি করেন, তাহলে তিনি পনুরায় জীবনদান করতে সক্ষম।
আগের আয়াতের সাথে এ আয়াতের সম্পর্ক হল, সেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক প্রাণের জন্য রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক যিনি পর্যবেক্ষণ করেন সে কী করে। এবং তিনি তা সংরক্ষণ করেন। তাই আল্লাহ বলেন, সে যেন তার প্রাথমিক সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করে। যদি এটা অনুধাবন করতে সক্ষম হয় যে, যে পানিতে বাহ্যিকভাবে জীবনের অস্তিত্ব নেই সেটা দিয়ে যদি একটি জীবন্ত মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হয়, তাহলে পরকালে সে যে পুনরুত্থিত হবে -এটা তার কাছে অনুমেয় হবে।( )
উপরোক্ত আয়াতটি প্রকৃতগতভাবে প্রশ্নবোধক নয়। তাই আল্লাহ এর উত্তর দিয়েছেন এই বলেঃ
خُلِقَ مِنْ مَاءٍ دَافِقٍ
অর্থঃ সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে। [সূরা তারেক, আয়াত ৬]
তাৎপর্যঃ
خُلِقَ :
সে সৃজিত হয়েছে বা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ শব্দটির ব্যাখ্যা এইমাত্র গত হয়েছে।
مَاءٍ :
পানি। এখানে বীর্য উদ্দেশ্য।
دَافِقٍ :
সবেগে নির্গত বা সজোরে স্খলিত। এটা دَفَقَ يَدْفُقُ থেকে اِسْمٌ فَاعِلٌ বা কর্তৃকারক হয়েছে। অর্থাৎ ذُو اِنْدِفَاقٍ বা বেগবান বিশিষ্ট। যেটা আপন বৈশিষ্ট্যে সজোরে স্খলিত হয়। এর বেগে কারো হাত থাকে না। অর্থাৎ- উক্ত পানি যা স্বামী-স্ত্রী রতিক্রিয়া করার সময় আপন শক্তি নিয়ে স্খলিত হয়। ইমামা আল-ফাররা বলেন, হিজাযবাসীরা اِسْمٌ مَفْعُولٌ বা কর্মকারককে اِسْمٌ فَاعِلٌ বা কর্তৃকারক হিসেবে ব্যবহার করত। অর্থাৎ دَافِقٌ এখানেمَدْفُوقٌ অর্থে। মানে যে পানিকে মাতৃজঠরে সবেগে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখানে কর্তৃকারককে কর্মকারক অর্থে নেয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, এ পানির বৈশিষ্ট্যই হল সবেগে স্খলিত হওয়া। এর গতিবেগে মানুষের হাত নেই। এটা নিজস্ব শক্তি নিয়ে আপন গতিতে নির্গত হয়। এখানে অনুবর্তীর অর্থ রয়েছে। অর্থাৎ- পুরুষ রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পানিকে স্খলন করতে চাইল, ফলে এটা তার স্বীয় শক্তিতে সবেগে নির্গত হল। অথবা কর্তৃকারক বলার আরেকটি কারণ হতে পারে যে, শুক্রাণুগুলো সচল, জীবন্ত, দ্রুত ধাবমান।
তাৎপর্যগত অর্থঃ তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে পিতা-মাতার রতিক্রিয়া সম্পাদন করার সময় সবেগে স্খলিত পানি থেকে, যেখানে বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব নেই। আল্লাহ যেহেতু প্রাণহীন পানি থেকে জীবন্ত একটি প্রাণী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন, সুতরাং তিনি পুনরুজ্জীবন দান করতে সক্ষম।
يَخْرُجُ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ
অর্থঃ যা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও বক্ষপঞ্জরের মধ্য থেকে। [সূরা তারেক, আয়াত ৭]
তাৎপর্যঃ
