সূরা নাবা‌’

Print Friendly, PDF & Email

আল্লাহ ১২-১৬ আয়াতে আসমানের বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ

وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا (12) وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا (13) وَأَنزلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجًا (14) لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا (15) وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا (16)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا

শব্দার্থঃ وَبَنَيْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। فَوْقَكُمْ = তোমাদের উপরে। سَبْعًا = সাত। شِدَادًا = দৃঢ়, মজবুত।

অর্থঃ আর আমরা বানিয়েছি তোমাদের উপর সাতটি সুদৃঢ় স্থাপনা [আকাশ]। [আয়াত ১২]

তাৎপর্যঃ

وَبَنَيْنَا : আর আমরা বানিয়েছি -অন্য সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ جَعَلْنَا বলেছেন, আর এখানে بَنَيْنَا বলেছেন। এর কারণ হল, এ শব্দ ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি উক্ত ভিত্তিকে সুউচ্চে স্থাপন করেছেন। بِنَاءٌ মানে উঁচু ভবন।

فَوْقَكُمْ : তোমাদের মাথার উপর -যা আমাদের সাথে লাগোয়া নয়; বরং উর্ধ্বপানে সন্নিবেশিত। এখানে অবস্থানকে কর্মকারকের আগে উল্লেখ করা হয়েছে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য।

سَبْعًا شِدَادًا : সুদৃঢ় সাতটি ভিত্তি -এখানে সুদৃঢ় সাত বলতে মূলত আল্লাহ কী বুঝিয়েছেন সেটা আল্লাহই ভাল জানে। এটা হতে পারে, সাতটি আকাশকে পৃথিবীর ছাদ স্বরূপ বানিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْنَا السَّمَآءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا, অর্থাৎ- ‘আর আমরা আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ বানিয়েছি।’ [সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৩২] । আবার সূরা মু’মিনুনের ১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে সাতটি রাস্তা। এগুলো উচ্চতা, প্রশস্ততা, দৃঢ়তা ও শক্ত হওয়ার দিক দিয়ে অতিমাত্রায় মজবুত। কালের আবর্তনে এখানে কোনো ফাটল-ভাঙন ধরবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। বলা বাহুল্য যে, আরবরা ঘরের ছাদকে ‘সামা’ বা আকাশ বলত। তাই তাদেরকে তাদের ভাষাতেই খেতাব করে বলছেন যে, পৃথিবীর ছাদ তথা সপ্ত আকাশ অতিশয় দৃঢ়, এর কোনো স্তম্ভ নেই -এগুলো তোমাদের বাড়ির ছাদের মতো ভেঙ্গে পড়বে না; কিন্তু এটা মজবুত হওয়া সত্তে¡ও কিয়ামতের দিন লয় হবে। সপ্ত আকাশ সৃষ্টির মূল রহস্য আল্লাহই ভাল জানেন। আর প্রথম আকাশকে সাজিয়েছেন তারকারাজি দ্বারা। এখানে রয়েছে ছায়াপথ। একটি ছায়াপথে মিলিয়ন মিলিয়ন তারকা রয়েছে। এ সকল ছায়াপথ ও সপ্ত রাস্তা আমাদের পৃথিবী ও সৌরজগতের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। আবার হতে পারে আমাদের এই সৌরজগতের গ্রহসমূহ। অথবা, হতে পারে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন স্তর। তবে অন্যান্য আয়াতে যেহেতু সাত আকাশের কথা এসেছে, সুতরাং সাত আকাশই গ্রহণ করা শ্রেয়।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫২,  ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৫ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৬-পিডিএফ), আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/২৩। )

আর সাতটি আকাশের অস্তিত্ব সম্পর্কে মে‘রাজের বর্ণনায় এসেছে, যেমন এ সূরার ১৯ নং আয়াতে উক্ত হাদিসের বর্ণনা এসেছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা তোমাদের উপরে নির্মাণ করেছি সাতটি সুদৃঢ় স্থাপনা, যা বিশ্বচরাচরের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং পৃথিবীর অস্তিত্ব বহাল রাখে।

وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। سِرَاجًا = বাতি, আলোকবর্তিকা। وَهَّاجًا = দাহক, প্রজ্বালক।

অর্থঃ আর আমরা প্রজ্বালক আলোকবর্তিকা বানিয়েছি। [আয়াত ১৩]

