সূরা নাবা

Print Friendly, PDF & Email

সূরার নামঃ

সূরার পরিচিতি

নাবা’। সূরা নং ৭৮, মক্কী সূরা, আয়াত সংখ্যা-৪০, আরেক মতে ৪১। শব্দসংখ্যা ১৭৩ টি। অক্ষর ৭৭০টি। অবতীর্ণ হওয়ার দিক দিয়ে ৮০ তম।

সূরার অন্যান্য নামসমূহঃ

এ সূরাকে আম্মা বা আম্মা ইয়াতাসাআলূন এবং সূরাতুত তাসা-উল’ও বলা হয়, আবার সূরাতুল মু‘সিরাত’ও বলা হয়।

(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৫, তাফসীর আল-খাযেন, আলাউদ্দীন আল-বাগদাদী, ৭/১৯৯। জ্ঞাতব্য যে, সূরার অক্ষর ও শব্দসংখ্যায় একজন থেকে আরেকজনের ক্ষেত্রে কিছু হেরফের হতে পারে। কারণ, কেউ কেউ হিসাবের ক্ষেত্রে সংযুক্ত শব্দকে এক শব্দ গণ্য করেছেন। তেমনি অক্ষরের ক্ষেত্রেও।)

এ সূরাটি শুরু হয়েছে একটি ভীতিকর, ভয়প্রদ এবং বাস্তবতাকে প্রকাণ্ডকরণের মাধ্যমে। পূর্ববর্তী সূরা আল-মুরসালাত এর সাথে এ সূরার সম্পর্ক হল তিনভাবেঃ

প্রথমতঃ উভয় সূরা পরকাল সম্পর্কে কথা বলেছে এবং দলিল দিয়ে এর সত্যতা প্রমাণ করেছে। আল্লাহ তার কুদরতের কথা বলেছেন। মিথ্যুক কাফেরদের ভর্ৎসনা করেছেন। যেমন, মুরসালাত সূরায় আছে, আল্লাহ বলেন, আমরা কি পূর্ববর্তীদেরকে ধ্বংস করিনি? আমরা কি তোমাদেরকে তুচ্ছ পানি থেকে সৃষ্টি করিনি? আমরা কি ভূমিকে সংযুক্ত বানাইনি? আর এ সূরাতে বলেছেন, আমরা কি ভূমিকে দোলনা বা বিছানা বানাইনি?

দ্বিতীয়তঃ উভয় সূরাতেই জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা আছে। মুত্তাকীদের আরাম-আয়েশ ও কাফেরদের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে, এবং কিয়ামত দিবসের ভীতির কথা বর্ণিত আছে।

তৃতীয়তঃ পূর্ববর্তী সূরাতে যা সংক্ষিপ্ত আছে এ সূরায় তা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন পূর্ববর্তী সূরাতে বলেন, কোন দিনের জন্য অবকাশ দেয়া হয়েছে? বিচার দিবসের জন্য। আপনি কি জানেন বিচার দিবস কী? [আয়াত-১২-১৪]। আর এ সূরায় বলেন, বিচার দিবসের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। [আয়াত-১৭]( তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা বিন মুসতফা আল-যুহাইলী, ৩০/৫।)

সূরা নাবা’

بسم الله الرحمن الرحيم

আয়াত ১ থেকে ৫নং আয়াত পর্যন্ত কাফরদের প্রশ্ন এবং তাদেরকে ধিক্কারমূলক উত্তরঃ

عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ (1) عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ (2) الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ (3) كَلا سَيَعْلَمُونَ (4) ثُمَّ كَلا سَيَعْلَمُونَ (5)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

عَمَّ يَتَسَاءَلُونَ

শব্দার্থ: عَمَّ = কী সম্পর্কে। يَتَسَاءَلُونَ = তারা জিজ্ঞাসা করে।

অর্থঃ তারা কী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? [আয়াত ১]

তাৎপর্যঃ

عَمَّ : কী সম্পর্কে? এর মূল হল عَمَّا, এটা  عَن(সম্পর্কে) ও  مَا(কী) সংযুক্ত হয়ে গঠিত হয়েছে। عَنْ -এর নূনকে মিম দ্বারা পরিবর্তন করা হয়েছে এবং মিমকে মিমের মধ্যে এদগাম করা হয়েছে, অতঃপর عَمَّا হয়েছে। আর মিমের পরে আলিফকে বিলুপ্ত করা হয়েছে তার আগে অব্যয় পদ আসা এবং অধিক ব্যবহারের কারণে। যেমনلِمَ، فِيمَ، عَمَّ، مِمَّ । অথবা প্রশ্নবোধক শব্দ   مَا (মা) এর আগে অব্যয় পদ  عَنْ (আন) আসার কারণে আলিফ বিলুপ্ত হয়েছে প্রশ্ন ও সংবাদ প্রদানের মাঝে পার্থক্য করার জন্য। আরেক বর্ণনায় আছে, ইমাম যাহ্হাক ও ইবনে কাসির عَمَّهْ (هَاءُ السَّكْتِ) পড়েছেন। বলা হয় আলিফের পরিবর্তে هَاء (হা) যুক্ত হয়েছে। আর এটা সম্পর্ক যুক্ত হল পরবর্তী ক্রিয়ার সাথে। এখানে اِسْمُ اسْتِفْهَامٍ বা প্রশ্নবোধক শব্দকে আগে উল্লেখ করা হয়েছে। আর اِسْمُ اسْتِفْهَامٍ যখন অব্যয়পদ দ্বারা সংযুক্ত হয়, তখনে সেটা বাক্যের শুরুতে আসে।

يَتَسَاءَلُونَ : তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে। অর্থাৎ- তারা সর্বনাম বলতে উদ্দেশ্য হল, মক্কার কাফেররা, বা মক্কার কাফেররা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে। অর্থাৎ- তারা একে অপরকে জিজ্ঞাসা করত যখন তারা পরকালের ব্যাপারে মু’মিনদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে। কারণ, তারা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে। অতঃপর তারা এ বিষয়টিকে অস্বীকার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অথবা মক্কার কুরাইশরা এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করত বটে, তবে তাদের মাঝে কেউ কেউ পরকালকে সত্য বলে জ্ঞান করত, আবার কেউ এটাকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করত। আবার يَسْأَلُونَ-ও পড়া যায়। তখন অর্থ দাঁড়ায়, তারা রাসূলুল্লাহ স. কে অথবা সাহাবাদেরকে প্রহসনমূলক জিজ্ঞাসা করে। বিষয়টিকে প্রকাণ্ড ও ভীতিপ্রদ করে দেখানোর জন্য এ সূরাটি প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। তদুপরি, এভাবে প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে শুরু করার দ্বারা পাঠকের মনে একপ্রকার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে তারা দুইভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমঃ একদল যারা পরকালকে সত্য বলে জ্ঞান করত। কিন্তু তারপরও তারা জিজ্ঞাসা করত অধিক পরিমাণে জানার জন্য। কারণ, একেক জনের জানার আগ্রহ আরেকজন থেকে ভিন্ন হয়।

দ্বিতীয় প্রকার হল, যারা পরকালকে অস্বীকার করত। তারা ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও প্রহসনমূলক জিজ্ঞাসা করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবতাকে জানা নয়, বরং এটা নিয়ে উপহাস করা। উপরোক্ত আয়াত দ্বারা যতধিক না প্রশ্ন করা উদ্দেশ্য, ততধিক আগ্রহ সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য। এ প্রশ্ন দ্বারা অনির্দিষ্টভাবে সকলকে খেতাব করা হয়েছে।(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৮-৯)

তাদের জিজ্ঞাসা করার বিষয় কয়েকটি হতে পারে। যেমন, মুজাহিদ বলেন, তারা কোরআন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত। ইবনে যায়েদ বলেন, তারা কিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত। কাতাদা বলেন, তারা পরকাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত। আরেক মত হল, তারা রাসূলুল্লাহ স. সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করত।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮২।) বলা বাহুল্য যে, এগুলোর সবটিই হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। কারণ, একেক জনের মনে একেক ধরনের প্রশ্ন ছিল।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

মক্কার কোরাইশ গোত্রের লোকেরা একে অপরকে কী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে?

উপরোক্ত প্রশ্ন করা যেহেতু কোনো কিছুর সমঝকে তলব করা হয় নি, তাই এর উত্তর উল্লেখ করাই উত্তম।(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৯।) আর তার উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ

শব্দার্থ: عَنِ  = সম্পর্কে।النَّبَإِ  = প্রকাণ্ড সংবাদ। الْعَظِيمِ = বড়, বিশাল।

অর্থঃ প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। [আয়াত ২]

তাৎপর্যঃ

عَن : মানে সম্পর্কে। 

النَّبَأ : বড় প্রকাণ্ড বা বিশালকায় কোনো বিষয়। এ আয়াতের শুরুতে يَتَسَآءَلُونَ ক্রিয়া উহ্য রয়েছে। অর্থাৎ- يَتَسَاءَلُونَ عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ। মানে তারা প্রকাণ্ড বিষয় বা সংবাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। অথবা প্রশ্নবোধক করেও পড়া যায়। যেমন, أَيَتَسَاءَلُونَ عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ  অথবা أَعَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ। অর্থাৎ-  তারা কি প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? এখানে প্রশ্নবোধক أَ বা ‘কি’ কে উল্লেখ করা হয়নি, কারণ, পূর্বোক্ত আয়াত দ্বারা তা বোধগম্য।

النَّبَأُ বা প্রকাণ্ড সংবাদ কী, এ ব্যাপারে আল্লাহ স্পষ্ট করেননি। এ ব্যাপারে চারটি মত রয়েছে। মুজাহিদ বলেন, আল-কোরআন। তার দলিল, قُلْ هُوَ نَبَأٌ عَظِيمٌ [সূরা স-দ, আয়াত-৬৭]। কাতাদা বলেন, পুনরুত্থান বা পরকাল। ইবনে যায়েদ বলেন, কিয়ামত দিবস। আরেক মত হল, রাসূলুল্লাহ স.। তবে সূরার বর্ণনাশৈলী দেখে পুনরুত্থান বা পরকাল বিষয়টিই প্রাধান্য পায়। আবার চারটিই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, একেকজনের মনে একেক ধরনের প্রশ্ন উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

প্রথম আয়াতে প্রশ্ন এবং এ আয়াতে উত্তর দেয়ার কারণ হল, প্রশ্ন ও উত্তর দেয়ার স্থানে একটি বাক্যকে প্রশ্ন ও উত্তরসহ উল্লেখ করা বিষয়টিকে আরো বোধগম্য ও সুস্পষ্ট করে।(তাফসীর রাযী, ৩১/৪।)

