সূরা নাবা’

আয়াত ১ থেকে ৫নং আয়াত পর্যন্ত কাফরদের প্রশ্ন এবং তাদেরকে ধিক্কারমূলক উত্তরঃ

عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ (1) عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ (2) الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ (3) كَلا سَيَعْلَمُونَ (4) ثُمَّ كَلا سَيَعْلَمُونَ (5)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ

অর্থঃ তারা কী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? [আয়াত ১]

তাৎপর্যঃ

عَمَّ : কী সম্পর্কে? এর মূল হল عَمَّا, এটা  عَن(সম্পর্কে) ও  مَا(কী) সংযুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে। عَنْÑএর নূনকে মিম দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে এবং মিমকে মিমের মধ্যে এদগাম করা হয়েছে, অতঃপর عَمَّا হয়েছে। আর মিমের পরে আলিফকে বিলুপ্ত করা হয়েছে তার আগে অব্যয় পদ আসা এবং অধিক ব্যবহারের কারণে। যেমনلِمَ، فِيمَ، عَمَّ، مِمَّ । অথবা প্রশ্নবোধক শব্দ   مَا (মা) এর আগে অব্যয় পদ  عَنْ (আন) আসার কারণে আলিফ বিলুপ্ত হয়েছে প্রশ্ন ও সংবাদ প্রদানের মাঝে পার্থক্য করার জন্য। আরেক বর্ণনায় আছে, ইমাম যাহ্হাক ও ইবনে কাসির عَمَّهْ (هَاءُ السَّكْتِ) পড়েছেন। বলা হয় আলিফের পরিবর্তে هَاء (হা) যুক্ত হয়েছে। আর এটা সম্পর্ক যুক্ত হল পরবর্তী ক্রিয়ার সাথে। এখানে اِسْمُ اسْتِفْهَامٍ বা প্রশ্নবোধক শব্দকে আগে উল্লেখ করা হয়েছে। আর اِسْمُ اسْتِفْهَامٍ যখন অব্যয়পদ দ্বারা সংযুক্ত হয়, তখনে সেটা বাক্যের শুরুতে আসে।

يَتَسَاءَلُونَ : তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে। অর্থাৎ- তারা সর্বনাম বলতে উদ্দেশ্য হল, মক্কার কাফেররা, বা মক্কার কাফেররা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে। অর্থাৎ- তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করত যখন তারা পরকালের ব্যাপারে মু’মিনদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে।  কারণ,  তারা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে। অতঃপর তারা এ বিষয়টিকে অস্বীকার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অথবা মক্কার কুরাইশরা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করত বটে, তবে তাদের মাঝে কেউ কেউ পরকালকে সত্য বলে জ্ঞান করত, আবার কেউ এটাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করত। আবার يَسْأَلُونَ-ও পড়া যায়। তখন অর্থ দাঁড়ায়, তারা রাসূলুল্লাহ স. কে অথবা সাহাবাদেরকে প্রহসনমূলক জিজ্ঞাসা করে। বিষয়টিকে প্রকাণ্ড ও ভীতিপ্রদ করে দেখানোর জন্য এ সূরাটি প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। তদুপরি, এভাবে প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে শুরু করার দ্বারা পাঠকের মনে একপ্রকার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তারা দুইভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমঃ একদল যারা পরকালকে সত্য বলে জ্ঞান করত। কিন্তু তারপরও তারা জিজ্ঞাসা করত অধিক পরিমাণে জানার জন্য। কারণ, একেক জনের জানার আগ্রহ আরেকজন থেকে ভিন্ন হয়।

দ্বিতীয় প্রকার হল, যারা পরকালকে অস্বীকার করত। তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও প্রহসনমূলক জিজ্ঞাসা করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবতাকে জানা নয়, বরং এটা নিয়ে উপহাস করা। উপরোক্ত আয়াত দ্বারা যতধিক না প্রশ্ন করা উদ্দেশ্য, ততধিক আগ্রহ সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য। এ প্রশ্ন দ্বারা অনির্দিষ্টভাবে সকলকে খেতাব করা হয়েছে।(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৮-৯।)

তাদের জিজ্ঞাসা করার বিষয় কয়েকটি হতে পারে। যেমন, মুজাহিদ বলেন, তারা কোরআন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত। ইবনে যায়েদ বলেন, তারা কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত। কাতাদা বলেন, তারা পরকাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত। আরেক মত হল, তারা রাসূলুল্লাহ স. সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮২।) বলা বাহুল্য যে, এগুলোর সবটিই হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। কারণ, একেক জনের মনে একেক ধরনের প্রশ্ন ছিল।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

মক্কার কোরাইশ গোত্রের লোকেরা একে অপরকে কী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে?