তাৎপর্যঃ

وَجَعَلْنَا : এর তাৎপর্য পূর্বে গত হয়েছে।

سِرَاجًا وَهَّاجًا : سِرَاجًا মানে আলোকবর্তিকা, আলোধারা -যেখানে আলোর তীব্রতা রয়েছে, তাপ রয়েছে। আর وَهَّاجًا মানে অতিমাত্রায় আলো ও তাপ রয়েছে। এটা আধিক্য অর্থে বিশেষণ হয়েছে। এখানে এ শব্দ দ্বারা সূর্য উদ্দেশ্য। সুতরাং سِرَاجًا وَهَّاجًا হল সূর্যের একটি সূ² বর্ণনা। সূর্যকে উক্ত শব্দদ্বয় দিয়ে সংজ্ঞায়িত করাটি ইঙ্গিত দেয় যে, সূর্যের নিজস্ব আলো রয়েছে।

এই আলোময় সূর্য পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীকে আলো সরবরাহ করার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এর দ্বারা প্রাণীকুল উপকৃত হয়। আলো না থাকলে মানুষ তার প্রাত্যহিক কাজ কর্ম করতে নানা জটিলতার সম্মুখীন হত। এই সূর্যের তাপের ফলে সাগর, নদীনালা, পুকুরের পানি থেকে বাষ্প তৈরি হয়ে মেঘমালা সৃষ্টি হয়, যে মেঘমালা থেকে পানি বরিষণ ঘটে, আবার মেঘমালায় বজ্র্রপাত হয়, ফলে  উক্ত পানিতে নাইট্রিক এসিড উৎপন্ন হয়। আর এ নাইট্রিক এসিড চাষাবাদের জন্য উপকারী এবং অত্যাবশ্যকীয়ও বটে। ফলে নানা ফসল, ফলফলাদি, লতাপাতা, গুল্ম ও গাছগাছালি গজে উঠে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা বানিয়েছি প্রজ্বালক আলোকবর্তিকা যেটা তোমাদের নানা উপকারে আসে।

وَأَنزلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجًا

শব্দার্থঃ وَ = ও, এবং, আর। أَنْزَلْنَا = আমরা অবতরণ করিয়েছি। مِنَ = থেকে। الْمُعْصِرَاتِ = মেঘ। مَاءً = পানি। ثَجَّاجًا = মুষলধারে।

অর্থঃ আর আমরা মেঘমালা থেকে মুষলধারে পানি বা বৃষ্টি অবতরণ করিয়েছি। [আয়াত ১৪]

তাৎপর্যঃ

وَأَنْزَلْنَا : وَ সংযুক্তি বর্ণ। أَنْزَلْنَا মানে আমরা অবতরণ করিয়েছি। এ শব্দটি ইঙ্গিত দেয়, একটি মেঘে যতটুকু পানি সঞ্চিত হয়, যখন বৃষ্টি হয় তখন সবটুকুই নিঃশেষ হয়ে যায়। এমন নয় যে, কিছু পড়ল আর কিছু পানি মেঘে অবশিষ্ট থাকল, একটু পর আবার পড়ল। তবে আমরা যে দেখি, থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, এটা হল, যতটুকু পানি তৈরি হয় তা নিঃশেষ হয়ে যায়। আবার তাতে পানি তৈরি হয়, আবার তা বরিষণের মাধ্যমে নেমে আসে।