الْعَظِيمِ : বড়, প্রকাণ্ড, বিশাল। النَّبَأ মানে প্রকাণ্ড সংবাদ বা বিষয় হলেও এর বিশেষণ প্রকাণ্ড উল্লেখ করা হয়েছে এটাকে আরো গুরুত্ববহ করার জন্য।

ভাষা অলংকারঃ

এখানে দ্বিতীয় আয়াত عَنِ النَّبَإِ الْعَظِيمِ থেকে يَتَسَاءَلُونَ ক্রিয়াটি বিলুপ্ত করা হয়েছে আয়াতকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য। তাই, এখানে إِيجَازٌ বা সংক্ষিপ্তকরণ হয়েছে। অর্থাৎ এ বাক্যের শুরুতে يَتَسَاءَلُونَ ক্রিয়া উল্লেখ করা হয় নি। কারণ, প্রথম আয়াতের يَتَسَاءَلُونَ ক্রিয়াটি এর অর্থ প্রকাশ করছে।(তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা একে অপরকে অথবা আপনাকে কী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? তারা প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে।

الَّذِي هُمْ فِيهِ مُخْتَلِفُونَ (3)

শব্দার্থ: الَّذِي = যে। هُمْ = তারা। فِيهِ = তার মধ্যে বা যে বিষয়ে। مُخْتَلِفُونَ = তারা মতভেদ করে, মতভেদকারী।

অর্থঃ যে বিষয়ে তারা মতভেদ করে। [আয়াত ৩]

তাৎপর্যঃ

الَّذِي : যে, যা বা যে বিষয়ে। উদ্দেশ্য হল প্রকাণ্ড সংবাদ।

هُمْ : তারা বলতে উদ্দেশ্য হল উক্ত প্রশ্নকারীরা। তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করত। তন্মধ্যে কেউ বলত, এটা পূর্ববর্তীতের উপাখ্যান। কেউ বলত, এটা পাগলের প্রলাপ। কেউ বলত, এটা যাদু। কেউ বলত, এটা মিথ্যা। আবার কেউ কিয়ামত ও পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত। আবার কেউ হিসাব-নিকাশকে অস্বীকার করত।

فِيهِ : সে বিষয়ে বা উক্ত প্রকাণ্ড বিষয়ে। অব্যয়পদ ও সর্বনাম যুক্ত فِيهِ শব্দকে مُخْتَلِفُونَ এর আগে আনা হয়েছে উক্ত প্রকাণ্ড সংবাদকে গুরুত্ববহ করার জন্য। এবং এটা বোঝানোর জন্য যে, তাদের মতভেদ এসব বিষয় নিয়েই; অন্য কোনো বিষয় নিয়ে নয়।

مُخْتَلِفُونَ : মতভেদকারী, তারা মতভেদ করে -উভয় অর্থই গ্রহণ করা যায়। صِلَةٌ এর مَوْصُولٌ  কে فِعْلٌ مُضَارِعٌ  উল্লেখ না করে  اِسْمٌ فَاعِلٌ বা কর্তৃবাচ্য উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ يَخْتَلِفُونَ না বলে বলা مُخْتَلِفُونَ বলা হয়েছে। اِسْمٌ فَاعِلٌ বা কর্তৃবাচ্য উল্লেখ করার ফলে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে শুরুতে থেকে যেসব প্রশ্ন ও সন্দেহ পোষণ করছে সে ধরনের প্রশ্ন সবসময়ই থাকবে এবং এটা তাদের কর্তৃক বলবৎ থাকবে বা এ ধরনের প্রশ্ন ও সন্দেহ সর্বদা করতে থাকবে।

মতভেদকারীরা হল দুই প্রকারঃ মু’মিন ও মুশরিক। মু’মিনগণ পরকালে বিশ্বাস করত এবং তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেত। আর মুশরিকরা পরকালকে বিশ্বাস করত না। তারা পরকালের জীবনকে অসম্ভব মনে করত। তাই তারা বলত, যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা বলে, আমাদের জীবন তো হল কেবল পার্থিব জীবন। আমরা মৃত্যুবরণ করি, জীবনলাভ করি। আর আমাদেরকে ধ্বংস করবে সময়। [সূরা জাছিয়া, আয়াত-২৪] এর ফলে তার অস্বীকার করার প্রবণতাই আরো বৃদ্ধি পায়।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে মতভেদ করে। তন্মধ্যে কেউ পরকালকে স্বীকার করে। আবার কেউ অস্বীকার করে। ফলে, তারা নানা অবান্তর প্রশ্নের অবতারণা করে।

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদের এ ধারণাকে খণ্ডন করে বলেন,

كَلا سَيَعْلَمُونَ (4)

শব্দার্থ: كَلاَّ = কক্ষনো না। سَيَعْلَمُونَ = তারা শীঘ্রই জানবে।

অর্থঃ কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানবে। [আয়াত ৪]

তাৎপর্যঃ

كَلاَّ: মানে হল পূর্ববর্তী কথার সত্যতাকে নাকোচ করা এবং তা রহিত করা। আর এ ধরনের প্রশ্ন থেকে বিরত থাকা এবং উক্ত প্রশ্নের জন্য হুমকি প্রদর্শন করা। অর্থাৎ- মুশরিকরা যে পরকালের জীবনকে অস্বীকার বা অসম্ভব মনে করেছিল, তাদের এ ধারণাকে রহিত করা উদ্দেশ্য।

سَيَعْلَمُونَ : বর্তমান ক্রিয়াকে নিকটবর্তী ভবিষ্যৎ বোঝানোর জন্য ক্রিয়ার আগে سَـ আসে। অর্থাৎ- তারা অচিরেই জানবে। জানা কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। শোনার মাধ্যমে জানা, দেখার মাধ্যমে জানা বা চাক্ষুষ অনুধাবন করা, আর ছোঁয়ার মাধ্যমে পরীক্ষিতভাবে এ বিষয়ে নিশ্চিত সত্যজ্ঞান লাভ করা। প্রথম পর্যায়কে অস্বীকার করার সম্ভাবনা থাকলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকারের পর্যায় দু’টি অস্বীকার করার অবকাশ থাকে না। উদ্দেশ্য হল, এখন তারা ওহীর কথা অস্বীকার করছে; কিন্তু এর সত্যতা তারা অতিশীঘ্রই জানতে পারবে। দ্বিতীয় প্রকার জানা বলতে উদ্দেশ্য হল, কিয়ামত দিবস যা তারা পুনরুত্থানের পর চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করবে। আর তৃতীয় প্রকার জানা বলতে উদ্দেশ্য হল, কাফেররা জাহান্নামে প্রবেশ করে শাস্তির সত্যতা অনুধাবন করবে। পক্ষান্তরে, মু’মিনরা জান্নাতে প্রবেশ করে আরাম-আয়েশের সত্যতা পর্যবেক্ষণ করবে। আর পরকালের সম্বন্ধে সত্যজ্ঞান লাভ হয় মৃত্যুর পরপরই।

গুরুত্ব প্রদানের জন্য আবারো বলেনঃ

ثُمَّ كَلا سَيَعْلَمُونَ (5)

শব্দার্থ: ثُمَّ = অতঃপর। كَلاَّ = কক্ষনো না। سَيَعْلَمُونَ = তারা শীঘ্রই জানবে।

অর্থঃ অতঃপর কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানবে। [আয়াত ৫]

তাৎপর্যঃ

এখানে একই আয়াত দুইবার বলা হয়েছে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য। আর দ্বিতীয় আয়াতে ‘অতঃপর’ শব্দটি ইঙ্গিত দেয় যে, দ্বিতীয়টি প্রথমটির চেয়ে বেশি ভয়ংকর। অথবা প্রথমটি বলতে যুদ্ধের সময়। যেমন বদর যুদ্ধে কাফেরদের মৃত্যু। আর দ্বিতীয়টি কিয়ামত দিবস। অথবা, প্রথমটি বলতে উদ্দেশ্য হল, পুনরুত্থানের সময়। আর দ্বিতীয়টি বলতে উদ্দেশ্য হল প্রতিদানের সময়।(তাফসীর বায়যাভী, পৃষ্ঠা ৪/৫০৮।) অথবা বলা হয়, প্রথমটির উদ্দেশ্য হল, কাফেররা জাহান্নামে যে শাস্তি ভোগ করবে তা তারা জানবে। আর দ্বিতীয়টির উদ্দেশ্য হল, মু’মিনরা জান্নাতে যে আরাম-আয়েশে থাকবে তা তারা জানবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা মতভেদ করছে। তাদেরকে মতভেদ করতে দিন। এ বিষয়ে তারা শীঘ্রই সত্যজ্ঞান লাভ করবে। তখন এটাকে আর মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করতে পারবে না।

১ থেকে ৫ পর্যন্ত আয়াতের সাধারণ মর্মার্থঃ

রাসূলুল্লাহ স. কে যখন নবুওয়ত প্রদান করা হল, তিনি লোকদেরকে দাওয়াত দিলেন, পরকালে জীবনলাভের কথা বললেন। মু’মিনগণ এটাকে বিশ্বাস করলেন। আর কাফেররা এটাকে অবিশ্বাস করল এবং ঠাট্টা-বিদ্রুপাত্মক ও প্রহসনমূলক তারা একে অপরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। অথবা রাসূলুল্লাহ স. অথবা সাহাবাদেরকে জিজ্ঞাসা করত। মুশরিকরা কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে? তারা কোন বিষয়ে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করে? তারা তো প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, যে সংবাদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ স. কে প্রেরণ করা হয়েছে, যে বিষয়ে কোরআন বলেছে যে, পরকাল সত্য, কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, কোরআন সত্য, রাসূলুল্লাহ সত্য। কিন্তু তারা অবিশ্বাসমূলক প্রহসন করার কারণে আল্লাহ তাদেরকে শাসিয়ে বলেন যে, ‘তারা শীঘ্রই জানবে’। তারা যা ধারণা করছে বা পরকালকে অস্বীকার করছে, এ বিষয়ে তারা শীঘ্রই জানবে -এটা সত্য নাকি মিথ্যা। কারণ, মানুষের জীবন অত্যল্পই। মৃত্যুর পরই পরকালের জীবনরহস্য উন্মোচিত হবে।