এটা একটি জীববিজ্ঞান বিষয়ক আয়াত যা মানবসৃষ্টি সংক্রান্ত। এ ব্যাপারে তৎকালীন আবরদের কোনো জ্ঞান ছিল না। এমনকি রাসূলুল্লাহ স.ও জানতেন না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাঁকে স. জানিয়েছেন। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তৎকালীন মুফাসসিরগণ তাদের জ্ঞান অনুযায়ী ব্যাখ্য প্রদান করেছেন। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা মূলত কী বোঝানো হয়েছে সে বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞান কী বলে তা জানব। তবে তার আগে পূর্ববর্তী মুফাসসিরগণ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় কী বলেছেন তা সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করছি। এ বিষয়ে অনেক মতামত আছে কিন্তু আমি সব উল্লেখ করছি না। আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কোনটা উদ্দেশ্য সেদিকেই আমি বেশি দৃষ্টিপাত করব।
يَخْرُجُ :
বের হয় বা পানি বের হয়।
الصُّلْبِ :
মেরুদণ্ড বা পৃষ্ঠদেশের হাড়।
التَّرَائِبِ :
হাড়সমূহ বা বুকের পাঁজরের হাড় এর একবচন হল التَّرِيبَةُ। উদ্দেশ্য হল, বুক বা হার পরিধানের স্থান বা বুকের উপরিভাগের ডানপাশের চারটি হাড় এবং বামপাশের চারটি হাড়। التَّرَائِبِ বলে নারীর বুককে উদ্দেশ্য করা হত তৎকালীন যুগে। কিন্তু এ শব্দটি পুরুষের বেলাতেও প্রযোজ্য।
ব্যাখ্যাতাগণ এই الصُّلْبِ ও التَّرَائِبِ শব্দের ব্যাখ্যায় মতভেদ করেছেন। এক মত হল, الصُّلْبُ বা মেরুদণ্ড বলতে উদ্দেশ্য হল, পুরুষের মেরুদণ্ড। আর التَّرَائِبِ বলতে উদ্দেশ্য হল, নারীর বুক। তা হলে অর্থ দাঁড়ায়, যে পানি নির্গত হয় পুরষের মেরুদÐ থেকে এবং নারীর বুক থেকে। অর্থাৎ- যে পানি বা বীর্য [পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু] দ্বারা সন্তান সৃষ্টি হয়, তা পুরুষের পিঠ বা মেরুদণ্ড থেকে নির্গত হয়, এবং নারীর বুক থেকে নির্গত হয়। কিন্তু এ মতটি শুদ্ধ নয়। যদি তাই হত, তাহলে আল্লাহ مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ না বলে مِنَ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ বলতেন। مِنْ بَيْنِ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ মানে পৃষ্ঠ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্য থেকে। আর مِنَ الصُّلْبِ وَالتَّرَائِبِ মানে পৃষ্ঠ বা মেরুদণ্ড ও বুক থেকে।
ইমাম কুরতুবী আল-হাসান থেকে বর্ণনা করেন, ‘পানি যা বের হয় পুরুষের পৃষ্ঠ ও বক্ষপঞ্জর থেকে, এবং নারীর পৃষ্ঠ ও বক্ষপঞ্জর থেকে।’ আল-হাসানের কথার তাৎপর্য যদি হয় একটি দেহ বা পুরুষের দেহ থেকে এবং নারীর দেহ থেকে, তাহলে অর্থ ঠিক আছে। কারণ, بَيْنِ শব্দটি ইঙ্গিত দেয়, এটা বের হয়েছে এমন স্থান থেকে যেটা দুইটি বস্তুর মাঝে। আর একজন মানুষের মূল দেহ হল তার পিঠ ও বুক। এ-দু’টির সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে তার দেহ। অর্থাৎ- পানি বের দেহ থেকে। তাহলে, এখানে প্রশ্ন আসে, আয়াতে مَاءٌ বা পানি একবচন উল্লেখিত হয়েছে। অথচ দ্বিবচন উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। উত্তর হল, পুরুষ ও নারীর পানি মিলে একাকার হওয়ার ফলে তা একপানিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সুতরাং এক পানিতে রূপলাভ করেছে।
