তাকবিরাতুল ইহরাম বা তাকবিরে তাহরিমা তথা নামায শুরু করার সময় তাকবির বলে হাত উঠানো, রুকুতে যাওয়া ও রুকু থেকে উঠার সময় হাত উঠানো প্রসঙ্গে প্রমাণাদিঃ
প্রথম হাদিসঃ
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ حَذْوَ مَنْكِبَيْهِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلاةَ ، وَإِذَا كَبَّرَ لِلرُّكُوعِ ، وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنْ الرُّكُوعِ رَفَعَهُمَا كَذَلِكَ .
-ইবনে উমর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায শুরু করতেন কাঁধ বরাবর বা কাঁধের মোকাবেলা পর্যন্ত হাত উঠতেন, যখন রুকুর জন্য তাকবির দিতেন এবং যখন রুকু থেকে মাথা উঠাতেন তেমনিভাবে তিনি দুই হাত উঠাতেন। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৭৩৫, ও সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩৯০]
দ্বিতীয় হাদিসঃ
عن وائل بن حجر قال : رأيت النبي صلى الله عليه و سلم حين افتتح الصلاة رفع يديه حذو أذنيه.
- ওয়ায়েল বিন হুজর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায শুরু করার সময় কান বরাবর বা তার মোকাবেলা পর্যন্ত হাত উঠাতেন। [মু‘জামুল কাবীর, তাবরানী, ২২/২৯, হাদিস নং ১৭৯৪৭]
তৃতীয় হাদিসঃ
عَنْ مَالِكِ بْنِ الْحُوَيْرِثِ، أَنّ النَّبِيَّ – صلى الله عليه وسلم – كَانَ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلاةَ رَفَعَ يَدَيْهِ حَذْوَ أُذُنَيْهِ…
- মালেক বিন আলÑহুয়াইরিছ থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায শুরু করতেন, তার দুই হাত তার দুই কান বরাবর বা মোকাবেলা পর্যন্ত উঠাতেন। [মুসতাখরাজ আবি আওয়ানাহ, ২/১৭৪, হাদিস নং ১২৬২]
চতুর্থ হাদিসঃ
عن البراء بن عازب رضي الله عنه قال : كان رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا افتتح الصلاة رفع يديه حتى تكونا حذو أذنيه.
-আল-বারা বিন আযেব রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায শুরু করতেন তিনি তার দুইহাত দুই কানের মোকাবেলা হওয়া পর্যন্ত উঠাতেন। [সুনান বাইহাকী, হাদিস নং ২১৪২]
উপরোক্ত হাদিসগুলো দুই হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠানো অথবা কান পর্যন্ত উঠানো উভয়টিই প্রমাণ করে। অর্থাৎÑ হাত কাঁধ অথবা কান পর্যন্ত উঠানো উভয়টিই সঠিক।
শাফেয়ী ও জুমহুরগণ কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠানোর হাদিস অনুযায়ী আমল করেন। আর হানাফী মাযহাব কান পর্যন্ত হাত উঠানোর হাদিস অনুযায়ী আমল করেন।
এখানে দুইটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমঃ হাত বলতে বৃদ্ধাঙ্গুলীর অবস্থান থাকবে কাঁধ অথবা কান বরাবর। বৃদ্ধাঙ্গুলীকে কাঁধ অথবা কানের লতির সাথে লাগানো যাবে না। বরং বিপরীত ভাবে বা বৃদ্ধাঙ্গুল এবং কাঁধ অথবা কানের মাঝে একটু ফাঁক রাখতে হবে। অনেকে বৃদ্ধাঙ্গুল কানের লতির সাথে লাগিয়ে দেন, এটা সঠিক নিয়ম নয়।
আর দ্বিতীয় বিষয় হলঃ তাকবির বলার সময় হাতের তালু ও আঙ্গুলগুলোকে পশ্চিম দিকে রাখতে হবে। অনেকে তাকবির বলার সময় হাতের তালু ও আঙ্গুলগুলোকে গালের দিকে ফিরিয়ে রাখেন। এটা সঠিক নিয়ম নয়।
আবার দুই প্রকার হাদিস দিয়ে আমল করতে চাইলে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কাঁধ বরাবর বা বিপরীতে থাকবে এবং মধ্যমা আঙ্গুলের অগ্রভাগ কানের লতির বিপরীতে থাকবে।
রুকুতে যাওয়া এবং রুকু থেকে উঠার সময় রফউল ইয়াদাইন করা বা হাত উঠানো