এখানে কয়েকটি প্রশ্ন আসে। প্রথমতঃ আল্লাহ তাদের প্রশ্নকে স্পষ্ট করেননি। বরং বলেছেন, ‘প্রকাণ্ড বিষয় সম্পর্কে’। কারণ, মুশরিকদের প্রশ্ন ছিল বৈশিষ্ট্য নিয়ে, নাম নিয়ে নয়। আর একটি নাম, জাত বা বিষয়ের পরিচিতি ঘটে বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। তাই তিনি বৈশিষ্ট্যই উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ- তারা যে বিষয়কে অস্বীকার করছে, অসম্ভব বলে আখ্যা দিচ্ছে বা হাসি-তামাশা করছে, এটা ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়। এটা বিশালকায় প্রকাণ্ড একটি বিষয়। অথবা নাবা’ বলতে যদি সম্ভাব্য চারটি বিষয়ই ধরা হয় বা একেকজনের মনে একেক ধরনের সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছিল তাহলে সে অর্থে হলে এর উদ্দেশ্য হবে, তারা যেসব বিষয়ে সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহমূলকভাবে প্রহসন করছিল, তার সত্যতা তারা শীঘ্রই জানতে পারবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, আল্লাহ তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং তাদেরকে ধিক্কার দিয়েছেন এই বলে, ‘কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানবে’। এর কারণ হল, মুশরিককরা পরকালকে অসম্ভব মনে করত ফলে প্রহসনমূলক প্রশ্ন করেছে। তারা উত্তর জানতে চায়নি। তাই আল্লাহ তাদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান না করে বরং হুমকি ও ধিক্কারমূলক কথা বলেছেন আর বিষয়টিকে আরো আশ্চর্যজনক ও প্রকাণ্ড করে উপস্থাপন করেছেন এই বলে, ‘কক্ষনো না, শীঘ্রই তারা জানবে’। আর এমন ধিক্কারমূলক কথা সরাসরি উত্তর প্রদানের চেয়ে মনে বেশি দাগ কাটে। যেমন ধরুন, কোনো রাজা কোনো একটি বিষয়ে নির্দেশ দিলেন, তখন প্রজারা সে বিষয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপাত্মক কথা বলল, তখন রাজা তাদেরকে উত্তর দেবেন নাকি শাস্তি দেবেন, অথবা ধিক্কারমূলক উত্তর জানাবেন? অবশ্যই শাস্তি দেবেন। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু শাস্তিকে পরকালের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন এবং এ জগতে তাদের মুক্ত বিচরণের অবকাশ দিয়েছেন, তাই শাস্তি প্রদান না করতঃ তাদেরকে এর সত্যতার ব্যাপারে ধিক্কারমূলক উত্তর দিয়েছেন যে, তারা মৃত্যুর পর এর সত্যতা আপন নেত্রে পর্যবেক্ষণ করবে।

পরকাল সম্পর্কে তাদের অস্বীকারকরণকে আল্লাহ তায়ালা অস্বীকার করেছেন, তাই প্রশ্নবোধক শব্দ দিয়ে সূরা শুরু করেছেন। এ কয়েকটি আয়াত হল এ সূরার ভূমিকা।

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ পরকাল যেহেতু অদৃশ্য, তাই এ নিয়ে আগেও যেমন প্রশ্ন ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

দুইঃ সবকিছুরই প্রকাশিত হওয়ার যেমন নির্দিষ্ট একটি সময় রয়েছে, তেমনি পরকালেরও নির্দিষ্ট একটি সময় রয়েছে। এটা তার আপন সময়মতো প্রকাশিত হবে।

৬- ১১ আয়াতে পৃথিবীর সৃষ্টি বৈশিষ্ট্য এবং মানবজাতির প্রয়োজন এবং এতে রয়েছে পরকাল অবশ্যম্ভাবিতার আকরঃ

أَلَمْ نَجْعَلِ الأرْضَ مِهَادًا (6) وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا (7) وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا (8) وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا (9) وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا (10) وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا (11)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

أَلَمْ نَجْعَلِ الأرْضَ مِهَادًا (6)

শব্দার্থ: أَ = কি? হ্যাঁ/ না উত্তরের জন্য প্রশ্নবোধক শব্দ।  لَمْ= না বোধক শব্দ, ভবিষ্যৎ ক্রিয়ার আগে যুক্ত হয়ে অতীতের অর্থে রূপান্তরিত করে। نَجْعَلْ = আমরা বানাই। أَلَمْ نَجْعَلْ= আমরা কি বানাইনি? الْأَرْضَ = পৃথিবী। مِهَادًا = দোলনা যা বাচ্চাকে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, বিছানা, চলার জন্য উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে। আবার এটাকে মাসদার বা ক্রিয়ামূল হিসেবেও উল্লেখ করা হয়, অর্থাৎ- مَهْدٌ।

অর্থঃ আমরা কি পৃথিবীকে বিছানা/ দোলনা বানাইনি? [আয়াত ৬]

তাৎপর্যঃ

أَلَمْ نَجْعَلِ : আমরা কি বানাইনি বা আমরা কি তৈরি করিনি? এখানে না-বোধক প্রশ্ন বলে উদ্দেশ্য হল এর বিপরীত তথা হ্যাঁ-বোধক বিবৃতিমূলক বাক্য গুরুত্ব সহকারে প্রমাণিত হওয়া। এখানে না বোধক প্রশ্ন বলতে উদ্দেশ্য হল, নিশ্চয় আমরা পৃথিবীকে বিছানা বানিয়েছি, এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরবি ভাষার কিছু রীতি রয়েছে যে, এমন কিছু বাক্য রয়েছে যেগুলো তার বিপরীত অর্থটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়, তন্মধ্যে থেকে এটি একটি।

الْأَرْضَ : পৃথিবী হল সূর্যের তৃতীয় গ্রহ এবং আকার ও ভরের দিক দিয়ে সৌরজগতের পঞ্চম বৃহৎ গ্রহ। এটা দেখতে উজ্জ্বল-নিলাভ গ্রহ। অন্তস্থল থেকে বহির্ভাগের দিকে এর শ্রেণিবিন্যাস হলঃ অন্তস্থল (the core), আবরণ (the mantle), ভূত্বক (the crust), বারিমণ্ডল (the hydrosphere -প্রধানত মহাসাগরসমূহ যেটা নিচের ভূত্বক অঞ্চলগুলো পূর্ণ হয়ে আছে), বায়ুমণ্ডল (the atmosphere -এটা গোলাকার অঞ্চলে ভাগ হয়ে আছে, যেমন ট্রপোস্ফিয়ার যেখানে বায়ু দৃষ্ট হয়, এবং স্ট্রেটস্ফিয়ার যেখানে ওজোন স্তর (the ozone layer) অবস্থিত যেটা পৃথিবীর উপরিভাগকে রক্ষা করে এবং এর গঠনকে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে), এবং ম্যাগনেটস্ফিয়ার (the magnetosphere – শূন্য জায়গায় বা স্পেইসে এটা একটা বিশাল অঞ্চল যেখানে পৃথিবীর চৌম্বকীয় অঞ্চল সূর্য থেকে আগত বৈদ্যুতিকভাবে ভরা কণাগুলোর ধর্মের উপর আধিপত্য বিস্তার করে।) আজ অবধি এ পৃথিবীই একমাত্র জীবনবান্ধব গ্রহ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। গবেষণা চলছে আরো জীবনবান্ধব গ্রহের।

مِهَادًا : দোলনা, দোলনা সদৃশ, সমতল ভূমি, মেঝে। একটি দোলনা যেমন ঝুলে থাকে এবং চতুর্দিক থেকে বেষ্টনী দেয়া থাকে একটি শিশুর নিরাপত্তার জন্য, তদুপরি বিছানা হল সমতল; তেমনি এখানে পৃথিবীকে দোলনা বলতে উদ্দেশ্য হল, এট ঝুলন্ত বিছানা তবে সুরক্ষিত সমতল মেঝে। এটা ইঙ্গিত দেয় যে, পৃথিবী গোলাকার এবং এর চারদিকে সুরক্ষা বন্ধনী আছে। কারণ, যদি গোলাকার না হত, তাহলে একটা সীমানায় গিয়ে এটা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু গোলাকার হওয়ার ফলে একজন পরিব্রাজক যেদিকেই যাক না কেন, তার সম্মুখে এটা সমতল বলেই প্রতিভাত হবে। আর পৃথিবীকে বিভিন্ন সৌর আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য যদি সুরক্ষা বন্ধনী না থাকত, তাহলে এ পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীরা ধ্বংস হয়ে যেত। হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, বিছানা বলতে যেহেতু সমতল বোঝায়, তাহলে পৃথিবী সতমল হল কীভাবে, এর পৃষ্ঠভাগে অনেক উঁচুনিচু, খাদ রয়েছে? উত্তর হল, এই উঁচুনিচু, খাদ -এসব হল আপেক্ষিক। আর এই আপেক্ষিকতা পৃথিবীর বিছানা হওয়াতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না। তা না হলে সৃষ্টিকুল এর পৃষ্ঠভাগে চলাফেরা করতে সক্ষম হত না। এর সৃষ্টিতে কোনো ত্রæটি নেই। ত্রæটি থাকলে এটা আর বিছানা হিসেবে স্বীকৃতি পেত না।

অর্থাৎ- আমরা কি পৃথিবীকে দোলনার মতো বানাইনি? একটি বাচ্চা যেমন দোলনায় শুয়ে থাকে, আবার এপাশ-ওপাশ হয়, তেমনি লোকেরা এখানে বাস করে, এদিক-সেদিক চলাফেরা করে। কিন্তু কাফেরদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে যাতে উত্তরটি তাদের দিক থেকেই আসে। আর উত্তর তো এখানে অবশ্যই হ্যাঁ-বোধকই হবে। আর প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে এ ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া প্রশ্নকারীর মনে সরাসরি উত্তরের চেয়ে ইতিবাচক প্রভাব বেশি বিস্তার করে।

ভাষা অলংকারঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা উপমা প্রদানে আধিক্য হয়েছে বা অতি উপমা হয়েছে। মূল বাক্যটি হল, أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ كَالْمِهَادِ –অর্থাৎ-আমরা কি ভূমিকে দোলনা সদৃশ বানাইনি?( তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭। )

একবচনের ক্ষেত্রে বহুবচনের ব্যবহারঃ

এখানে একটি প্রশ্নের অবতারণা হয়, তা হলঃ আল্লাহ হলেন একক এক সত্তা। তাহলে তিনি এখানে এবং পরবর্তী আয়াতসমূহে এবং অন্যান্য স্থানেও বারবার বহুবচনের সর্বনাম যুক্ত ক্রিয়া তথা ‘আমরা’ ব্যবহার করেছেন কেন?