উপরোক্ত প্রশ্ন করা যেহেতু কোনো কিছুর সমঝকে তলব করা হয় নি, তাই এর উত্তর উল্লেখ করাই উত্তম।(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৯।) আর তার উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ

শব্দার্থ: عَنِ  = সম্পর্কে।النَّبَإِ  = প্রকাণ্ড সংবাদ। الْعَظِيمِ = বড়, বিশাল।

অর্থঃ প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। [আয়াত ২]

তাৎপর্যঃ

عَن : সম্পর্কে। 

النَّبَأ : বড়  প্রকাণ্ড  বা বিশালকায়  কোনো বিষয়।  এ আয়াতের  শুরুতে يَتَسَآءَلُونَ ক্রিয়া  উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ- يَتَسَاءَلُونَ عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ। মানে তারা প্রকাণ্ড বিষয় বা সংবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। অথবা প্রশ্নবোধক করেও পড়া যায়। যেমন, أَيَتَسَاءَلُونَ عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ  অথবা أَعَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ। অর্থাৎ-  তারা কি প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? এখানে প্রশ্নবোধক أَ বা ‘কি’ কে উল্লেখ করা হয়নি, কারণ, পূর্বোক্ত আয়াত দ্বারা তা বোধগম্য।

النَّبَأُ বা প্রকাণ্ড সংবাদ কী, এ ব্যাপারে আল্লাহ স্পষ্ট করেননি। এ ব্যাপারে চারটি মত রয়েছে। মুজাহিদ বলেন, আল-কোরআন। তার দলিল, قُلْ هُوَ نَبَأٌ عَظِيمٌ [সূরা স’দ, আয়াত-৬৭]। কাতাদা বলেন, পুনরুত্থান বা পরকাল। ইবনে যায়েদ বলেন, কিয়ামত দিবস। আরেক মত হল, রাসূলুল্লাহ স.। তবে সূরার বর্ণনাশৈলী দেখে পুনরুত্থান বা পরকাল বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। আবার চারটিই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, একেকজনের মনে একেক ধরনের প্রশ্ন উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

প্রথম আয়াতে প্রশ্ন এবং এ আয়াতে উত্তর দেয়ার কারণ হল, প্রশ্ন ও উত্তর দেয়ার স্থানে একটি বাক্যকে প্রশ্ন ও উত্তরসহ উল্লেখ করা বিষয়টিকে আরো বোধগম্য ও সুস্পষ্ট করে।(তাফসীর রাযী, ৩১/৪। )

الْعَظِيمِ : বড়, প্রকাণ্ড, বিশাল। النَّبَأ মানে প্রকাণ্ড সংবাদ বা বিষয় হলেও এর বিশেষণ প্রকাণ্ড উল্লেখ করা হয়েছে এটাকে আরো গুরুত্ববহ করার জন্য।

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

এখানে দ্বিতীয় আয়াত عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ থেকে يَتَسَاءَلُونَ ক্রিয়াটি বিলুপ্ত করা হয়েছে আয়াতকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য। তাই, এখানে إِيجَازٌ বা সংক্ষিপ্তকরণ হয়েছে। অর্থাৎ এ বাক্যের শুরুতে يَتَسَاءَلُونَ ক্রিয়া উল্লেখ করা হয় নি। কারণ, প্রথম আয়াতের يَتَسَاءَلُونَ ক্রিয়াটি এর অর্থ প্রকাশ করছে।(তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা একে অপরকে অথবা আপনাকে কী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? তারা প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে।

الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ

শব্দার্থ: الَّذِي = যে। هُمْ = তারা। فِيهِ = তার মধ্যে বা যে বিষয়ে। مُخْتَلِفُونَ = তারা মতভেদ করে, মতভেদকারী।