الْمُعْصِرَاتِ : শব্দটির মূল অর্থ হল, নিষ্পেষণকারিনী, চেপনকারিনী, আবার আরেক অর্থ, চেপন বিশিষ্ট বা নিষ্পেষণ বিশিষ্ট হল বা নিষ্পেষণ ও চিপার উপযুক্ত হল। কারণ بَابُ إِفْعَالٍ  থেকে এ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এটি একটি বিশেষণের বিশেষ্য। অথবা একটি  উহ্য বিশেষ্যের বিশেষণ। এ ধরণের শব্দের সাথে পৃথক একটি বিশেষ্য যুক্ত হতেও পারে আবার না হতেও পারে। এখানে যুক্ত হলে শব্দটি হবে السَّحَائِبُ أَوْ السُّحُبُ الْمُعْصِرَاتُ মানে নিষ্পেষণকারিনী মেঘমালা। একটি মেঘমালা যখন বারি বর্ষণের নিকটবর্তী হয় তখন তাকে الْمُعْصِرَاتُ বলে। কারণ চিপে চিপে বা নিষ্পেষণ করে জমাট বাঁধা পানিকে ফোঁটায় ফোঁটায় নির্গত করে। এটাকে চিপা বা নিষ্পেষণের কাজ করে বাতাস। সুতরাং বাতাস অর্থেও আসতে পারে। তাহলে এর উদ্দেশ্য হল, বাতাস প্রেরণ করার মাধ্যমে ঘনীভূত মেঘমালায় চাপ সৃষ্টি করতঃ বৃষ্টি বর্ষণ করানো হয়। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, اللَّهُ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا, অর্থাৎ- আল্লাহ তিনি যিনি বায়ুকে প্রেরণ করেছেন, অতঃপর এটা মেঘকে আন্দোলিত করে…। (সূরা ফাতির, আয়াত-৪৮)। এখানে নিষ্পেষণ বা চেপন প্রক্রিয়াটি দু’ভাবে হয়। প্রথমতঃ বাতাস মেঘমালায় চাপ, পেষণ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়তঃ বাতাসের পেষণে মেঘমালা নিজ অঙ্গে পারস্পরিক অঙ্গাঙ্গিতে পেষণ করে, চাপ সৃষ্টি করে। ফলে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি বরিষণ হয়।

এককথায় বলতে গেলে, الْمُعْصِرَاتُ মানে যেটা বৃষ্টিবর্ষণের নিকটবর্তী হয়েছে। ইবনে আব্বাস বলেন, বাতাস। তাঁর সাথে সহমত পোষণ করেছেন কাতাদা, ইকরিমা, মুজাহিদ ও অন্যান্যগণ। কারণ, এই বাতাস মেঘকে ভারী করতঃ এটা থেকে পানি বর্ষণ করে। আবার ইবনে আব্বাস থেকে মেঘ হওয়ার কথাও বর্ণিত আছে।(তাফসীর ইবনে কাছীর, ৮/৩০৩ ) مِنَ الْمُعْصِرَاتِ শব্দটি ইঙ্গিত দেয়, একটি বাষ্পীয় মেঘ সাথে সাথেই একেবারে নিঃশেষ হয় না। তা নিঃশেষ হতে সময় লাগে।

مَاءً ثَجَّاجًا : مَاءً মানে পানি, বৃষ্টি। আর ثَجَّاجًا মানে প্রচণ্ড, ঢল, মুষলধারে, পর্যায়ক্রমে। এ সংযুক্ত শব্দদ্বয় বৃষ্টি বরিষণের দু’টি পর্যায় বর্ণনা করে। একঃ মুষলধালে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। দুইঃ পর্যায়ক্রমে বৃষ্টি হয়। পর্যায়ক্রম বলতে মুষলধারেও বোঝায় এবং টিপ টিপ করে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও বোঝায়।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা মেঘ থেকে মুষলধারে প্রচণ্ড বৃষ্টি বরিষণ করি, অথবা পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি বরিষণ করি।

যেজন্য বৃষ্টি বরিষণ হয় সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ

لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا

শব্দার্থঃ لِنُخْرِجَ = যাতে আমরা নির্গত করি। بِهِ = এর দ্বারা। حَبًّا = দানা বা শস্য। نَبَاتًا = উদ্ভিদ।

অর্থঃ যাতে আমরা এর দ্বারা দানা ও উদ্ভিদ নির্গত করি। [আয়াত ১৫]

তাৎপর্যঃ

لِنُخْرِجَ : لِـ যাতে -এখানে কারণ বোঝাতে এসেছে। لِنُخْرِجَ ক্রিয়াটি بَابُ إِفْعَالٍ থেকে এসেছে। মানে, আমরা বের করি তথা একটি মৃত দানা থেকে একটি উদ্ভিদ গজানোর মাধ্যমে উক্ত উদ্ভিদের ডালে অথবা ডাঁটায় শস্য জন্মাই। এ শব্দটি ইঙ্গিত দেয়, পরকালে তোমাদেরকে পুনরায় জীবনদান একটি সহজ কাজ।