এর উত্তর হলঃ প্রথমতঃ আরবিতে সম্মানার্থে একবচনের ক্ষেত্রে বহুবচন ব্যবহার করা হয়। সেদিকে খেয়াল রেখে বহুবচনের ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আল্লাহ তায়ালা তাওহীদ বা একত্ববাদের ক্ষেত্রে বহুবচনের সর্বনাম অথবা ক্রিয়া ব্যবহার করেননি। সেখানে তিনি সর্বদা একবচন ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর যেসব কাজে ফেরেশতারাও অংশগ্রহণ করেন সেক্ষেত্রেও বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। তখন ফেরেশতারাও এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

একটি বাচ্চা যেমন দোলনায় শয়ন করে, এপিঠ-ওপিঠ গড়াগড়ি করে, কিন্তু সে পড়ে যাওয়ার ভয় করে না। সে নিরাপদ থাকে। ঠিক তেমনি পৃথিবীকে দোলনা সদৃশ সমতল করে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এখান থেকে শূন্যে ছিটকে পড়বে না। সে এখানে নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে।

وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا (7)

শব্দার্থ: الْجِبَالَ = পাহাড়সমূহ। أَوْتَادًا = পেরেকসমূহ।

অর্থঃ আর পাহাড়রাজিকে পেরেক? [আয়াত ৭]

তাৎপর্যঃ

وَالْجِبَالَ : পাহাড়সমূহ। শব্দটি বহুবচন। এর একবচন- الْجَبَلُ। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ৩৯ জায়গায় পাহাড়ের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে থেকে এই আয়াতটিও। অর্থাৎ- আমরা কি পাহাড়সমূহকে পেরেক সদৃশ বানাইনি? এখানেও প্রশ্নটির উদ্দেশ্য হল, হ্যাঁ-বোধক বিবৃতিমূলক। অর্থাৎ-নিশ্চয় আমরা পাহাড়সমূহকে পেরেক স্বরূপ স্থাপন করেছি। আল্লাহ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করলেন তখন এটা দুলছিল, আন্দোলিত হচ্ছিল। আন্দোলিত হওয়ার কারণ এটাও হতে পারে যে, পৃথিবীর গাত্রে যে আপেক্ষিক উঁচুÑনিচু রয়েছে, ফলে ভারসাম্য ছিল না Ñসেজন্য। তাই এটাকে স্থির করার জন্য পাহাড়কে পেরেক স্বরূপ স্থাপন করেছেন এবং সুদৃঢ় করেছেন যাতে পৃষ্ঠভাগের সৃষ্টিকুলকে নিয়ে হেলে না পড়ে, আন্দোলিত না হয়, যেমন ঘরবাড়ি, চেয়ার-টেবিলকে পেরেক মেরে সুদৃঢ় করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَواسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ অর্থাৎ- ‘আর তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পাহাড় স্থাপন করেছেন যাতে তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে।’ [সূরা নাহল, ১৫]।

হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘যখন আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, এটা আন্দোলিত হচ্ছিল। অতঃপর পাহাড় সৃষ্টি করলেন এবং এটাকে এর গাত্রে  স্থাপন করলেন এবং এটা স্থির হল। পাহাড় সৃষ্টি অবলোকন করতঃ ফেরেশতারা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি পাহাড়ের চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, লোহা। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি লোহার চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আগুন। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি আগুনের চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, পানি। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি পানির চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, বাতাস। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি বাতাসের চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, বনি আদম যখন ডান হাত দিয়ে দান করে এবং তা বাম হাত থেকে গোপন রাখে।’(মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১২২৭৫, হাদিসটি দ্বয়ীফ। কারণ সুলাইমান বিন আবি সুলাইমান মাজহুল বা অপরিচিত।)

প্রশ্ন আসে, আল্লাহ চাইলে তো পৃথিবীকে এমনিতেই স্থির করতে পারতেন, তাহলে পাহাড়ের প্রয়োজন দেখা দিল কেন? উত্তরে বলতে হয়, আল্লাহ চাইলে ঠিকই পারতেন। কিন্তু আল্লাহ এ জগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং এর কিছু বিধান ও কার্যকারণও নির্ধারণ করেছেন। আর উক্ত কার্যকারণের নিয়ন্তাও তিনিই। সুতরাং পাহাড় বিনে পৃথিবী সৃষ্টি অথবা পাহাড় সমেত পৃথিবী সৃষ্টি Ñসে আল্লাহর সকাশ একই।

أَوْتَادًا : পেরেকসমূহ। শব্দটি বহুবচন। এর একবচন-وَتَدٌ । পেরেক বানানো হয়েছে বলতে উদ্দেশ্য হল, পেরেক সদৃশ।

পাহাড়কে পেরেকের সাথে উপমা দেয়ার কারণঃ

এখানে একটি প্রশ্ন আসে, পাহাড়কে কেন পেরেকে বা লোহার সাথে তুলনা করা হল? একটি কাষ্ঠখণ্ডে একটি লোহা প্রবিষ্ট করলে যেমন এর অধিকাংশ অংশই ভিতরে প্রবেশ করে এবং এর অল্পমাত্রা বহির্ভাগে থাকে উক্ত কাষ্ঠখণ্ডকে সুদৃঢ় করার জন্য, আর এর কাজ হল শক্ত, মজবুত ও সুদৃঢ়করণ। ঠিক তেমনি পাহাড়ের বেলাতেও। উত্তরকালে ভূ-বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, পাহাড়ের যে অংশ মাটির উপরে দণ্ডায়মান থাকে, এর ১০ থেকে ১৫ গুণ প্রলম্ব অংশ মাটির গাত্রে প্রোথিত থাকে যা সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে থাকে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা যতই বেশি হবে, ভূ গাত্রের অভ্যন্তরেও এর ভাগ বেশি হবে, যাতে ভূ গাত্রের পাথুরে স্তর পেরুতে পারে এবং ভূ গাত্রের দুর্বল অঞ্চলে ভেসে থাকতে পারে। উক্ত অঞ্চল বিগলিত, কোমল, অতিমাত্রায় ঘন ও আঠালো। সেখানে পেরেক সদৃশ পাহাড়টি ভাসমান থাকে। স্থলভাগের শূন্যতা যত বেশি হবে, পাহাড়ের চূড়া তত উঁচু হবে এবং এর প্রোথিত অংশও তত প্রলম্ব হবে যাতে নিচের আঠালো অঞ্চলে পৌঁছতে পারে। তখন পাহাড় তার আন্দোলন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। এর নিচে নানা খনিজ পদার্থের উদ্ভব ঘটে যা ঘটা সম্ভবপর নয় কিন্তু চাপ-তাপ বিহীন ব্যতিক্রম পরিবেশ ব্যতিরেকে। আর এ পরিবেশটিই বিরাজ করে উক্ত পাহাড়ের নিচে। আর এভাবে কোরআন পাহাড়ের পেরেক সদৃশ বৈশিষ্ট্যটি বর্ণনা করে।(আল-মাফহুমুল ইলমি লিল-জিবাল ফিল কুরআনিল কারীম Ñড. যগলুল আল-নাজ্জার, ৩/১৮।)

ভাষা অলংকারঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা উপমা প্রদানে আধিক্য হয়েছে বা অতি উপমা হয়েছে। মূল বাক্যটি হল, أَلَمْ نَجْعَلِ الْجِبَالَ كَالْأَوْتَادِ Ñঅর্থাৎ-আমরা কি পাহাড়কে পেরেক সদৃশ স্থাপন করিনি?( তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭। )

তাৎপর্যগত অর্থঃ

পৃথিবী এর অধিবাসীকে নিয়ে যাতে ঢলে না পড়ে বা এতে দুর্বলতার কারণে বিশৃঙ্খলতা দেখা না দেয়, সেজন্য এতে পাহাড়কে পেরেক সদৃশ প্রোথিত করা হয়েছে।

وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا (8)

শব্দার্থ: وَخَلَقْنَا = আর আমরা সৃষ্টি করেছি। كُمْ= তোমাদেরকে। أَزْوَاجًا = জোড়া জোড়া অবস্থায়।

অর্থঃ আর আমরা তোমাদেরকে জোড়া জোড়া অবস্থায় সৃষ্টি করেছি। [আয়াত ৮]

তাৎপর্যঃ

وَخَلَقْنَاكُمْ : আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি- সৃষ্টি বলতে বোঝায় কোনো কিছুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা, নতুনভাবে সৃষ্টি করা।

أَزْوَاجًا : জোড়া জোড়া অবস্থায় অথবা জোড়ায় জোড়ায়। এটা বহুবচন শব্দ। এর একবচন- زَوْجٌ। এটা এখানে অবস্থা বর্ণনা করেছে। সাধারণ দৃষ্টিতে জোড়া জোড়া বলতে উদ্দেশ্য হল নারী ও পুরুষ। زَوْجٌ বলতে স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই বোঝায়, যেমন ইংরেজি ংঢ়ড়ঁংব শব্দ। এটা বলতে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই বোঝায় বা উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়। অথাৎ স্বামী হল স্ত্রীর জন্য زَوْجٌ বা জোড়া, আর স্ত্রী হল স্বামীর জন্য زَوْجٌ বা জোড়া। আল্লাহ নারী-পুরুষকে এভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন তারা একে অপরের জোড়া হতে পারে, একে অপরের প্রশান্তির কারণ হয়, সবকিছুতে অংশিদার হয়। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির প্রতি বিশেষ এক নেয়ামত। তাই তাদের উচিত তাঁর শুকরিয়া আদায় করা। তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করা।