এখন প্রশ্ন হল, নারীর পানি বলতে কোন পানি উদ্দেশ্য? যদি বলা হয়, মিলনকালে যে পানি বের হয় তা, তাহলে এটা আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ, রতিক্রিয়ার সময় নারীর যে পানি বের হয় তা হল কামরস; তা প্রাথমিক পর্যায়ে নির্গত হোক অথবা চরমপুলকের সময় নির্গত হোক। এটা তাকে কেবল আনন্দই দেয়। এর সাথে বাচ্চা জন্মদানের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। পরন্তু, সেটা পুরুষের মত সবেগে নির্গত হয় না।
উত্তরকালে, আধুনিক বিজ্ঞানের শারীরবিজ্ঞানের সার্বিক আবিষ্কারের ফলে আমরা জানি যে, সন্তান সৃষ্টি হয় পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু থেকে। পুরুষের শুক্রাণু যেটা অণ্ডকোষের মাধ্যমে তৈরি হয়ে বীর্যথলিতে অবস্থান করে। শুক্রাণুর পরিমাণ থাকে মাত্র ৩ শতাংশ, আর বীর্যবৎ পানি থাকে ৯৭ শতাংশ। অতঃপর তা রতিক্রিয়ার সময় বীর্যের সাথে নির্গত হয়। এই বীর্যথলিটি অবস্থান করে পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে বা একটি দেহে। তাহলে, সবেগে পানি স্খলিত হওয়ার বিষয়টি হল, যা সবেগে নির্গত হয় বীর্যথলি থেকে, যে বীর্যথলিটি অবস্থান করে একটি দেহে তথা পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে। পক্ষান্তরে, নারীর ডিম্বাণু তৈরি হয় ডিম্বাশয়ে ডিম্বোস্ফটনের মাধ্যমে। পুরুষের পানি সবেগে নির্গত হওয়া অনুধাবনীয়। কিন্তু নারীর ডিম্বাণুর বিষয়টি পুরুষের পানির মত নয়। তাহলে, কোনআনে কি কেবল পুরুষের কথাই বলেছে নাকি নারীর বিষয়টিও এর অন্তর্ভুক্ত, অথচ মানবসৃষ্টিতে উভয়েরই ভূমিকা রয়েছে?
চলুন, দেখি আধুনিক বিজ্ঞান কী বলে। পুরুষের বিষয়টি পরিষ্কার ও বোধগম্য। চলুন, দেখা যাক নারীর ডিম্বাণুর বিষয়। আমি একটি গ্রাফিয়ান ফলিকলের ডায়াগ্রাম বা নকশা উপস্থাপন করছি এবং অতঃপর তার ব্যাখ্যা প্রদান করছি। নকশাটি লক্ষ করুনঃ
নারীর ডিম্বাশয়ে অনেক প্রাথমিক ফলিকল বা বীজকোষ তথা সন্তান সৃষ্টিকারী পানি থাকে। পিটুইটারী থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়ে একটি প্রাথমিক বীজকোষ বা ফলিকলকে পরিপক্ক করে। একটি পরিপক্ক বীজকোষকে graafian follicle বলে। এই গ্রাফিয়ান ফলিকল ডিম্বাণুকে নিজের মধ্যে সযত্নে ধারণ করে। এটি একটি মাত্র ডিম্বাণু ধারণ করে। একটি ফলিকলকে আল্লাহ তায়ালা ডিম্বাশয়ে অতি যত্নে গড়ে তুলেন। এটা অকেগুলো স্তর বা layer দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। আবার তেমনি ডিম্বাণু বা ovum -ও কয়েকটি স্তর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে।