অর্থঃ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করে। [আয়াত ৩]

তাৎপর্যঃ

الَّذِي : যে, যা বা যে বিষয়ে। উদ্দেশ্য হল প্রকাণ্ড সংবাদ।

هُمْ : তারা বলতে উদ্দেশ্য হল উক্ত প্রশ্নকারীরা। তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করত। তন্মধ্যে কেউ বলত, এটা পূর্ববর্তীতের উপাখ্যান। কেউ বলত, এটা পাগলের প্রলাপ। কেউ বলত, এটা যাদু। কেউ বলত, এটা মিথ্যা। আবার কেউ কিয়ামত ও পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত। আবার কেউ হিসাব-নিকাশকে অস্বীকার করত।

فِيهِ : সে বিষয়ে বা উক্ত প্রকাণ্ড বিষয়ে। অব্যয়পদ ও সর্বনাম যুক্ত فِيهِ শব্দকে مُخْتَلِفُونَ এর আগে আনা হয়েছে উক্ত প্রকাণ্ড সংবাদকে গুরুত্ববহ করার জন্য। এবং এটা বোঝানোর জন্য যে, তাদের মতভেদ এসব বিষয় নিয়েই; অন্য কোনো বিষয় নিয়ে নয়।

مُخْتَلِفُونَ : মতভেদকারী, তারা মতভেদ করে -উভয় অর্থই গ্রহণ করা যায়। صِلَةٌ এর مَوْصُولٌ  কে فِعْلٌ مُضَارِعٌ  উল্লেখ না করে  اِسْمٌ فَاعِلٌ বা কর্তৃবাচ্য উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ يَخْتَلِفُونَ না বলে বলা مُخْتَلِفُونَ বলা হয়েছে। اِسْمٌ فَاعِلٌ বা কর্তৃবাচ্য উল্লেখ করার ফলে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে শুরুতে থেকে যেসব প্রশ্ন ও সন্দেহ পোষণ করছে সে ধরনের প্রশ্ন সবসময়ই থাকবে এবং এটা তাদের কর্তৃক বলবৎ থাকবে বা এ ধরনের প্রশ্ন ও সন্দেহ সর্বদা করতে থাকবে।

মতভেদকারীরা হল দুই প্রকারঃ মু’মিন ও মুশরিক। মু’মিনগণ পরকালে বিশ্বাস করত এবং তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেত। আর মুশরিকরা পরকালকে বিশ্বাস করত না। তারা পরকালের জীবনকে অসম্ভব মনে করত। তাই তারা বলত, যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা বলে, আমাদের জীবন তো হল কেবল পার্থিব জীবন। আমরা মৃত্যুবরণ করি, জীবনলাভ করি। আর আমাদেরকে ধ্বংস করবে সময়। [সূরা জাছিয়া, আয়াত-২৪] এর ফলে তার অস্বীকার করার প্রবণতাই আরো বৃদ্ধি পায়।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে মতভেদ করে। তন্মধ্যে কেউ পরকালকে স্বীকার করে। আবার কেউ অস্বীকার করে। ফলে, তারা নানা অবান্তর প্রশ্নের অবতারণা করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ধারণাকে খণ্ডন করে বলেন,

كَلا سَيَعْلَمُونَ

শব্দার্থ: كَلاَّ = কক্ষনো না। سَيَعْلَمُونَ = তারা শীঘ্রই জানবে।

অর্থঃ কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানবে। [আয়াত ৪]

তাৎপর্যঃ

كَلاَّ: মানে হল পূর্ববর্তী কথার সত্যতাকে নাকোচ করা এবং তা রহিত করা। আর এ ধরনের প্রশ্ন থেকে বিরত থাকা এবং উক্ত প্রশ্নের জন্য হুমকি প্রদর্শন করা। অর্থাৎ- মুশরিকরা যে পরকালের জীবন-