অর্থাৎ- আল্লাহ তায়ালা বংশপ্রক্রিয়া বহাল রাখার জন্য সবকিছু জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন। আবার বলা হয় أَزْوَاجٌ মানে বিভিন্ন ধরনের অর্থেও আসে। অর্থাৎ- সাদা, কালো, লালচে, খাটো, লম্বা, ভাষা ইত্যাদি প্রকৃতির। এটা হল সকল মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা। তবে সাইয়িদ কুতুব তার ফী যিলালিল কুরআনে একটি ভিন্ন মর্ম উল্লেখ করার প্রয়াস পান। যার সারমর্ম হল, বংশপ্রক্রিয়া বজার রাখার জন্য নারী-পুরুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টির করার ফলে স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা নিবারণে যে আনন্দ, পরিতৃপ্তি রয়েছে তা বোঝার জন্য গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এখানে এ বিষয়টিকে একটু ভিন্ন ও গভীর ভাবে মূল্যায়ন করলে এ বিষয়টি প্রতিভাত হয় যে, বাহ্যিকভাবে শুক্রকীটে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। কিন্তু এই শুক্রকীটে দুইটি প্রকার রয়েছে। ‘ওয়াই ক্রোমোজম ও এক্স ক্রোমোজম’। তেমনি নারীর ডিম্বাণুতে রয়েছে দু’টি এক্স ক্রোমোজম। ওয়াই ক্রোমোজম নারীর ডিম্বাণুর সাথে নিষিক্ত হলে সন্তান হবে ছেলে, আর এক্স ক্রোমোজম নিষিক্ত হলে সন্তান হবে মেয়ে। সৃষ্টিকুলে এই যে ভেদ রয়েছে এই সূক্ষ্ম কারিগরির কার্যপ্রক্রিয়া স্বয়ং আমি আল্লাহই সন্নিবেশ করেছি। এখানে তোমাদের কোনো হাত নেই।(ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৪ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৪-পিডিএফ)। (তার কথা উপস্থাপনে কিছুটা পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে -লেখক।))

জোড়া জোড়া বলতে যা উদ্দেশ্যঃ

সাধারণভাবে বোঝা যায় নারী ও পুরুষ। কিন্তু সাইয়িদ কুতুব এর অর্থ নিয়েছেন শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংযোজনে জোড়া বস্তুর দ্বারা একটি মানব সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু এখানে خَلَقْنَا বলেছেন, যা অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা বোঝায়, সে দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে أَزْوَاجٌ শব্দটি বলতে জোড়া জোড়া ক্রোমোজম দিয়েই সৃষ্টি করা বোঝাবে। যদি জোড়া জোড়া বলতে নারী-পুরুষ বোঝাতেন তাহলে خَلَقْنَا না বলে جَعَلْنَا বলতেন। অর্থাৎ- নারী-পুরুষকে জোড়া জোড়া বানিয়েছেন। جَعَلْنَا ব্যবহার করা হয় একটি কিছু সৃষ্টি করার পর তার জন্য যে নীতিমালা ও বিধান তৈরি করা হয় সেক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি সৃষ্টির অর্থ নিয়ে নারী-পুরুষ জোড়া জোড়া অর্থ গ্রহণ করি, তাহলে এটি এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয় যে, একই জঠরে ছেলে ও মেয়ে একসাথে জন্ম নেবে। কিন্তু তা হয় না। যদিও দুর্লভ দু-একটি ঘটনা ঘটে যে, একই জঠরে ছেলে ও মেয়ে জমজ জন্মলাভ করেছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

خَلَقْنَا ও جَعَلْنَا ক্রিয়ার শব্দগত লেখার কয়েকদিন সূরা কিয়ামাহ পড়লাম। সেখানে একটি আয়াত যেটা বক্ষমান এ আয়াত ও এ বিষয়টির সমাধান দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, فَجَعَلَ مِنْهُ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالأنْثَى –অর্থাৎ-অতঃপর তা থেকে দুইজোড়া বানিয়েছে Ñপুরুষ ও নারী। [সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ৩৯]। এখানে তা থেকে বলতে উদ্দেশ্য হল, বীর্যের যে শুক্রাণু থেকে তাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে আটকানো অবস্থায় অতঃপর তাকে সুগঠিত করেছেন। অতঃপর পুরুষ ও নারী দুই জোড়া বানিয়েছেন। এক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা সুগঠিতকরণের ক্ষেত্রে বা সূরা কিয়ামাহর ৩৮ নং আয়াতে خَلَقَ ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। কিন্তু পুরুষ ও নারী জোড়া বানানোর ক্ষেত্রে جَعَلَ ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ তায়ালা একটি দেহকে সৃষ্টি করার পর লিঙ্গ পার্থক্যকরণের মাধ্যমে জোড়া জোড়া বানিয়েছেন। সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সূরা নাবা’র এ আয়াত তথা জোড়া জোড়া অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন বলতে উদ্দেশ্য হল, একজন মানুষকে একজোড়া ক্রোমোজম দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, সে পুরুষ হোক অথবা নারী হোক। তাদেরকে পুরুষ ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করার পর জোড়া বানিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সাইয়িদ কুতুব-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন। তার গভীর দৃষ্টির কারণে সুন্দর একটি বিষয় সুস্পষ্ট হল। আলহামদুল্লিাহ।

আল্লাহ একজন মানুষকে একজোড়া ক্রোমোজম দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ক্রোমোজম সংযোগ ক্ষেত্রে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন ছেলে বানান, আর যাকে ইচ্ছা করেন মেয়ে বানান -তিনি যা চান তাই করতে পারেন।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আমরা তোমাদেরকে জোড়া জোড়া ক্রোমোজম দিয়ে সৃষ্টি করেছি, যে জোড়া জোড়া ক্রোমোজমে প্রভেদ থাকার কারণে তোমাদের মধ্যে কেউ পুরুষ আর কেউ নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। অথবা, আমরা তোমাদেরকে নারী ও পুরুষ হিসেবে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি যাতে তোমাদের দ্বারা বংশপরিক্রমা বজায় থাকে।

তাদেরকে সৃষ্টি করার পর তাদের পরিস্থিতির ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। প্রথমে ঘুমের কথা বলেছেন যা মৃত্যুর সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এবং এই ঘুম আবার মানুষের আরাম ও ক্লান্তি দূরীকরণের কারণ হয়। তাই আল্লাহ বলেনঃ

وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا (9)

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। نَوْمَكُمْ = তোমাদের ঘুম। سُبَاتًا = বিচ্ছিন্ন, কর্তিত, শান্তি, স্থির, হালকা ঘুম বা তন্দ্রা।

অর্থঃ আর আমরা তোমাদের ঘুমকে প্রশান্তি বানিয়েছি। [আয়াত ৯]

তাৎপর্যঃ

وَجَعَلْنَا : وَ সংযুক্তি বর্ণ। এটা একটি শব্দকে আরেকটি শব্দের সাথে অথবা একটি বাক্যকে আরেকটি বাক্যের সাথে সংযুক্ত করে দেয়। আর আমরা বানিয়েছি …। এখানে আল্লাহ جَعَلْنَا বলেছেন। আর পূর্বের আয়াতে خَلَقْنَا বলেছেন। আমরা সৃষ্টি করেছি এবং আমরা বানিয়েছি -বাহ্য দৃষ্টিতে এক মনে হলেও এর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। অনেকেই অনেক পার্থক্য বলেছেন। আমি এখানে একটি পার্থক্য উল্লেখ করছি। আমরা সৃষ্টি করেছি বলতে উদ্দেশ্য হল, একটি বস্তুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা, যা আমরা আগেই জেনেছি। আর একটি বস্তুকে অস্তিত্বে আনার পর তার মাঝে বা তার জন্য কিছু নিয়মনীতি ও বিধান রচনা করা হয়। আর তা-ই হল جَعْلٌ বা বানানো। এছাড়াও আরো পার্থক্য রয়েছে।

نَوْمَكُمْ : তোমাদের ঘুম -ঘুম হল এমন একটি অবস্থা যখন দেহ কর্মচঞ্চলতা, অনুভূতি, সজাগতা ও রূহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে সে মৃত অবস্থায়ও থাকে না এবং জীবিত অবস্থায়ও থাকে না। উভয়ের মাঝে অবস্থান করে যাতে দিবাভাগের কাজকর্মের গ্লানী, ক্লান্তি-শ্রান্তি থেকে দেহ মুক্তিলাভ করে এবং পরের দিনের কাজের জন্য দেহ উদ্যমী হয়ে উঠে। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষ জানে না সে জাগ্রত অবস্থায় কেমন থাকে, আবার জাগ্রত অবস্থায় অনুধাবন করতে পারে না সে ঘুমন্ত অবস্থায় কেমন থাকে। এ কাজটি একটি অলৌকিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। এ কাজটি মানবজীবনে এতটাই অত্যবশ্যকীয় যে, যদি কাউকে না ঘুমানোর জন্য বাধ্য করা হয় তাহলে সে নির্ঘাত মারা পড়বে। তাই প্রাত্যহিক কর্মচঞ্চলতা ও ক্লান্তি অনুধাবন থেকে মুক্তিলাভের জন্য ঘুম আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং এটা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ একটি নেয়ামত। ঘুম জীবের জন্য একটি প্রশান্তি। এটা মানুষের দুশ্চিন্তা দূর করে। মনে শক্তি সঞ্চার করে এবং উদ্যমীভাব আনয়ন করে।(সংক্ষেপিত- ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৪-৪৩৫ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৫-পিডিএফ)।)

এখানে ‘তোমাদের ঘুম’ বলে অন্যান্য প্রাণীদেরকে ঘুমপ্রক্রিয়া থেকে বের করা হয়নি। তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু মানবজাতিকে খেতাব করেছেন যাদের কাছে ওহী প্রেরণ করেছেন তাই তাদেরকে লক্ষ্য করে ‘তোমাদের’ উল্লেখ করেছেন যাতে তারা সজাগ দৃষ্টি সম্পন্ন হয়। এখানে ঘুমের কথা উল্লেখ করার আরেকটি কারণ হল, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, আমরা মৃত্যুসদৃশ থাকি। আমরা জানিনা, পরের দিন জাগ্রত হব কিনা। কিন্তু আমরা যেহেতু অচেতন অবস্থা থেকে চেতনায় ফিরে আসি, জাগ্রত হই, আমাদের এই জাগ্রত হওয়া প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবনলাভ অসম্ভব কিছু নয়।

سُبَاتًا : এখানে سُبَاتٌ মানে হালকা ঘুম বা তন্দ্রা অর্থে নেয়া যাবে না। ইমাম রাযী উল্লেখ করেন, কতিপয় নাস্তিক এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, ‘আর আমরা তোমাদের ঘুমকে ঘুম বানিয়েছি’ অর্থ হয়। ঘুমকে কীভাবে ঘুম বানানো হল? তাই এখানে বিচ্ছিন্ন অর্থে আসবে। অর্থাৎ- আমরা তোমাদের ঘুমকে (কর্মচঞ্চলতা থেকে) বিচ্ছিন্ন বানিয়েছি।(তাফসীর রাযী, ৩১/১০।)