যেসব স্তর দ্বারা গ্রাফিয়ান ফলিকল পরিবেষ্টিতঃ থিকা এক্সটার্না (বাহ্যিক আবরণ), থিকা ইন্টার্না (এটা ইস্ট্রজেন বা স্ত্রী-হরমোন নির্গত করে), বেইজমেন্ট মেমব্রেন, গ্রানিউলোসা সেল (এটা পুরু আবরণ যা তরল নির্গত করে এবং এটাকে লিকুউয়র ফলিকুলি বলে যা গুহাকে পরিপূর্ণ রাখে) আর গুহাকে এন্ট্রাম বলে যা তরল দ্বারা পূর্ণ থাকে। এটা ডিম্বাণুকে রক্ষা করে। এই তরল পদার্থের পরে আরেকটি সেল আছে, তাকে বলে, কিউমিউলাস অপরাস সেলস cumulus ophorus cells)। এসব মিলে গঠিত হয় একটি পরিপক্ক বীজকোষ বা গ্রাফিয়ান ফলিকল বলে।
আর নারীর ডিম্বাণু যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রাফিয়ান ফলিকলে অবস্থান করে তাকে সেকেণ্ডারী উসাইট বলে। এই সেকেণ্ডারী উসাইট হল ডিম্বাণু যা নিষিক্ত হওয়ার জন্য পরিপক্ক।
এই লিকুউয়র ফলিকুলি বা তরল মিউকোপ্রোটিন (mucoprotein) এবং হায়েলিউরনিক এসিড hyaluronic acid) ধারণ করে। এটা বা এন্ট্রাম ডিম্বাণুকে যান্ত্রিক হেঁচকা বা আকস্মিক গতি mechanical jerk) থেকে সুরক্ষা রাখে এবং দ্বিতীয়ত এটাকে গ্রাফিয়ান ফলিকলের স্তরের দিকে চাপ দিয়ে রাখে। কারণ, যখন এই ডিম্বাণু স্তর ভেদ নির্গত হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবে যাবে তখন এটা সহজেই নির্গত হতে পারবে। আর ঋতুচক্রের তেরতম অথবা চৌদ্দতম দিনে নির্গত হয়। পিটুইটারী থেকে তৈরি লুটেইনাইযিং হরমোন Luteinizing Hormone) সংক্ষেপে LH বলে। এটা ডিম্বস্ফোটনের আগে উদ্ভূত হয় এবং ডিম্বাণুকে নির্গত করে বা গ্রাফিয়ান ফলিকলের স্তরগুলোকে বিদীর্ণ করে। ফলে, ডিম্বাণু বের হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবে গমন করে শুক্রাণু কর্তৃক নিষিক্ত হওয়ার জন্য। আর ডিম্বাণু যে ডিম্বাশয় থেকে কয়েকটি স্তর ভেদ করে নির্গত হয়, তা ঘটে সবেগে এবং সজোরে। এখানে নারীর কোনো কর্তৃত্ব থাকে না। আল্লাহ এটাকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সবেগে নির্গত হওয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন যেমন দিয়েছে পুরুষের বীর্য নির্গত হওয়ার ক্ষেত্রে। পুরুষের বীর্যথলিতে সবেগে বীর্য নির্গত হওয়া এটা পুরুষ চাইলে অধিক গতিবেগে নির্গত করবে অথবা চাইলে কম গতিবেগে নির্গত করবে -এ ক্ষমতা তার হাতে নেই। এটা আপন গতিবেগে নির্গত হয়। কিন্তু মূত্র নির্গত করার ক্ষেত্রে পুরুষ চাইলে অধিক গতিবেগে অথবা নিম্ন গতিবেগে ত্যাগ করতে সক্ষম। তেমনি, নারীও তার ডিম্বাণুকে ডিম্বাশয় থেকে ইচ্ছেমতো দ্রুতগতিতে অথবা নিম্নগতিতে নির্গত করবে Ñএমন ক্ষমতা তার হাতে নেই। এটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আপন গতিবেগে ফ্যালোপিয়ান টিউবে নির্গত হয়।