কে অস্বীকার বা অসম্ভব মনে করেছিল, তাদের এ ধারণাকে রহিত করা উদ্দেশ্য।

سَيَعْلَمُونَ : বর্তমান ক্রিয়াকে নিকটবর্তী ভবিষ্যৎ বোঝানোর জন্য ক্রিয়ার আগে سَـ আসে। অর্থাৎ- তারা অচিরেই জানবে। জানা কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। শোনার মাধ্যমে জানা, দেখার মাধ্যমে জানা বা চাক্ষুষ অনুধাবন করা, আর ছোঁয়ার মাধ্যমে পরীক্ষিতভাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত সত্যজ্ঞান লাভ করা। প্রথম পর্যায়কে অস্বীকার করার সম্ভাবনা থাকলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকারের পর্যায় দু’টি অস্বীকার করার অবকাশ থাকে না। উদ্দেশ্য হল, এখন তারা ওহীর কথা অস্বীকার করছে; কিন্তু এর সত্যতা তারা অতিশীঘ্রই জানতে পারবে। দ্বিতীয় প্রকার জানা বলতে উদ্দেশ্য হল, কিয়ামত দিবস যা তারা পুনরুত্থানের পর চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করবে। আর তৃতীয় প্রকার জানা বলতে উদ্দেশ্য হল, কাফেররা জাহান্নামে প্রবেশ করে শাস্তির সত্যতা অনুধাবন করবে। পক্ষান্তরে, মু’মিনরা জান্নাতে প্রবেশ করে আরাম-আয়েশের সত্যতা পর্যবেক্ষণ করবে। আর পরকালের সম্বন্ধে সত্যজ্ঞান লাভ হয় মৃত্যুর পরপরই।

গুরুত্ব প্রদানের জন্য আবারো বলেনঃ

ثُمَّ كَلا سَيَعْلَمُونَ

শব্দার্থ: ثُمَّ = অতঃপর। كَلاَّ = কক্ষনো না। سَيَعْلَمُونَ = তারা শীঘ্রই জানবে।

অর্থঃ অতঃপর কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানবে। [আয়াত ৫]

তাৎপর্যঃ

এখানে একই আয়াত দুইবার বলা হয়েছে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য। আর দ্বিতীয় আয়াতে ‘অতঃপর’ শব্দটি ইঙ্গিত দেয় যে, দ্বিতীয়টি প্রথমটির চেয়ে বেশি ভয়ংকর। অথবা প্রথমটি বলতে যুদ্ধের সময়। যেমন বদর যুদ্ধে কাফেরদের মৃত্যু। আর দ্বিতীয়টি কিয়ামত দিবস। অথবা, প্রথমটি বলতে উদ্দেশ্য হল, পুনরুত্থানের সময়। আর দ্বিতীয়টি বলতে উদ্দেশ্য হল প্রতিদানের সময়।(তাফসীর বায়যাভী, পৃষ্ঠা ৪/৫০৮।) অথবা বলা হয়, প্রথমটির উদ্দেশ্য হল, কাফেররা জাহান্নামে যে শাস্তি ভোগ করবে তা তারা জানবে। আর দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য হল, মু’মিনরা জান্নাতে যে আরাম-আয়েশে থাকবে তা তারা জানবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা মতভেদ করছে। তাদেরকে মতভেদ করতে দিন। এ বিষয়ে তারা শীঘ্রই সত্যজ্ঞান লাভ করবে। তখন এটাকে আর মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করতে পারবে না।

১ থেকে ৫ পর্যন্ত আয়াতের সাধারণ মর্মার্থঃ

রাসূলুল্লাহ স. কে যখন নবুওয়ত প্রদান করা হল, তিনি লোকদেরকে দাওয়াত দিলেন, পরকালে জীবনলাভের কথা বললেন। মু’মিনগণ এটাকে বিশ্বাস করলেন। আর কাফেররা এটাকে অবিশ্বাস করল এবং ঠাট্টা-বিদ্রæপাত্মক ও প্রহসনমূলক তারা একে অপরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। অথবা রাসূলুল্লাহ স. অথবা সাহাবাদেরকে জিজ্ঞাসা করত। মুশরিকরা কোন  বিষয়  সম্পর্কে  জিজ্ঞাসা করে? তারা কোন বিষয়ে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে? তারা তো প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, যে সংবাদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ স. কে প্রেরণ করা হয়েছে, যে বিষয়ে কোরআন বলেছে যে, পরকাল সত্য, কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, কোরআন সত্য, রাসূলুল্লাহ সত্য। কিন্তু তারা অবিশ্বাসমূলক প্রহসন করার কারণে আল্লাহ তাদেরকে শাসিয়ে বলেন যে, ‘তারা শীঘ্রই জানবে’। তারা যা ধারণা করছে বা পরকালকে অস্বীকার করছে, এ বিষয়ে তারা শীঘ্রই জানবে -এটা সত্য নাকি মিথ্যা। কারণ, মানুষের জীবন অত্যল্পই। মৃত্যুর পরই পরকালের জীবনরহস্য উন্মোচিত হবে।