তবে আমরা যে অর্থ করেছি, আর আমরা তোমাদের ঘুমকে প্রশান্তি বানিয়েছি, এটা ভাবার্থ যদি দীর্ঘ, লম্বা বা দীর্ঘক্ষণ ব্যাপী গভীর ঘুম উদ্দেশ্য করা হয় তখন সমস্যা নেই। যেমন, سَبَتَتِ الْمَرْأَةُ شَعْرَهَا – মানে মেয়েটি তার চুল ছেড়ে দিল, ফলে তা লম্বা হল, যেমন কেউ যখন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য শয়ন করে তখন সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। আর এই দীর্ঘ ঘুম হল মৃত্যুসদৃশ। তাই আল্লাহ বলেন, وُهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ بِاللَّيْلِ … ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ – অর্থাৎ- তিনিই যিনি তোমাদেরকে রাত্রিবেলা মৃত্যু দেন (বা ঘুম পাড়িয়ে দেন) … অতঃপর তিনি তোমাদেরকে প্রেরণ করেন বা জাগ্রত করেন। [সূরা আনআম, ৬০]। سُبَاتٌ শব্দটি سَبْتٌ থেকে নির্গত হয়েছে, মানে বিচ্ছিন্ন বা কর্তন। যেমন, سَبَتَ الرَّجُلُ شَعْرَهُ -মানে লোকটি তার চুল কর্তন করল। আর এ কারণে শনিবারকে ইহুদীরা ‘সাবত/ সাবাত দিবস’ (ঝধনধঃয উধু) বলে। আরবিতে বলা হয় يَوْمُ السَّبْتِ। কারণ, ইহুদীরা এ দিনে বিশ্রাম নিত, কর্ম থেকে বিরত থাকত। অথবা ‘সাবত’ বলা হয়, কারণ আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিপ্রক্রিয়া রবিবার দিন শুরু করে শুক্রবার দিন শেষ করেছেন। (আর শনিবার দিন কোনো কর্ম ছিল না)। (তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭১, তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫১।)

ভাষা অলংকারঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা অতি উপমা হয়েছে। وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا أَيْ كَالسُّبَاتِ، অর্থাৎ- আমরা তোমাদের ঘুমকে বিচ্ছিন্ন সদৃশ বানিয়েছি।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭-৮, রূহুল মাআনী, ইমাম আলুসী, ৩০/৭। )

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা তোমাদের ঘুমকে কর্মচঞ্চলতা থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে প্রশান্তি বানিয়েছি যাতে তোমরা পরবর্তী দিনের কাজের জন্য উদ্যমী হও, কর্মচঞ্চল হও। অবসাদগ্রস্ত দেহ ক্লান্তি মুক্ত হয়।

وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا (10)

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। اللَّيْلَ = রাতকে। لِبَاسًا = পোশাক, আবরণ, স্থির।

অর্থঃ আর আমরা রাতকে আবরণ বানিয়েছি। [আয়াত ১০]

তাৎপর্যঃ

اللَّيْلَ : রাতকে আল্লাহ অন্ধকার বানিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন,  فَمَحَوْنَا ءَايَةَ اللَّيْلِ-অর্থাৎ- অতঃপর রাতের নিদর্শনকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছি। [সূরা ইসরা, আয়াত ১২]। রাতের নির্দশনকে নিষ্প্রভ করে দেয়ার মানে হল, আলো অপসারণ করে দিয়েছেন। ফলে, বস্তুগুলো আমাদের চোখে আলো নিক্ষেপ করতে পারে না। এ কারণে আমরা দেখি না। এটা করার কারণ হল যাতে আমরা রাতের বেলা প্রশান্তি লাভ করতে পারি। আলো দেহে চঞ্চলতা সৃষ্টি করে, ফলে পরিপূর্ণ প্রশান্তি লাভে ছেদ পড়ে। রাতের বেলা কক্ষে আলো নিভিয়ে ঘুমালে ঘুম যতটা গভীর হয়, আলো জ্বালিয়ে রাখলে ততটা হয় না। তবে অনেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে।

لِبَاسًا : পোশাক বা পর্দা। আলো অপসরাণ করার ফলে বস্তু ও আমাদের দৃষ্টির মাঝে পর্দা পড়ে যায়। মনে হয় যেন এটা আমাদের চোখের পোশাক। একজন মানুষ পোশাক পরিধান করে ঠাণ্ডা ও গরম থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য, এবং নিজের দেহ ঢেকে রাখার জন্য। তেমনি রাতের অন্ধকার মানুষ ও তার কর্মচঞ্চলতার মাঝে পর্দা ফেলে দেয়। দিন হল কাজের জন্য আর রাত হল বিশ্রামের জন্য। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর আন্দোলন বা কাজকর্মকে প্রাণীকুলের আন্দোলনের অধীন করেছেন। প্রাণীরা কখন কাজকর্ম করতে পারবে -সে অনুযায়ী পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। মানুষের মাঝে যেহেতু কর্মচঞ্চলতার পর আরাম-আয়েশ ও প্রশান্তি লাভকে অপরিহার্য করেছেন, তাই পৃথিবীকে রাতের অন্ধকার চাদর দ্বারা আবৃত করার ব্যবস্থা করেছেন যাতে গভীর নিদ্রা সুখকর হয়।(ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৫ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৫-পিডিএফ)।)

ভাষা অলংকারঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা অতি উপমা হয়েছে। মূল বাক্যটি হল, وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِباسًا أَيْ كَاللِّبَاسِ فِي السِّتْرِ অর্থাৎ- আর আমরা রাতকে পর্দার দিক দিয়ে পোশাক সদৃশ বানিয়েছি।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭-৮ )

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা রাতকে তোমাদের দৃষ্টির জন্য বস্তুসামগ্রীর সুমুখে পোশাক-পর্দা বানিয়ে দিয়েছি, যাতে তোমরা প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের নিদ্রা সুখকর হয়।

وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا (11)

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। النَّهَارَ = দিনকে। مَعَاشًا = জীবন, জীবনধারণ, জীবিকা নির্বাহের উপায়।

অর্থঃ আর আমরা দিনকে বানিয়েছি জীবিকা নির্বাহের উপায়। [আয়াত ১১]

তাৎপর্যঃ

جَعَلْنَا : আমরা বানিয়েছি। অর্থাৎ- আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার পর এর কিছু বিধি-বিধান দিয়েছেন। একটা কিছু শুরুতে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে خَلْقٌ -এর ক্রিয়া ব্যবহার হয়। আর তা সৃষ্টি করার পর তাতে যে বিধি-বিধান প্রদান করা হয় সেক্ষেত্রে جَعْلٌ -এর ক্রিয়া ব্যবহার হয়।

النَّهَارَ : দিন – ঝলমলে আলোময় সময় যা দেহে কর্মচঞ্চলতা এনে দেয়।

مَعَاشًا : মীম এখানে مَصْدَرٌ مِيمِيٌّ হয়েছে। জীবনযাপন বা জীবিকা নির্বাহ করা। দিনকে আল্লাহ তায়ালা জীবিকা উপার্জনের সময় বানিয়েছেন যাতে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষবাস, শিল্পসহ নানা কাজ করে প্রাত্যহিক পাথেয় অর্জন করতে পারে। কাজ করার জন্য প্রয়োজন আলো, তাই কাজের সময়ের জন্য দিনকে নির্বাচন করেছেন এবং এ দিনকে আলোময় করেছেন। কাজ করার জন্য যেহেতু দেহে শক্তি ও উদ্যম প্রয়োজন তাই দিনের আগে রাতের ব্যবস্থা করেছেন যাতে বিশ্রাম নিয়ে দিনের বেলা পূর্ণশক্তি ব্যয় করতঃ রুজি-রোজগার উপার্জন করতে পারে। উক্ত আয়াতদ্বয়ে রাতের মোকাবেলায় দিন এবং কাজের মোকাবেলায় প্রশান্তিকে উল্লেখ করেছেন। আর এই যে রাতের পর দিন, দিনের পর রাত আসে -এ ব্যবস্থাপনায় আল্লাহ ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। যদি এমন না হয়ে রাতের সময় নাতিদীর্ঘ হত, অথবা দিনের সময় নাতিদীর্ঘ হত তাহলে মানবজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ত। কিন্তু যাতে এমনটি না হয় তাই এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা সূ² একটি প্রক্রিয়া অস্তিত্ববান রেখেছেন। তবে শীত ও গ্রীষ্মে আমরা যে দিন ও রাত খর্ব ও লম্ব হওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করি তা আপেক্ষিক যা আমাদের প্রাত্যহিক কর্মজীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। আর রাত ও দিনের এই পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নিদর্শন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آَيَتَيْنِ فَمَحَوْنَا آَيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آَيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِتَبْتَغُوا فَضْلًا مِنْ رَبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ

অর্থাৎ- আর আমরা আসমান ও জমিনকে দু’টি নিদর্শন বানিয়েছি। অতঃপর রাতের নিদর্শনকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছি, আর দিনের নিদর্শনকে আমরা দৃশ্যমান করে দিয়েছি। যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুকম্পা অনুসন্ধান করতে পারো এবং বছর ও সংখ্যা গণনা করতে পারো।’ [সূরা ইসরা, আয়াত ১২]

ভাষা অলংকারঃ

وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا  – আর আমরা তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, এবং আর আমরা তোমাদের ঘুমকে প্রশান্তি বানিয়েছি -এ দু’টি আয়াতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মানবজাতিকে খেতাব করা হয়েছে। এটাকে  اَلْاِلْتِفَاتُ إِلَى الْخِطَابِ مِنَ الْغَيْبِ বলা হয়। অর্থাৎ- বর্ণনার ধারা নামপুরুষ থেকে মধ্যমপুরুষে পরিবর্তন করা। আর এটা করা হয় একটা বিষয়কে অত্যাবশ্যকীয়  এবং ধিক্কার জানানোর ক্ষেত্রে আধিক্য বোঝানোর জন্য। এটা তখনই করা হয় যখন বর্ণনার ধারা নাম পুরুষ থেকে মধ্যম পুরুষে অথবা মধ্যম পুরুষ থেকে নাম পুরুষে পরিবর্তন করা হয়। আর এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শুরুতে আল্লাহ মানবজাতিকে নামপুরুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, আর এখানে মধ্যম পুরুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর এটা করার উদ্দেশ্য হল পাঠকের রূচিতে নাব্যতা আনা ও একঘেয়েমী দূর করা।

উপরোক্ত দু’টি আয়াতে মোকাবেলা হয়েছে। আর উক্ত পাঁচ আয়াতের শেষাব্দের শব্দগুলোতে ছন্দ খচিত হয়েছে। যেমন, أَوْتادًا، أَزْواجًا، سُبَاتًا، لِبَاسًا، مَعَاشًا।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৮। )