আর ডিম্বাণুর স্তরগুলো হল, কোরোনা রেডিয়েটা corona radiate cells), যোনা পেলিউসিডা (zona pelucida), পেরিভিটেলাইন স্পেইস (perivitelline space), পেরিভিটেলাইন ঝিল্লি অথবা প্লাজমা ঝিল্লি বা রক্তরস ঝিল্লি (perivitelline membrane or plasma membrane)। সেকেণ্ডারী উসাইট বা ডিম্বাণুর মধ্যভাগকে সাইটোপ্লাজম (cytoplasm) বলে। এটা দুইভাগে বিভক্ত। দেয়ালঘেষা অংশ কিছুটা ঘণ থাকে, তাকে এগ কোরটেক্স (egg cortex) অথবা এক্টোপ্লাজম (ectoplasm) বা জীবকোষের বহিরাবরণ বলে। আর মধ্যভাগে যে সাইটোপ্লাজম থাকে, তাকে ওপ্লাজম অথবা ভিটেলাস (ooplasm or vitellus) বা কুসুম বলে। এ দু’টো মিলে গঠিত হয় সাইটোপ্লাজম। এই ওপ্লাজম নিউক্লিয়াস ধারণ করে যাকে জার্মিনাল ভেসিকল (germinal vesicle) বলে। আর নিইক্লিওলাসের (nucleolus) মধ্যে আছে জার্মিনাল স্পট (germinal)।
বলা বাহুল্য যে, পুরুষের শুক্রাণু নারীর ফ্যালোপিয়ান টিউবে ২৪ ঘণ্টা থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে। আর নারীর ডিম্বাণু ডিম্বস্ফোটনের পর ১২ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্যালোপিয়ান টিউবে অপেক্ষা করে শুক্রাণু কর্তৃক নিষিক্ত হওয়ার জন্য।( )
আর এখানেই হাদিসের সত্যতা বেরিয়ে আসে। তা হল, রাসূলুল্লাহ স. যখন মদীনায় গেলেন, আব্দুল্লাহ বিন সালাম তাঁকে স. কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। তন্মধ্যে একটি ছিল, কোন বস্তু সন্তানকে পিতার দিকে টানে, আর কোন বস্তু সন্তানতে মামার দিকে টানে? রাসূলুল্লাহ স. এর উত্তরে বললেন, একজন পুরুষ যখন তার স্ত্রীর সাথে রতিক্রিয়া করে তখন যদি তার পানি প্রাধান্য পায় তাহলে সন্তান তার রূপলাভ করে বা তার সাদৃশ্য হয়। আর যদি স্ত্রীর পানি প্রাধান্য পায় তাহলে স্ত্রীর রূপলাভ করে বা তার সাদৃশ্য হয়।( )
স্মর্তব্য যে, এ প্রশ্নটি উম্মে সুলাইমও রাসূলুল্লাহ স. করে করেছিলেন যেটা সহিহ মুসলিম বর্ণনা করেছে। হাদিসে বাবা অথবা মায়ের মতো বলতে উদ্দেশ্য হল, তাদের পরিবারের কারো মতো। সাদৃশ্য বলতে চারটি রূপ হয়। একঃ ছেলে হোক অথবা মেয়ে হোক, চেহারার সাদৃশ্য বাবার মতো বা বাবার পরিবারের অন্য কারো মতো। দুইঃ অথবা মায়ের মতো বা মায়ের পারিবারের কারো মতো। তিনঃ সন্তান ছেলে হয়ে পুংলিঙ্গ হওয়ার দ্বারা লিঙ্গের ক্ষেত্রে বাবার সাদৃশ্য লাভ করে। চারঃ সন্তান মেয়ে হয়ে স্ত্রীলিঙ্গ হওয়ার দ্বারা লিঙ্গের ক্ষেত্রে মায়ের সাদৃশ্য লাভ করে।
রাসূলুল্লাহ স. যে উত্তর দিয়েছেন তা হল প্রথম দুই প্রকারের সাথে সম্পৃক্ত। অর্থাৎ- সন্তানের চেহারার মিল। যেমন, আমরা কোনো বাচ্চাকে দেখে বলি, ছেলে হোক অথবা মেয়ে হোক, বাবার মতো হয়েছে দেখতে, অথবা মায়ের মতো হয়েছে দেখতে। হাদিসের এ বাণীর সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার মিলে যাচ্ছে। তা হল, যদি নারীর ডিম্বস্ফোটন আগে ঘটে এবং ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবে এসে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে, অতঃপর যদি রতিক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং কোনো শুক্রাণু উক্ত ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে তাহলে এক্ষেত্রে সন্তানের চেহারা হবে মায়ের মতো অথবা মায়ের পরিবারের কারো মতো। কারণ, নারীর ডিম্বাণু আগে নির্গত হয়েছে। পক্ষান্তরে, রতিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর যদি