হানাফী মাযহাব ব্যতীত অন্য সকল মাযহাব রুকুতে যাওয়া এবং রুকু থেকে উঠার সময় রফউল ইয়াদাইন করার কথা বলেন। আর ইমাম শাফেয়ী আরেকটি বেশি করে তাশাহহুদ থেকে উঠার পর হাত উঠানোর কথা বলেন। রুকুতে যাওয়া এবং রুকু থেকে উঠার সময় রফউল ইয়াদাইন করার প্রমাণ হল প্রথম হাদিস যেটা বোখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। জুমহুরদের মতে এই তিন জায়গায় এবং শাফেয়ীর মতে তাশাহহুদের পর মোট চার জায়গায় হাত উঠানো সুন্নত বা মুসতাহাব।
তবে হানাফী মাযহাবের মতে কেবল তাকবিরাতুল ইহরাম বা নামায শুরু করার সময় তাকবির বলার সময় হাত উঠানো সুন্নত। এছাড়া রুকুতে যাওয়া এবং রুকু থেকে উঠার সময় রফউল ইয়াদাইন করা বা হাত উঠানোকে সুন্নত বলেন না।
সারাখসী তার কিতাবে বলেন, নামায শুরু করার সময় ব্যতীত অন্যান্য সময় তাকবির বলার সময় রফউল ইয়াদাইন বা হাত উঠবে না। [আল-মাবসূত, সারাখসী, ১/২৩]
বাদায়েউস সানায়ে‘তে আছে, ফরজ নামাযে তাকবিরের সময় রফউল ইয়াদাইন বা হাত উঠানো নেই, তবে কেবল শুরু করার সময়। [বাদায়েউস সানায়ে‘ ১/২০৭]। অর্থাৎ- তাকবিরাতুল ইহরাম বা নামায শুরু করার সময় হাত উঠাবে। অন্য সময় আর হাত উঠাবে না।
এর দলিল হল, আবু হানীফা হাম্মাদ থেকে, তিনি ইবরাহীম থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদ্বিঃ থেকে বর্ণনা করেন,
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم: كان يرفع يديه عند تكبيرة الإحرام ثم لا يعود
- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকবিরাতুল ইহরাম বা নামায শুরু করার সময় হাত উঠাতেন। অতঃপর, আর হাত উঠাতেন না। [আলÑমাবসূত, সারাখসী, ১/২৪]
হানাফী মাযহাব মতে, যেসব হাদিসগুলো তাকবিরাতুল ইহরাম ব্যতীত অন্য সময় বা রুকুতে যাওয়া এবং রুকু থেকে উঠার সময় রফউল ইয়াদাইন করা বা হাত উঠানোর কথা বলা হয়েছে তা রহিত হয়ে গিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুরুর দিকে হাত উঠাতেন, পরে তিনি হাত উঠানো ছেড়ে দিয়েছেন।
যেমন ইবনে মাসউদ রাদ্বিঃ থেকে বর্ণিত আছে,
عن ابن مَسْعُودٍ رضي اللَّهُ عنه أَنَّهُ قال : ( رَفَعَ رسول اللَّهِ فَرَفَعْنَا ، وَتَرَكَ فَتَرَكْنَا )”
- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত উঠাতেন, আমরাও উঠাতাম। পরে তিনি পরিত্যাগ করেছেন, আমরাও পরিত্যাগ করেছি। [বাদায়েউস সানায়ে‘ ১/২০৮]
বাদায়েউস সানায়ে‘তে আরো আছে, আসেম বিন কুলাইব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমি আলি রাদ্বিঃ এর পেছনে দুই বছর নামায পড়েছি। তিনি শুধু নামায শুরু করার সময় হাত উঠাতেন।’ মুজাহিদ বলেন, ‘আমি আব্দুল্লাহ বিন উমরের পেছনে দুই বছর নামায পড়েছি। তিনি নামায শুরু করার সময় হাত উঠাতেন। এছাড়া আর হাত উঠাতেন না।’ [বাদায়েউস সানায়ে‘ ১/২০৮]
আরেকটি দলিল যেটা আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন,
عَنْ الْبَرَاءِ بن عازب أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلَاةَ رَفَعَ يَدَيْهِ إِلَى قَرِيبٍ مِنْ أُذُنَيْهِ ثُمَّ لَا يَعُودُ.
- আল-বারা বিন আযেব থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায শুরু করতেন তখন তাঁর দুই হাত দুই কানের নিকটবর্তী উঠাতেন, অতঃপর আর প্রত্যাবর্তন করতেন না বা হাত উঠাতেন না। [আবু দাউদ, হাদিস নং ৭৪৯]
আরেকটি হাদিস হল,
عن عبد الله بن مسعود رضي الله عنه قال : أَلا أُصَلِّي بِكُمْ صَلاةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَصَلَّى فَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ إِلا مَرَّةً.
- ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামায আদায় করব না? অতঃপর, তিনি নামায আদায় করলেন তবে একবারের বেশি হাত উঠালেন না। [আবু দাউদ, হাদিস নং ৭৪৮, তিরমিযী, হাদিস নং ২৫৭, মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং ৩৬৮১।
তবে এই হাদিসগুলোকে হাদিসের ইমামগণ যয়ীফ বলেছেন। আলÑবারা’র হাদিসকে সুফিয়ান বিন উয়াইনা, শাফেয়ী, হুমাইদী, আহমদ বিন হাম্বল, ইয়াহইয়া বিন মাইন, দারেমী ও বুখারীসহ অন্যান্যগণ যয়ীফ বলেছেন। এখানে ‘ অতঃপর আর প্রত্যাবর্তন করতেন না বা হাত উঠাতেন না’ অংশটুকু হাদিসের অংশ নয়। এটা ইয়াযিদ বিন আবি যিয়াদ থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। [তালখিসুল হাবীর, ইবনে হাজার, ১/২২১]
আর ইবনে মাসউদ রাদ্বি-এর দ্বিতীয় হাদিসটিকে ইমাম তিরমিযী হাসান বলেছেন, ইবনে হাযম সহিহ বলেছেন, আলবানী সহিহ বলেছেন, আর আবু দাউদ বর্ণনা করার পর বলেছেন, এটা লম্বা হাদিসের অংশ। তবে এই শব্দে সঠিক নয়। আর এ হাদিসটিকে ইবনুল মুবারক, আহমদ বিন হাম্বল, বুখারী, বাইহাকী ও দারাকুতনী যয়ীফ বলেছেন। এছাড়াও আরো কারণ আছে যা হাদিসটি সহিহ হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে তিরমিযী যে হাসান বলেছেন তার গ্রহণযোগ্যতা নেই। তিনি এ বিষয়ে সহজতা করেছেন। আর ইবনে হাযম সনদের দিক থেকে সহিহ বলেছেন। তেমনি আলবানীও সনদের দিক থেকে সহিহ বলেছেন। [তালখিসুল হাবীর, ইবনে হাজার, ১/২২২, তোহফাতুল আহওয়াযী, ২/৯৩]।
বাদায়েউস সানায়ে‘ যে ইবনে মাসউদের প্রথম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তার উদ্ধৃতি দেয়া নেই। তবে আমি অনুসন্ধান করে তা পাইনি। আর তারপর তিনি যে দুইটি আছর উল্লেখ করেছেন সেগুলোকে কেউ সহিহ বলেছেন। তবে আবার অন্য কেউ তা সহিহ হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, সনদের ব্যাপারে কালাম রয়েছে।
সারকথা হল, এসব প্রমাণের উপর নির্ভর করে তাকবিরে তাহরিমা ব্যতীত অন্য সময়ে রফউল ইয়াদাইন বা হাত উঠানোর হাদিসকে রহিত হয়েছে বলে হুকুম দেয়া সঠিক হবে না। তবে আলী, ইবনে মাউসদ ও ইবনে উমরসহ অন্যান্য সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম থেকে রফউল ইয়াদাইন না করা বা হাত না উঠানোর যেসব বর্ণনা রয়েছে -যদিও সনদ ও মতন সঠিক হওয়ার ব্যাপারে কালাম রয়েছে- তা প্রমাণ করে, তারা এটাকে সুন্নাহ মুয়াক্কাদা মনে করতেন না। অর্থাৎÑ হাত না উঠালেও নামায সঠিক হবে, এজন্য নামাযের কোনো ক্ষতি হবে না। আর একটি সুন্নত বা মুস্তাহাব বিষয় রহিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ, তা পালন করলে উত্তম। আর পালন না করলে ক্ষতি নেই।
শরহু মা‘আনীল আছারে আরো বর্ণনা আছে যেগুলো প্রমাণ করে যে, অনেকে নামায শুরু করার সময় ব্যতীত অন্য সময় রফউল ইয়াদাইন বা হাত উঠাতেন না। এসব বর্ণনার ভিত্তিতে হানাফী মাযহাবে বিষয়টি গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়টি ফুটে উঠে। তা হল, হানাফী মাযহাবের উসূল হল, একটি বিষয় গুরুত্ব পাওয়ার জন্য বিষয়টি উমুমুল বালওয়া বা ব্যাপক ভাবে সংঘটিত হতে হবে বা কাজটি সবাই করে। তবে হাত উঠানোর বিষয়টি তৎকালীন সময়ে কেউ করতেন আবার কেউ করতেন না। যেহেতু সবাই করতেন না তাই বিষয়টি হানাফী মাযহাবে ততটা গুরুত্বের সাথে দেখা হয়নি।
তবে হানাফী মাযহাবের কেউ যদি মনে করেন, রুকুতে যাওয়া এবং উঠার সময় হাত উঠানোর হাদিসটি যেহেতু সহিহ তাহলে তিনি উক্ত হাদিস অনুযায়ী আমল করতে পারবেন কিনা বা পালন করার দ্বারা হানাফী মাযহাব থেকে বের হয়ে যাবেন কিনা?
এর উত্তর হল, কেউ যদি সহিহ হাদিস অনুযায়ী আমল করার জন্য রুকুতে যাওয়া এবং উঠার সময় হাত উঠান তাহলে সমস্যা নেই। এটা সুন্নত হবে এবং সেজন্য তিনি মাযহাব থেকে বের হয়ে যাবেন না। কারণ, কিছু কিছু মাসআলার ক্ষেত্রে সহিহ হাদিসকে কেন্দ্র করে আমল করায় সমস্যা নেই। হানাফী মাযহাবের বড় বড় আলেম দেখবেন কিছু কিছু মাসআলার ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের গবেষণা থাকার কারণে মাযহাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন। এতদসত্তে¡ও, তারা হানাফী। তবে কোন মাযহাবে কোনটা সহজ তা দেখে আমল করা নিষেধ। কারণ, এটা হল মাযহাবে জোড়াতালি দেয়া যা জায়েয নেই।