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা দিনকে সূর্য স্থাপনের মাধ্যমে আলোময় করেছি যাতে তোমরা জীবিত থাকার জন্য জীবিকা অর্জন করতে পার।

৬ থেকে ১১ নং পর্যন্ত আয়াতের সাধারণ মর্মার্থঃ

আমরা তোমাদের জন্য পৃথিবীকে দোলনা সদৃশ বানিয়েছি যাতে তোমরা এর পৃষ্ঠভাগে নিরাপদে বিচরণ করতে পার। এ ভূমি সৃষ্টি করার পর এটা দোলায়মান ছিল। অতঃপর এর গাত্রে পাহাড়কে পেরেক স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছি যাতে এটা স্থির হয় এবং তোমাদেরকে নিয়ে আন্দোলিত না হয়। তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ করে যাতে তোমরা একে অপরের কাছে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা লাভ কর, অথবা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়া জোড়া বীজকোষ দিয়ে। তোমাদের কায়িক প্রশান্তি ও সুখকর নিদ্রার জন্য ঘুমকে দীর্ঘ করেছি, অথবা ঘুমের মাধ্যমে তোমাদেরকে কর্মের চঞ্চলতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি। আর আলো অপসরাণের মাধ্যমে রাতকে তোমাদের দৃষ্টির জন্য বস্তুর সুমুখে পোশাক বানিয়েছি যাতে তোমরা না দেখ এবং বিশ্রাম নিতে পার। আর আলোর মাধ্যমে দিনকে বানিয়েছি ঝলমলে যাতে তোমরা কাজকর্ম করে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যমে জীবনচক্র সচল রাখতে সক্ষম হও। এতসব করার পরও তোমরা ঈমান আনবে না?

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ পৃথিবীকে বাসোপযোগী করার জন্য পাহাড় সংস্থাপনের মাধ্যমে আন্দোলন রহিত করেছেন।

দুইঃ সৃষ্টির নিগূঢ় তত্ত¡ বর্ণিত হয়েছে।

তিনঃ নিরবচ্ছিন্ন ও গভীর ঘুম হওয়ার জন্য অন্ধকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

চারঃ রুজি-রোজগারের জন্য আলোর ব্যবস্থা করেছেন।

আল্লাহ ১২-১৬ আয়াতে আসমানের বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেনঃ

وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا (12) وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا (13) وَأَنزلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجًا (14) لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا (15) وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا (16)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

وَبَنَيْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعًا شِدَادًا (12)

শব্দার্থঃ وَبَنَيْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। فَوْقَكُمْ = তোমাদের উপরে। سَبْعًا = সাত। شِدَادًا = দৃঢ়, মজবুত।

অর্থঃ আর আমরা বানিয়েছি তোমাদের উপর সাতটি সুদৃঢ় স্থাপনা [আকাশ]। [আয়াত ১২]

তাৎপর্যঃ

وَبَنَيْنَا : আর আমরা বানিয়েছি -অন্য সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ جَعَلْنَا বলেছেন, আর এখানে بَنَيْنَا বলেছেন। এর কারণ হল, এ শব্দ ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি উক্ত ভিত্তিকে সুউচ্চে স্থাপন করেছেন। بِنَاءٌ মানে উঁচু ভবন।

فَوْقَكُمْ : তোমাদের মাথার উপর -যা আমাদের সাথে লাগোয়া নয়; বরং উর্ধ্বপানে সন্নিবেশিত। এখানে অবস্থানকে কর্মকারকের আগে উল্লেখ করা হয়েছে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য।

سَبْعًا شِدَادًا : সুদৃঢ় সাতটি ভিত্তি -এখানে সুদৃঢ় সাত বলতে মূলত আল্লাহ কী বুঝিয়েছেন সেটা আল্লাহই ভাল জানে। এটা হতে পারে, সাতটি আকাশকে পৃথিবীর ছাদ স্বরূপ বানিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْنَا السَّمَآءَ سَقْفًا مَّحْفُوظًا, অর্থাৎ- ‘আর আমরা আকাশকে সুরক্ষিত ছাদ বানিয়েছি।’ [সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৩২] । আবার সূরা মু’মিনুনের ১৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে সাতটি রাস্তা। এগুলো উচ্চতা, প্রশস্ততা, দৃঢ়তা ও শক্ত হওয়ার দিক দিয়ে অতিমাত্রায় মজবুত। কালের আবর্তনে এখানে কোনো ফাটল-ভাঙন ধরবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ ইচ্ছা করেন। বলা বাহুল্য যে, আরবরা ঘরের ছাদকে ‘সামা’ বা আকাশ বলত। তাই তাদেরকে তাদের ভাষাতেই খেতাব করে বলছেন যে, পৃথিবীর ছাদ তথা সপ্ত আকাশ অতিশয় দৃঢ়, এর কোনো স্তম্ভ নেই -এগুলো তোমাদের বাড়ির ছাদের মতো ভেঙ্গে পড়বে না; কিন্তু এটা মজবুত হওয়া সত্তে¡ও কিয়ামতের দিন লয় হবে। সপ্ত আকাশ সৃষ্টির মূল রহস্য আল্লাহই ভাল জানেন। আর প্রথম আকাশকে সাজিয়েছেন তারকারাজি দ্বারা। এখানে রয়েছে ছায়াপথ। একটি ছায়াপথে মিলিয়ন মিলিয়ন তারকা রয়েছে। এ সকল ছায়াপথ ও সপ্ত রাস্তা আমাদের পৃথিবী ও সৌরজগতের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। আবার হতে পারে আমাদের এই সৌরজগতের গ্রহসমূহ। অথবা, হতে পারে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন স্তর। তবে অন্যান্য আয়াতে যেহেতু সাত আকাশের কথা এসেছে, সুতরাং সাত আকাশই গ্রহণ করা শ্রেয়।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫২,  ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৫ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৬-পিডিএফ), আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/২৩। )

আর সাতটি আকাশের অস্তিত্ব সম্পর্কে মে‘রাজের বর্ণনায় এসেছে, যেমন এ সূরার ১৯ নং আয়াতে উক্ত হাদিসের বর্ণনা এসেছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা তোমাদের উপরে নির্মাণ করেছি সাতটি সুদৃঢ় স্থাপনা, যা বিশ্বচরাচরের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং পৃথিবীর অস্তিত্ব বহাল রাখে।

وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا (13)

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। سِرَاجًا = বাতি, আলোকবর্তিকা। وَهَّاجًا = দাহক, প্রজ্বালক।

অর্থঃ আর আমরা প্রজ্বালক আলোকবর্তিকা বানিয়েছি। [আয়াত ১৩]

তাৎপর্যঃ

وَجَعَلْنَا : এর তাৎপর্য পূর্বে গত হয়েছে।

سِرَاجًا وَهَّاجًا : سِرَاجًا মানে আলোকবর্তিকা, আলোধারা Ñযেখানে আলোর তীব্রতা রয়েছে, তাপ রয়েছে। আর وَهَّاجًا মানে অতিমাত্রায় আলো ও তাপ রয়েছে। এটা আধিক্য অর্থে বিশেষণ হয়েছে। এখানে এ শব্দ দ্বারা সূর্য উদ্দেশ্য। সুতরাং سِرَاجًا وَهَّاجًا হল সূর্যের একটি সূ² বর্ণনা। সূর্যকে উক্ত শব্দদ্বয় দিয়ে সংজ্ঞায়িত করাটি ইঙ্গিত দেয় যে, সূর্যের নিজস্ব আলো রয়েছে।

এই আলোময় সূর্য পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীকে আলো সরবরাহ করার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এর দ্বারা প্রাণীকুল উপকৃত হয়। আলো না থাকলে মানুষ তার প্রাত্যহিক কাজ কর্ম করতে নানা জটিলতার সম্মুখীন হত। এই সূর্যের তাপের ফলে সাগর, নদীনালা, পুকুরের পানি থেকে বাষ্প তৈরি হয়ে মেঘমালা সৃষ্টি হয়, যে মেঘমালা থেকে পানি বরিষণ ঘটে, আবার মেঘমালায় বজ্র্রপাত হয়, ফলে উক্ত পানিতে নাইট্রিক এসিড উৎপন্ন হয়। আর এ নাইট্রিক এসিড চাষাবাদের জন্য উপকারী এবং অত্যাবশ্যকীয়ও বটে। ফলে নানা ফসল, ফলফলাদি, লতাপাতা, গুল্ম ও গাছগাছালি গজে উঠে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা বানিয়েছি প্রজ্বালক আলোকবর্তিকা যেটা তোমাদের নানা উপকারে আসে।

وَأَنزلْنَا مِنَ الْمُعْصِرَاتِ مَاءً ثَجَّاجًا (14)

শব্দার্থঃ وَ = ও, এবং, আর। أَنْزَلْنَا = আমরা অবতরণ করিয়েছি। مِنَ = থেকে। الْمُعْصِرَاتِ = মেঘ। مَاءً = পানি। ثَجَّاجًا = মুষলধারে।

অর্থঃ আর আমরা মেঘমালা থেকে মুষলধারে পানি বা বৃষ্টি অবতরণ করিয়েছি। [আয়াত ১৪]

তাৎপর্যঃ

وَأَنْزَلْنَا : وَ সংযুক্তি বর্ণ। أَنْزَلْنَا মানে আমরা অবতরণ করিয়েছি। এ শব্দটি ইঙ্গিত দেয়, একটি মেঘে যতটুকু পানি সঞ্চিত হয়, যখন বৃষ্টি হয় তখন সবটুকুই নিঃশেষ হয়ে যায়। এমন নয় যে, কিছু পড়ল আর কিছু পানি মেঘে অবশিষ্ট থাকল, একটু পর আবার পড়ল। তবে আমরা যে দেখি, থেমে থেমে বৃষ্টি হয়, এটা হল, যতটুকু পানি তৈরি হয় তা নিঃশেষ হয়ে যায়। আবার তাতে পানি তৈরি হয়, আবার তা বরিষণের মাধ্যমে নেমে আসে।