শুক্রাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবে আগে অবস্থান করে এবং অতঃপর নারীর ডিম্বস্ফোটনের মাধ্যমে ডিম্বাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবে এসে শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় তাহলে সন্তানের চেহারা হবে পিতার মতো বা পিতার পরিবারের কারো মতো। কারণ, পিতার শুক্রাণু ফ্যালোপিয়ান টিউবে আগে অবস্থান করেছে বা ডিম্বাণুর উপর প্রাধান্য পেয়েছে।
কিন্তু তিন ও চার নং প্রকারটির হাদিসের ব্যাখ্যা সামঞ্জস্যশীল নয়। কারণ, পুরুষের এক্স ক্রোমোজম অথবা ওয়াই ক্রোমোজম যার ফলে সন্তান ছেলে অথবা মেয়ে হয়, তার সাথে পানি আগে নির্গত হওয়া অথবা পরে নির্গত হওয়ার সাথে কোনো সম্পর্ক নাই। কারণ, বিষয়টি এমন নয় যে, ডিম্বস্ফোটনের আগে যদি পুরুষের পানি নির্গত হয় তাহলে ফ্যালোপিয়ান টিউবে ওয়াই ক্রোমোজম অবস্থান করবে যারফলে সন্তান ছেলে হবে, আর পরে হলে এক্স ক্রোমোজম অবস্থান করবে যারফলে সন্তান মেয়ে হবে।
তাহলে আল্লাহ তায়ালা পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থেকে যা বের হয় না বলে যা বের হয় বীর্যথলি থেকে এবং যা বের হয় ডিম্বাশয় থেকে বলতে পারতেন। তিনি তা না বলে বলেছেন যা নির্গত হয় পৃষ্ঠ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থেকে বা একটি দেহ থেকে, এমন বলেছেন কেন? এখানে বিষয়টিকে ভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তা হল, রতিক্রিয়ার সময় যখন বীর্য নির্গত হয়, তখন পুরুষ বলতে পারে না এটা মূলত কোথা থেকে নির্গত হয়। এর আনন্দ সারাদেহ জুড়ে বিস্তৃত হয়। আর এজন্যই রতিক্রিয়া সম্পন্ন করার পর সারাদেহ ধৌত করাকে ফরজ করা হয়েছে।
পক্ষান্তরে, নারীর ডিম্বস্ফোটন হওয়ার পর তার দেহেও কিছু পরিবর্তন ঘটে। যেমনঃ
একঃ দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কিছুটা কমে যায়।
দুইঃ তার কণ্ঠ একটু ভারী শোনায়।
তিনঃ তার দেহ থেকে একপ্রকার ঘ্রাণ নিঃসৃত হয়।
চারঃ সে সুগন্ধিত পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে।
পাঁচঃ যোনিপথ ঈষৎ স্বচ্ছ ও সাদাটে হয়।
ছয়ঃ নারী তার পেটে কিছুটা খিঁচুনী অনুভব করে।
সাতঃ যৌনমিলনে আগ্রহ বোধ করে।
আটঃ ঋতু ব্যতীতও এমনি রক্ত পড়তে পারে।
নয়ঃ গর্ভাশয়ে কিছুটা ফোলাফোলা ভাব অনুভব করে।
নারীর ডিম্বস্ফোটন বিষয়টিও তার সারাদেহে প্রভাব বিস্তার করে। তাই উক্ত পানি মনে হয় যেন সারাদেহ থেকেই নির্গত হয়।
এখন আরেকটি প্রশ্ন হল, এ বিষয়টি নিয়ে আল্লাহ মানুষকে গবেষণা করতে বলেছেন কেন? আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। গবেষণা করার দুইটি কারণ দুইটি। একঃ একজন মানুষের সৃষ্টি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এসেছে। সুতরাং, তার পুনরুজ্জীবিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। দ্বিতীয়তঃ সাধারণভাবে দেখা যায় শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংমিশ্রণে সন্তানের জন্ম। সহজেই বলা যায়, বাবা-মার