بِهِ : এর দ্বারা বা বৃষ্টির দ্বারা।

حَبًّا وَنَبَاتًا : শস্য ও উদ্ভিদ -মানে আমরা বৃষ্টির পানি দ্বারা শস্য ও উদ্ভিদ জন্মাই। বলা বাহুল্য যে, মাটিকে উর্বর ও  আবাদ করতঃ ফসল ফলানোর জন্য বৃষ্টির ভূমিকা অপরিসীম। কারণ, বৃষ্টিতে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ আছে যা মাটিকে উর্বর করে এবং ফসল উৎপাদনে সহযোগিতা করে। স্মর্তব্য যে, আমরা এ সকল রাসায়নিক পদার্থ সেঁচের পানিতে পেতে পারি না। যেমন, নাইট্রোজেন, জিংক, ম্যাংগানিজ, কপার, কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রিক এসিড, আয়রনসহ ইত্যাদি। পরন্তু বৃষ্টির পানি উদ্ভিদের মূলকে পরিস্কার করে এবং মাটির উপরিভাগের ময়লা আবর্জনা অপসারণ করে।  ফলে, উদ্ভিদ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে এবং ফলন ভাল হয়। বাতাসের প্রত্যেক দমকা ৭৮% নাইট্রোজেন ধারণ করে। নাইট্রোজেন ও মাটি উভয়ের মিথষ্ক্রিয়া ছাড়া কোনো পুষ্টিকর উদ্ভিদ বেড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং চাষাবাদের জন্য বৃষ্টি অপরিহার্য।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা মেঘ থেকে বৃষ্টি বরিষণের মাধ্যমে জমি থেকে নানা শস্য, দানা ও উদ্ভিদ নির্গত করি। যেমন, ধান, গম, যব, ভূট্টা, গাছগাছালি ইত্যাদি।

وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا

শব্দার্থঃ وَ = ও, এবং, আর। جَنَّاتٍ = বাগানসমূহ। أَلْفَافًا = ঘন অরণ্য।

অর্থঃ এবং ঘন অরণ্যময় বাগানসমূহ। [আয়াত ১৬]

তাৎপর্যঃ

جَنَّاتٍ : শব্দটি বহুবচন। মানে বাগানসমূহ। এর একবচন হল جَنَّةٌ। অর্থাৎ- এ বৃষ্টির মাধ্যমে নানা ধরনের গাছগাছালির বাগান জন্মে।

أَلْفَافًا : এটা اِسْمُ جَمْعٍ বা বহুবচন বিশেষ্য, এর একবচন নেই। যেমনأَوْزَاعٌ । আবার বলা হয় এর একবচন হল لَفِيفٌ। যেমন  شَرِيفٌ এর বহুবচন  أَشْرَافٌ। আবার বলা হয় এটা বহুবচনের বহুবচন। যেমন لَفٌّ ولَفَّاءٌ এর বহুবচন لُفٌّ  এবং এর বহুবচনأَلْفَافٌ । মানে, ঘণ পত্রপল্লব বিজড়িত, অরণ্যময়। যেমন বিশাল বিশাল বনভূমি দেখা যায় যা মানুষের সৃষ্টি নয়। এমনিতেই প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্টি হয়েছে।

এ আয়াতের তিনটি ব্যাখ্যা রয়েছে। ইকরিমা বলেন, এর উদ্দেশ্য হল, পাশাপাশি নানা চাষাবাদের সমষ্টি। ইবনে সুদ্দি বলেন, প্রচুর ফলসমৃদ্ধ গাছ। কালবী বলেন, রঙবেরঙের উদ্ভিদ। আবার চতুর্থ একটি সম্ভাবনা রয়েছে, তা হল, মাটির বুকে বেয়ে চলা উদ্ভিদ এবং উঁচু উঁচু গাছগাছালি।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৪-১৮৫। )

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

উক্ত আয়াতের শেষাব্দের শব্দগুলোতে ছন্দ খচিত হয়েছে। যেমন, شِدادًا، وَهَّاجًا، ثَجَّاجًا، نَبَاتًا، أَلْفافًا।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৮।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

অর্থাৎ- আর আমরা বৃষ্টির পানি দ্বারা পত্রপল্লব বিজড়িত ঘন অরণ্যময় বাগানসমূহ জন্মাই।