এখানে কয়েকটি প্রশ্ন আসে। প্রথমতঃ আল্লাহ তাদের প্রশ্নকে স্পষ্ট করেননি। বরং বলেছেন, ‘প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে’। কারণ, মুশরিকদের প্রশ্ন ছিল বৈশিষ্ট্য নিয়ে, নাম নিয়ে নয়। আর একটি নাম, জাত বা বিষয়ের পরিচিতি ঘটে বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। তাই তিনি বৈশিষ্ট্যই উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ- তারা যে বিষয়কে অস্বীকার করছে, অসম্ভব বলে আখ্যা দিচ্ছে বা হাসি-তামাশা করছে, এটা ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়। এটা বিশালকায় প্রকাণ্ড একটি বিষয়। অথবা নাবা’ বলতে যদি সম্ভাব্য চারটি বিষয়ই ধরা হয় বা একেকজনের মনে একেক ধরনের সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছিল তাহলে সে অর্থে হলে এর উদ্দেশ্য হবে, তারা যেসব বিষয়ে সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহমূলকভাবে প্রহসন করছিল, তার সত্যতা তারা শীঘ্রই জানতে পারবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, আল্লাহ তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং তাদেরকে ধিক্কার দিয়েছেন এই বলে, ‘কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানবে’। এর কারণ হল, মুশরিককরা পরকালকে অসম্ভব মনে করত ফলে প্রহসনমূলক প্রশ্ন করেছে। তারা উত্তর জানতে চায়নি। তাই আল্লাহ তাদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান না করে বরং হুমকি ও ধিক্কারমূলক কথা বলেছেন আর বিষয়টিকে আরো আশ্চর্যজনক ও প্রকাণ্ড করে উপস্থাপন করেছেন এই বলে, ‘কক্ষনো না, শীঘ্রই তারা জানবে’। আর এমন ধিক্কারমূলক কথা সরাসরি উত্তর প্রদানের চেয়ে মনে বেশি দাগ কাটে। যেমন ধরুন, কোনো রাজা কোনো একটি বিষয়ে নির্দেশ দিলেন, তখন প্রজারা সে বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপাত্মক কথা বলল, তখন রাজা তাদেরকে উত্তর দেবেন নাকি শাস্তি দেবেন, অথবা ধিক্কারমূলক উত্তর জানাবেন? অবশ্যই শাস্তি দেবেন। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু শাস্তিকে পরকালের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং এ জগতে তাদের মুক্ত বিচরণের অবকাশ দিয়েছেন, তাই শাস্তি প্রদান না করতঃ তাদেরকে এর সত্যতার ব্যাপারে ধিক্কারমূলক উত্তর দিয়েছেন যে, তারা মৃত্যুর পর এর সত্যতা আপন নেত্রে পর্যবেক্ষণ করবে।

পরকাল সম্পর্কে তাদের অস্বীকারকরণকে আল্লাহ তায়ালা অস্বীকার করেছেন, তাই প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে সূরা শুরু করেছেন। এ কয়েকটি আয়াত হল এ সূরার ভূমিকা।

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ পরকাল যেহেতু অদৃশ্য, তাই এ নিয়ে আগেও যেমন প্রশ্ন ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

দুইঃ সবকিছুরই প্রকাশিত হওয়ার যেমন নির্দিষ্ট একটি সময় রয়েছে, তেমনি পরকালেরও নির্দিষ্ট একটি সময় রয়েছে। এটা তার আপন সময়মতো প্রকাশিত হবে।

আল-কোরআন আল-কারীম-এর তাফসীর বিশ্বকোষ থেকে

Share this:

Leave a Comment