রতিক্রিয়ায় সন্তানের জন্ম। কিন্তু এখানে বিষয়টি আরো গভীরভাবে প্রোথিত। বাবা-মা’র দৈহিক মিলনে সন্তানের জন্ম বিষয়টি সহজবোধ্য ও স্পষ্ট। কিন্তু কথা হল, যে পানি নির্গত হয় পুরুষের দেহ থেকে এবং নারীর দেহ থেকে, সেই নির্গমন প্রক্রিয়ায় পুরুষেরও হাত নেইÑনারীরও হাত নেই। যদি নির্গমন বন্ধ হয়ে যায় তারা কেউ-ই তা নির্গত করতে সক্ষম হবে না। কিন্তু আল্লাহ এটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নির্গত হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং, সন্তান জন্মদানে বাবা-মা’র ভূমিকাও এক্ষেত্রে ক্ষীণ হয়ে দেখা দেয়। এখানে বাবা-মা’র ইন্দ্রিয় সম্ভোগটাই লাভ। এখানে পর্যবেক্ষণযোগ্য বিষয় হল, যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পানি দ্বারা সন্তান জন্মদানের ব্যবস্থা করেছেন, সেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতেই তাকে পরকালে পুনরায় জীবনদান করা হবে।
এখানে আরেকটি প্রশ্ন দেখা দেয়, পানি বা শুক্রাণু ও ডিম্বাণু পুরুষ ও নারীর -উভয়েরই। তাহলে পূর্বের আয়াতে مَاءٌ বা পানি শব্দটি একবচন উল্লেখ করা হল কেন? এর উত্তর হল, আয়াতে مَاءٌ বা পানি শব্দটি نَكِرَةٌ বা অনির্দিষ্ট। এর অধীন একাধিক অন্তর্ভুক্ত।
এ ব্যাখ্যাটি হল যদি يَخْرُجُ ক্রিয়ার فَاعِلٌ বা কর্তৃকারক مَاءٌ دَافِقٌ বা বেগবান পানি হয়। কিন্তু ড. মুহাম্মাদ আল-বার এখানে ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা প্রদানের প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি يَخْرُجُ ক্রিয়ার فَاعِلٌ বা কর্তৃকারক مَاءٌ دَافِقٌ বা বেগবান পানিকে গ্রহণ করেননি। তিনি উক্ত ক্রিয়ার কর্তৃকারক সাব্যস্ত করেছেন ইনসান বা মানুষকে। কারণ, পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন, إِنَّهُ عَلَى رَجْعِهِ لَقَادِرٌ -অর্থাৎ- নিশ্চয় তিনি তাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম। এখানে رَجْعِهِ এর هِ সর্বনামটির আরোপ হল ইনসান বা মানুষ। সুতরাং يَخْرُجُ ক্রিয়ার فَاعِلٌ বা কর্তৃকারক হল মানুষ। এখানে বেগবান পানি কর্তৃকারক হবে না। তখন এর তাৎপর্য হবে, মানুষ হল দুই প্রজাতি। পুরুষ ও নারী। অর্থাৎ- মানুষ যেন দৃষ্টি দেয় বা গবেষণা করে তাকে কোন বস্তু থেকে কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরুষ ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাকে পুরুষ অথবা নারী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে জনন-সম্বন্ধনীয় পানি থেকে (genital water)। পুরুষের বীর্য তৈরি হয় অণ্ডকোষে, এবং নারীর ডিম্বাণু তৈরি হয় ডিম্বাশয়ে। এই অণ্ডকোষ এবং ডিম্বাশয় জননেন্দ্রিয় চক্র থেকে তৈরি হয় যা ভ্রুণের পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মাঝে বা বক্ষপঞ্জরের নিচের হাড়ের নিচে এবং কিডনির উপরে অবস্থান করে। অতঃপর ভ্রুণের বয়সের সপ্তম মাসের শেষের দিকে অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয় সেখান