সূরা নাবা’
لا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْداً وَلا شَرَاباً (24)
শব্দার্থঃ لاَ يَذُوقُونَ = তারা স্বাদ আস্বাদন করবে না। فِيهَا = তাতে, সেখানে। بَرْدًا = ঠাণ্ডা, শীতল। لاَ = না, মানে আস্বাদন করবে না। شَرَابًا = পানীয়।
অর্থঃ তারা সেখানে শীতলতা ও পানীয় আস্বাদন করবে না। [আয়াত ২৪]
তাতপর্যঃ
لاَ يَذُوقُونَ فِيهَا : তারা সেখানে আস্বাদন করবে না -এটা ইঙ্গিত দেয়, সেখানে তারা ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবে না। তারা সেখানে আস্বাদন করবে মাত্র। এ অবস্থা যেমন জাহান্নামীদের, তেমনি জান্নাতীদেরও।
بَرْدًا وَلاَ شَرَابًا : بَرْدًا মানে ঠাণ্ডা বা শীতলতা বলতে ঠাণ্ডা পানি, শীতল বায়ু। আবার কাতাদা বলেন, প্রশান্তি। মুজাহিদ, সুদ্দি ও আবু উবায়দা বলেন, ঘুম। بَرْدٌ শব্দটি আরবেব এক গোত্রের নিকট ঘুম শব্দেও ব্যবহৃত হয়। আর شَرَابًا মানে পানীয় যা দ্বারা পিপাসা নিবারণ করা হয়।
( তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৭।)
অর্থাত- তারা সেখানে জাহান্নামের দাহ্য ও তীব্র গরম থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য আত্মা শীতলকারী কোনো ঠাণ্ডা পানির স্বাদ আস্বাদন করবে না অথবা মন জুড়ানো শীতল বায়ু উপভোগ করতে পারবে না। এমনকি পিপসা নিবারণের জন্য সাধারণ কোনো পানীয়ও পাবে না। আর ঘুম অর্থ নিলে এর তাতপর্য দাঁড়ায়ঃ তারা শাস্তির প্রকোপ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য ঘুম যাচনা করবে, কিন্তু তারা ঘুমাতে পারবে না। বলা বাহুল্য যে, আমরা যখন ঘুমাই তখন আমরা দেহের নানা রোগের ব্যথা-বেদনা অনুভব করি না। ব্যথাও যেন ঘুমিয়ে পড়ে! তেমনি, ক্ষুতপিপাসাও অনুভব করি না। অর্থাত- ঘুম মানুষকে শীতল করে দেয়। বলা হয়, ঘুম হল একপ্রকার মৃত্যু। আবার প্রশান্তি অর্থে নিলে এর অর্থ হয়, ঠাণ্ডা এসে তাদের মনে প্রশান্তি এনে দেবে না এবং জাহান্নামের গরমের তীব্রতাও দূর করবে না। যেমন আরবরা বলেন, আল্লাহ তোমার জীবনকে শীতল করুন বা আরামদায়ক করুন। কারণ, তীব্র গরমে শীতলতা স্পর্শের অনুভূতিই ভিন্ন রকম।( রূহুল বয়ান, ইসমাইল হাক্কী, ১০/২৩৪।)
তাতপর্যগত অর্থঃ
জাহান্নামীরা সেখানে আগুনের তীব্রতা থেকে উপশম লাভের জন্য ঠাণ্ডা ও পানীয় কামনা করবে। কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হবে না। বরং তাদেরকে যা দেয়া হবে তা হল, যেমন আল্লাহ বলেনঃ
إِلَّا حَمِيماً وَغَسَّاقاً (25)
শব্দার্থঃ إِلاَّ = কিন্তু। حَمِيمًا = তীব্র গরম। غَسَّاقًا = পূঁজ, বিগলিত চর্বি, অতিশয় ঠাণ্ডা।
অর্থঃ কিন্তু তীব্র গরম ও পুঁজ। [আয়াত ২৫] [অর্থাৎ- তারা সেখানে তীব্র গরম এবং পূঁজ আস্বাদন করবে।]
তাতপর্যঃ