৬ থেকে ১৬ পর্যন্ত আয়াতের সাধারণ মর্মার্থঃ

এখানে একটি প্রশ্ন হল, প্রথম পাঁচ আয়াতের সাথে পরবর্তী ছয় থেকে ষোল আয়াত পর্যন্ত বিষয়ের সাথে তথ্যের দিক দিয়ে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তাহলে নি¤œবর্তী আয়াতগুলো উপরের আয়াতের সাথে সংযুক্ত করে কীভাবে বর্ণনা করলেন? ইমাম যমখশরী বলেন, ‘তারা যেহেতু পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছে তাই তাদেরকে বলা হল, যার প্রতি পুনরুত্থানের বিষয়টি সম্পৃক্ত করা হয়েছে তিনিই কি এসকল আশ্চর্যময় বস্তু সৃষ্টি করেননি যা তাঁর পরিপূর্ণ শক্তির পরিচয় বহন করে? তাহলে তাঁর কর্তৃক পরকাল সংঘটনের শক্তিকে অস্বীকার করার হেতু কী? সেটাও এসব সৃষ্টির মতোই একটি সৃষ্টি বা আবিষ্কার।’(তাফসীর কাশশাফ, ইমাম যমখশরী, ৪/ ৬৮৫। )

পরন্তু, এখানে একটি ইঙ্গিত রয়েছে যে, তোমাদের কি জন্মের পূর্বে এসব সম্পর্কে ধারণা ছিল? অবশ্যই না। এ ধরায় আগমনের পর তোমরা এসব পর্যবেক্ষণ করছ। তোমাদের সৃষ্টির পর একটি জগৎ অবলোকন করছ, তাহলে মৃত্যুর পর যে আরেকটি জগৎ অবলোকন করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আল্লাহ এখানে জ্ঞাতব্য বিষয় দ্বারা একটি অজ্ঞাত বিষয়ের প্রতি প্রমাণ উপস্থাপন করছেন। আর এটা হল তর্কের ক্ষেত্রে প্রমাণ উপস্থাপনের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

বর্ণনার ধারাবাহিকতাঃ

পৃথিবীর কথা বর্ণনা করার পর আল্লাহ আসমানের কথা বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত ৬ থেকে ১১ পর্যন্ত আয়াত বর্ণনায় একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। প্রথমে জমিনকে বিছানা বানিয়েছেন, এটাকে সুদৃঢ় করেছেন, বংশবিস্তারের জন্য নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছেন, কাজ করার জন্য যেহেতু শক্তি দরকার এবং শক্তি সঞ্চয়ের জন্য বিশ্রাম দরকার তাই ঘুমের ব্যবস্থা করেছেন, আর ঘুম সুখকর হওয়ার জন্য অন্ধকার প্রয়োজন, তাই রাতের ব্যবস্থা করেছেন, দেহে শক্তি সঞ্চারিত হওয়ার পর কাজ করার জন্য যেহেতু আলো দরকার, তাই দিনের ব্যবস্থা করেছেন। আবার দিন ও রাত্রীর মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। যদি কোনোটিকে অতিমাত্রায় দীর্ঘ করতেন তাহলে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হত।

পৃথিবীর বিষয় বর্ণনা করার পর আসমানের কথা বর্ণনা করেছেন। আসমান হল পৃথিবীর ছাদ স্বরূপ। এটাকে সুদৃঢ় করেছেন যাতে ভেঙে না পড়ে। পৃথিবীকে আলোময় করার জন্য উপরিভাগ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ প্রয়োজন, তাই সূর্য সৃষ্টি করেছেন। জমিতে চাষবাস উত্তম হওয়া ও সবুজায়ন হওয়ার জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন। বৃষ্টির জন্য মেঘ, মেঘের জন্য বাষ্পের প্রয়োজন। তাই সূর্যে তাপ দিয়েছেন যাতে পানি থেকে বাষ্প তৈরি করে বৃষ্টির কাজে সাহায্য করে। এখানে আল্লাহ তায়ালার ইঙ্গিত হল, এতসব কিছু পর্যবেক্ষণ করার পরও কেন তোমরা পরকালকে অস্বীকার করছ? এসব সৃষ্টি প্রমাণ করে, এসবের এক স্রষ্টা রয়েছেন এবং এসবের পশ্চাতে একটি পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলা বিদ্যমান আছে।