থেকে আস্তে আস্তে নিচের দিকে অবতরণ করে। পরে, পুরুষের অণ্ডকোষ শরীরের বহিরাংশে স্থাপিত হয় এবং নারীর ডিম্বাশয় পেটের ভিতরেই নিম্নাংশে অবস্থান করে। এতদসত্ত্বেও, এই অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয় রক্ত, ¯স্নায়ুতন্তু ও লিম্ফ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়, যেগুলোর মূল নিহিত থাকে পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে। অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের ধমনী মহাধমনী (Aorta) থেকে বয়ে আসে যেটা পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থাকে। অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের শিরা যেমন পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থাকে, তেমনি এ-দু’টির পুষ্টিকর ¯স্নায়ু (nourishing nerves) আসে সমষ্টি ¯স্নায়ু থেকে যা যকৃতের নিচে পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মাঝে অবস্থান করে। তেমনিভাবে, lymphatic vesselsও উক্ত স্থানে অবস্থান করে। সুতরাং এর পর আর সন্দেহ থাকল না যে, অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয় তাদের খাদ্য, রক্ত ও ¯স্নায়ু সংগ্রহ করে পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থেকে। অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয় যেমন পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থেকে নিচে নেমে এসেছে, ঠিক তেমনি পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু তৈরির উপাদানও উক্ত পৃষ্ঠদেশ ও বক্ষপঞ্জরের মধ্যে থেকে আসে।
আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, রতিক্রিয়ার সময় পুরুষের পানি সবেগে নির্গত হলেও, নারীর যে কামরস নির্গত হয় তা সবেগে নির্গত হয় না। তা বেয়ে পড়ে, এবং এর সাথে সন্তান জন্মদানের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এটা কেবল যোনিপথকে পিচ্ছিল করে। যেটা সবেগে নির্গত সেটা হল, পুরুষের শুক্রাণু বহনকারী বীর্য এবং নারীর ডিম্বাণু যেটা গ্রাফিয়ান ফলিকলে অবস্থান করে এবং পরিপক্ত হওয়ার পর তার স্তরগুলো বিদীর্ণ করে সবেগে নির্গত হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবে এসে শুক্রাণু কর্তৃক নিষিক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। আর দু’টি পানি তথা শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংযোজনে মিশ্রিত একক পানিতে রূপান্তরিত হয়ে ভ্রুণকোষে (zygote) রূপান্তরিত হয়।( )
সবেগে নির্গত পানির দু’টি ব্যাখ্যার সারকথা একই। তবে পরের আয়াতের কর্তৃকারকের ভিত্তিতে ব্যাখ্যায় পার্থক্য রয়েছে। তবে দু’টি ব্যাখ্যাতে ভিন্ন ধরনের তথ্য রয়েছে যা কোরআনের সর্বজনিনতার বার্তা বহন করে। যাইহোক, যাকে তিনি এত যত্ন করে সৃষ্টি করেছেন তাকে যদি পুনরুজ্জীবিত না করতে সক্ষম হন তাহলে তো তাঁর ¯স্রষ্টাত্বের ক্ষমতায় দুর্বলতা দেখা দেয়।
আল-কোরআন আল-কারীমের তাফসির বিশ্বকোষ