حَمِيمًا : এ শব্দের তিনটি অর্থ আছে। প্রথমঃ ইবনে আব্বাস বলেন, অতিশয় গরম যেটা জ্বালিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ঃ ইবনে যায়েদ বলেন, জাহান্নামীদের চোখের অশ্রæ যা কোনো এক হাউজে জমা হবে, অতঃপর তাদেরকে পান করানোর জন্য দেয়া হবে। তৃতীয়তঃ সুদ্দি বলেন, জাহান্নামীদের জন্য এক প্রকার পানীয়।( তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৭। )
غَسَّاقًا : এ শব্দের ক্ষেত্রে কয়েকটি মত রয়েছে। প্রথমঃ ইবনে উমর বলেন, গাঢ় পুঁজ। দ্বিতীয়ঃ ইবনে আব্বাস বলেন, অতিশয় ঠাণ্ডা যা দেহের অঙ্গকে পৃথক করে ফেলবে। তৃতীয়ঃ কাতাদা বলেন, জাহান্নামবাসীদের পুঁজ। চতুর্থঃ ইবনে যায়েদ বলেন, তহাভিয়াদের ভাষায় এটা পূতিগন্ধময় বস্তু। আরেক অর্থ হল, বিগলিত চর্বি যা আগুনে জ্বলসে যাওয়ার ফলে জাহান্নামীদের দেহ থেকে যা নির্গত হবে।( তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৭।)
এখানে দু’টি শব্দের যে বিভিন্ন অর্থ বলা হয়েছে, এগুলোর তাতপর্য হল গলাধঃকরণ ও ত্বক দ্বারা অনুধাবনের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং শব্দগুলোর তাতপর্য উপলব্ধি করার জন্য আমাদেরকে يَذُوقُونَ শব্দের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে। এ শব্দটির মূল ধাতু হল ذَوْقٌ, অর্থ হল, স্বাদ গ্রহন করা বা স্বাদ আস্বাদন করা। এটা সাধারণত হয় জিহ্বা দ্বারা, আর পূর্ণতা পায় গলাধঃকরণের মাধ্যমে। তখন অর্থ দাঁড়াবে, তারা সেখানে ঠাণ্ডা পানি ও পানীয়-এর স্বাদ আস্বাদন করবে না কিন্তু অতিশয় গরম পানি ও পুঁজ ছাড়া। অর্থাত- যখনই তারা ঠাণ্ডা পানি ও পানীয় যাচনা করবে, তাদেরকে অতিশয় গরম পানি ও পুঁজ-বিগলিত চর্বি পরিবেশন করা হবে। তখন ঠাণ্ডার পরিবর্তে গরম পানি ও পানীয়-এর পরিবের্ত পুঁজ পরিবেশন করা হবে। আবার যদি ত্বক দ্বারা অনুভব করা বা উপলব্ধি করা বোঝায় -প্রকারান্তরে, এটাও এক প্রকার স্বাদ আস্বাদন করা হয় তবে তা ত্বকের দ্বারা অনুধাবন করার মাধ্যমে- তখন অর্থ দাঁড়াবে, তারা সেখানে ঠাণ্ডা ও পানীয় আস্বাদন করবে না কিন্তু অতিশয় গরম এবং অতিমাত্রায় হিম। অর্থাত- তারা শীতল বায়ু কামনা করলে গরমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে যা তাদেরকে আরো জ্বলসে দেবে, অথবা তীব্র ঠাণ্ডা দেয়া হবে যা দেহের অঙ্গকে জমাট বেঁধে ঠাণ্ডায় হিম করে ফেলবে। অর্থাত- অতিশয় গরমের কারণেও দেহ জ্বলসে যাবে এবং অতিশয় ঠাণ্ডার কারণেও দেহ হিম হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে, জাহান্নাম আগুন ও বরফ উভয় প্রকারই আছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ
২৪ নং আয়াতের بَرْدًا এবং ২৫ নং আয়াতের حَمِيمًا -এর মাঝে طِبَاقٌ বা বিপরীত বর্ণনায় সমানুপাত হয়েছে।
( তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/১৫।)
তাতপর্যগত অর্থঃ
তারা সেখানে যতবারই ঠাণ্ডা ও পানীয় যাচনা করবে, তা না দিয়ে, পরিবর্তে তাদেরকে উষ্ণ ও পূঁজ দেয়া হবে