সৃষ্টি সংক্রান্ত প্রায় পাঁচশতের মতো আয়াত আছে। এসব আয়াতাবলী উল্লেখ করার মূল কারণ কী? এর মূল কারণ হল, এসব নিয়ে গবেষণা করে আল্লাহর অস্তিত্ব ও পরকালের সত্যতা সম্পর্কে সত্যদ্রষ্টা লাভ করা। প্রাক ইসলামের ধর্মগুলোতে এ রকম গবেষণা ও চিন্তার বিষয়ে বলা হয়নি। তাদের কাছে কোনো নবী প্রেরিত হলে তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনত না তারা মো‘জেযা দেখতে চাইত, আর এক্ষেত্রে তারা শাস্তি কামনা করত। শাস্তি কামনা করার একটা যৌক্তিক কারণ ছিল। কারণ, ঈমান না আনলে পরকালে শাস্তির ব্যাপারে নবীগণ সতর্ক  করতেন।  তবে  তারা  স্বাচ্ছন্দ্যের কথা জিজ্ঞাসা করত না। কারণ, যারা প্রশ্ন করত তারা ছিল সমাজের নামীদামী, সম্ভ্রান্ত ও ধনী সম্প্রদায়ের লোক। তারা এমনিতেই আরাম-আয়েশ ও স্বাচ্ছন্দ্যে নিমজ্জিত থাকত। উক্ত ধর্মসমূহ ও আমাদের ইসলাম ধর্মের মাঝে পার্থক্য আছে। পূর্ববতী ধর্মসমূহে মো‘জেযা ছিল নবীদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। আর ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল জীবনবিধান। আর আমাদের ইসলাম ধর্মের কোরআন হল মো‘জেযা ও জীবনপদ্ধতি। তবে আমাদের নবীরও অনেক মো‘জেযা ছিল, কিন্তু আমাদের নবীর মো‘জেযা পূর্ববতী নবীদের মো‘জেযার মতো ছিল না। পূর্ববর্তী লোকেরা ঈমান না আনলে নবীকে শাস্তির মো‘জেযা প্রদর্শনের কথা বলত, ফলে তারা বিভিন্ন শাস্তির প্রকোপে স্বমূলে নির্বংশ হত। কিন্তু আমাদের ধর্মে কাফেররা কোনো প্রশ্ন করলে তাদেরকে প্রকৃতি বিজ্ঞান বা প্রাকৃতিক জগৎ নিয়ে গবেষণা করতে বলেছেন। অর্থাৎ- তোমরা এসব নিয়ে গবেষণা কর, আমার (আল্লাহ) অস্তিত্ব ও পরকালের সত্যতা পেয়ে যাবে। পূর্ববর্তী ধর্মের মো‘জেযা যেহেতু নবীদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তাই তারা যখন মৃত্যুবরণ করতেন, মো‘জেযা শেষ হয়ে যেত এবং পরবর্তীতে তাদের উম্মতেরা ধর্মীয় গ্রন্থে রদবদল করতে সক্ষম হত। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থই হল স্বয়ং মো‘জেযা ও জীবনপদ্ধতি, তাই কেউ এ গ্রন্থে রদবদল করতে সক্ষম নয়। কারণ, মো‘জেযা হল আল্লাহর কারিশমা। এটাকে কেউ অনুলিপি করতে সক্ষম নয়। কিন্তু মো‘জেযা শেষ হয়ে গেলে মূল বৈশিষ্ট্যই শেষ হয়ে গেল। তখন তাতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা সহজ। সুতরাং কোরআন শরীফ মো‘জেযা ও জীবনপদ্ধতি হওয়া প্রমাণ করে, ইসলাম ধর্ম জ্ঞানের ধর্ম এবং এ গ্রন্থ কিয়ামত অবধি অপরিবর্তিত থাকবে; কেউ এতে চুলচেরা পরিবর্তন করতে পারবে না।

যে কারণে আল্লাহ অদৃশ্যঃ

এখানে একটি প্রশ্নের অবতারণা ঘটে। এতসব ঝামেলা না করে আল্লাহ নিজের অস্তিত্বকে একটু দেখিয়ে দিলেই তো পারতেন। সবাই ঈমান আনত। কিন্তু করলেন না কেন?

উত্তরে বলতে হয়, প্রথমতঃ ঈমান মানে হল অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আর যদি তিনি নিজের জাতকে দেখাতেন তাহলে সেটা হত প্রত্যক্ষ দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন। কিন্তু আল্লাহ চান লোকেরা তাকে না দেখে বিশ্বাস স্থাপন করুক। নবীর কথা সত্য বলে গ্রহণ করুক। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর জাতকে দেখার জন্য আমাদের নেত্রযুগল সক্ষম নয়। কারণ, তাঁর জাত নুরের তাজাল্লি দিয়ে ঘেরা। আমরা সাধারণ সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরের ভেতর দৃষ্টিপাত করলে কিছু দেখি না। সব অন্ধকার দেখি। তাহলে এই স্বল্প শক্তিসম্পন্ন চক্ষু দিয়ে আল্লাহর জাতকে কীভাবে দেখব? আর এর জ্বলন্ত উদাহরণ তো মূসা আ. নিজেই। তিনি যখন আল্লাহকে দেখতে চাইলেন, আল্লাহ তাকে বলেছিলেন, قَالَ لَنْ تَرَانِي وَلَكِنِ انْظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي فَلَمَّا تَجَلَّى رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وَخَرَّ مُوسَى صَعِقًا Ñঅর্থাৎ- ‘তুমি আমাকে কক্ষনো দেখতে পারবে না। বরং তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও, যদি এটা তার স্থানে স্থির থাকে তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পারবে। অতঃপর যখন তার রব তার জন্য পাহাড়ে উদ্ভাসিত হলেন, এটা তাকে চূর্ণ করে ফেলল, আর মূসা মুর্ছা গেলেন।’ [সূরা-আ‘রাফ, আয়াত-১৪৩]  এখানে আল্লাহ শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন যদি পাহাড় স্থির থাকে, কিন্তু পাহাড় স্থির ছিল না। আর মূসা মুর্ছা গেলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে বলেননি যে, তুমি মুর্ছা যাবে। তোমার দৃষ্টি ক্ষীণ। কারণ এটা বললে তিনি হয়ত তার অপারগতার ব্যাপারে সন্দেহে নিপতিত হতেন। কিন্তু পরকালে মু’মিনগণ আল্লাহকে দেখতে পারবেন, কারণ, আল্লাহ নিজে তাঁর জাত  আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করাবেন। হয়ত আমাদের চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে দেবেন, অথবা তাঁর নিজের তাজাল্লি যেন আমাদের দৃষ্টি ধাঁধিয়ে না দেয় সে ব্যবস্থা করবেন। এটা পরকালের কথা। প্রকৃতপক্ষে, এটা কীভাবে হবে সে ব্যাপারে তিনিই ভাল জানেন। আর এ দেখানোটা হবে দুনিয়াতে তাঁর প্রতি অদৃশ্য দর্শনে ঈমান আনার প্রতিদান স্বরূপ। বলা বাহুল্য যে, কাফেররা পরকালেও আল্লাহকে দেখতে পাবে না। কারণ, তারা দুনিয়াতে আল্লাহর বাণীর প্রতি বিশ্বাস করেনি।। তৃতীয়তঃ যদি তিনি দুনিয়ায় দেখা দিতেন তাহলে সব যুগের লোকেরা তাঁর দর্শন করতে আগ্রহ পোষণ করত, অন্যথা ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানাত। আর এভাবে একটি বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। তবে তিনি এটা করতেন যদি আমাদের ঈমান আনলে তাঁর লাভ হত। কিন্তু তাঁর লাভ নেই, যা লাভ সে তো আমাদেরই।

উপরোক্ত নয়টি বিষয়ে আল্লাহর ¯্রষ্টাত্ব রয়েছে। নয়টি বিষয় হল, জমিন বিছানা স্বরূপ, পাহাড় পেরেক স্বরূপ, জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি, প্রশান্তিদায়ক ঘুম, রাত পোশাক স্বরূপ, জীবিকার জন্য দিন, সুদৃঢ় সপ্ত আকাশ, দীপ্তিমান সূর্য ও মেঘ থেকে বৃষ্টি বরিষণ এবং এখানে কাজ ও উপভোগ রয়েছে। আর এসবের অন্তরালে রয়েছে হিসেব-নিকেশ ও প্রতিদান। তাই আল্লাহ নিন্মবর্তী আয়াতে কিয়ামত দিবসের বৈশিষ্ট্য, নিদর্শন ও শাস্তির ধরন বর্ণনা করেছেন।

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ আল্লাহ তায়ালার এসব সৃষ্টি প্রমাণ করে তিনি পরকালেও আরেকটি জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং করবেনও।

দুইঃ পরকাল, প্রতিদান, নবুওয়ত, কোরআন, একত্ববাদ -এসবই সত্য। কিন্তু কেউ এটাকে স্বীকার করবে আবার কেউ স্বীকার করবে না।

তিনঃ মৃত্যুর পরই এসবের সত্যতার ব্যাপারে চাক্ষুষ প্রমাণ মিলবে।(আইসারুত তাফাসীর লি-আবি বকর আল-জাযায়েরী, ৫/৫০২।)

Share this:

Leave a Comment