الْمُعْصِرَاتِ : শব্দটির মূল অর্থ হল, নিষ্পেষণকারিনী, চেপনকারিনী, আবার আরেক অর্থ, চেপন বিশিষ্ট বা নিষ্পেষণ বিশিষ্ট হল বা নিষ্পেষণ ও চিপার উপযুক্ত হল। কারণ بَابُ إِفْعَالٍ  থেকে এ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এটি একটি বিশেষণের বিশেষ্য। অথবা একটি  উহ্য বিশেষ্যের বিশেষণ। এ ধরণের শব্দের সাথে পৃথক একটি বিশেষ্য যুক্ত হতেও পারে আবার না হতেও পারে। এখানে যুক্ত হলে শব্দটি হবে السَّحَائِبُ أَوْ السُّحُبُ الْمُعْصِرَاتُ মানে নিষ্পেষণকারিনী মেঘমালা। একটি মেঘমালা যখন বারি বর্ষণের নিকটবর্তী হয় তখন তাকে الْمُعْصِرَاتُ বলে। কারণ চিপে চিপে বা নিষ্পেষণ করে জমাট বাঁধা পানিকে ফোঁটায় ফোঁটায় নির্গত করে। এটাকে চিপা বা নিষ্পেষণের কাজ করে বাতাস। সুতরাং বাতাস অর্থেও আসতে পারে। তাহলে এর উদ্দেশ্য হল, বাতাস প্রেরণ করার মাধ্যমে ঘনীভূত মেঘমালায় চাপ সৃষ্টি করতঃ বৃষ্টি বর্ষণ করানো হয়। যেমন আল্লাহ অন্যত্র বলেন, اللَّهُ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا, অর্থাৎ- আল্লাহ তিনি যিনি বায়ুকে প্রেরণ করেছেন, অতঃপর এটা মেঘকে আন্দোলিত করে…। (সূরা ফাতির, আয়াত-৪৮)। এখানে নিষ্পেষণ বা চেপন প্রক্রিয়াটি দু’ভাবে হয়। প্রথমতঃ বাতাস মেঘমালায় চাপ, পেষণ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়তঃ বাতাসের পেষণে মেঘমালা নিজ অঙ্গে পারস্পরিক অঙ্গাঙ্গিতে পেষণ করে, চাপ সৃষ্টি করে। ফলে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি বরিষণ হয়।

এককথায় বলতে গেলে, الْمُعْصِرَاتُ মানে যেটা বৃষ্টিবর্ষণের নিকটবর্তী হয়েছে। ইবনে আব্বাস বলেন, বাতাস। তাঁর সাথে সহমত পোষণ করেছেন কাতাদা, ইকরিমা, মুজাহিদ ও অন্যান্যগণ। কারণ, এই বাতাস মেঘকে ভারী করতঃ এটা থেকে পানি বর্ষণ করে। আবার ইবনে আব্বাস থেকে মেঘ হওয়ার কথাও বর্ণিত আছে।(তাফসীর ইবনে কাসির, ৮/৩০৩।) مِنَ الْمُعْصِرَاتِ শব্দটি ইঙ্গিত দেয়, একটি বাষ্পীয় মেঘ সাথে সাথেই একেবারে নিঃশেষ হয় না। তা নিঃশেষ হতে সময় লাগে।

مَاءً ثَجَّاجًا : مَاءً মানে পানি, বৃষ্টি। আর ثَجَّاجًا মানে প্রচণ্ড, ঢল, মুষলধারে, পর্যায়ক্রমে। এ সংযুক্ত শব্দদ্বয় বৃষ্টি বরিষণের দু’টি পর্যায় বর্ণনা করে। একঃ মুষলধালে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। দুইঃ পর্যায়ক্রমে বৃষ্টি হয়। পর্যায়ক্রম বলতে মুষলধারেও বোঝায় এবং টিপ টিপ করে ঝিরঝিরে বৃষ্টিও বোঝায়।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা মেঘ থেকে মুষলধারে প্রচণ্ড বৃষ্টি বরিষণ করি, অথবা পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি বরিষণ করি।

যেজন্য বৃষ্টি বরিষণ হয় সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ

لِنُخْرِجَ بِهِ حَبًّا وَنَبَاتًا (15)

শব্দার্থঃ لِنُخْرِجَ = যাতে আমরা নির্গত করি। بِهِ = এর দ্বারা। حَبًّا = দানা বা শস্য। نَبَاتًا = উদ্ভিদ।

অর্থঃ যাতে আমরা এর দ্বারা দানা ও উদ্ভিদ নির্গত করি। [আয়াত ১৫]

তাৎপর্যঃ

لِنُخْرِجَ : لِـ যাতে -এখানে কারণ বোঝাতে এসেছে। لِنُخْرِجَ ক্রিয়াটি بَابُ إِفْعَالٍ থেকে এসেছে। মানে, আমরা বের করি তথা একটি মৃত দানা থেকে একটি উদ্ভিদ গজানোর মাধ্যমে উক্ত উদ্ভিদের ডালে অথবা ডাঁটায় শস্য জন্মাই। এ শব্দটি ইঙ্গিত দেয়, পরকালে তোমাদেরকে পুনরায় জীবনদান একটি সহজ কাজ।

بِهِ : এর দ্বারা বা বৃষ্টির দ্বারা।

حَبًّا وَنَبَاتًا : শস্য ও উদ্ভিদ -মানে আমরা বৃষ্টির পানি দ্বারা শস্য ও উদ্ভিদ জন্মাই। বলা বাহুল্য যে, মাটিকে উর্বর ও  আবাদ করতঃ ফসল ফলানোর জন্য বৃষ্টির ভূমিকা অপরিসীম। কারণ, বৃষ্টিতে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ আছে যা মাটিকে উর্বর করে এবং ফসল উৎপাদনে সহযোগিতা করে। স্মর্তব্য যে, আমরা এ সকল রাসায়নিক পদার্থ সেঁচের পানিতে পেতে পারি না। যেমন, নাইট্রোজেন, জিংক, ম্যাংগানিজ, কপার, কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রিক এসিড, আয়রনসহ ইত্যাদি। পরন্তু বৃষ্টির পানি উদ্ভিদের মূলকে পরিস্কার করে এবং মাটির উপরিভাগের ময়লা আবর্জনা অপসারণ করে। ফলে, উদ্ভিদ সুন্দরভাবে বেড়ে উঠে এবং ফলন ভাল হয়। বাতাসের প্রত্যেক দমকা ৭৮% নাইট্রোজেন ধারণ করে। নাইট্রোজেন ও মাটি উভয়ের মিথষ্ক্রিয়া ছাড়া কোনো পুষ্টিকর উদ্ভিদ বেড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং চাষাবাদের জন্য বৃষ্টি অপরিহার্য।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা মেঘ থেকে বৃষ্টি বরিষণের মাধ্যমে জমি থেকে নানা শস্য, দানা ও উদ্ভিদ নির্গত করি। যেমন, ধান, গম, যব, ভূট্টা, গাছগাছালি ইত্যাদি।

وَجَنَّاتٍ أَلْفَافًا (16)

শব্দার্থঃ وَ = ও, এবং, আর। جَنَّاتٍ = বাগানসমূহ। أَلْفَافًا = ঘন অরণ্য।

অর্থঃ এবং ঘন অরণ্যময় বাগানসমূহ। [আয়াত ১৬]

তাৎপর্যঃ

جَنَّاتٍ : শব্দটি বহুবচন। মানে বাগানসমূহ। এর একবচন হল جَنَّةٌ। অর্থাৎ- এ বৃষ্টির মাধ্যমে নানা ধরনের গাছগাছালির বাগান জন্মে।

أَلْفَافًا : এটা اِسْمُ جَمْعٍ বা বহুবচন বিশেষ্য, এর একবচন নেই। যেমনأَوْزَاعٌ । আবার বলা হয় এর একবচন হল لَفِيفٌ। যেমন  شَرِيفٌ এর বহুবচন  أَشْرَافٌ। আবার বলা হয় এটা বহুবচনের বহুবচন। যেমন لَفٌّ ولَفَّاءٌ এর বহুবচন لُفٌّ  এবং এর বহুবচনأَلْفَافٌ । মানে, ঘণ পত্রপল্লব বিজড়িত, অরণ্যময়। যেমন বিশাল বিশাল বনভূমি দেখা যায় যা মানুষের সৃষ্টি নয়। এমনিতেই প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্টি হয়েছে।

এ আয়াতের তিনটি ব্যাখ্যা রয়েছে। ইকরিমা বলেন, এর উদ্দেশ্য হল, পাশাপাশি নানা চাষাবাদের সমষ্টি। ইবনে সুদ্দি বলেন, প্রচুর ফলসমৃদ্ধ গাছ। কালবী বলেন, রঙবেরঙের উদ্ভিদ। আবার চতুর্থ একটি সম্ভাবনা রয়েছে, তা হল, মাটির বুকে বেয়ে চলা উদ্ভিদ এবং উঁচু উঁচু গাছগাছালি।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৪-১৮৫। )

ভাষা অলংকারঃ

উক্ত আয়াতের শেষাব্দের শব্দগুলোতে ছন্দ খচিত হয়েছে। যেমন, شِدادًا، وَهَّاجًا، ثَجَّاجًا، نَبَاتًا، أَلْفافًا।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৮। )

তাৎপর্যগত অর্থঃ

অর্থাৎ- আর আমরা বৃষ্টির পানি দ্বারা পত্রপল্লব বিজড়িত ঘন অরণ্যময় বাগানসমূহ জন্মাই।

৬ থেকে ১৬ পর্যন্ত আয়াতের সাধারণ মর্মার্থঃ

এখানে একটি প্রশ্ন হল, প্রথম পাঁচ আয়াতের সাথে পরবর্তী ছয় থেকে ষোল আয়াত পর্যন্ত বিষয়ের সাথে তথ্যের দিক দিয়ে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তাহলে নিম্নবর্তী আয়াতগুলো উপরের আয়াতের সাথে সংযুক্ত করে কীভাবে বর্ণনা করলেন? ইমাম যমখশরী বলেন, ‘তারা যেহেতু পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছে তাই তাদেরকে বলা হল, যার প্রতি পুনরুত্থানের বিষয়টি সম্পৃক্ত করা হয়েছে তিনিই কি এসকল আশ্চর্যময় বস্তু সৃষ্টি করেননি যা তাঁর পরিপূর্ণ শক্তির পরিচয় বহন করে? তাহলে তাঁর কর্তৃক পরকাল সংঘটনের শক্তিকে অস্বীকার করার হেতু কী? সেটাও এসব সৃষ্টির মতোই একটি সৃষ্টি বা আবিষ্কার।’(তাফসীর কাশশাফ, ইমাম যমখশরী, ৪/ ৬৮৫। )

পরন্তু, এখানে একটি ইঙ্গিত রয়েছে যে, তোমাদের কি জন্মের পূর্বে এসব সম্পর্কে ধারণা ছিল? অবশ্যই না। এ ধরায় আগমনের পর তোমরা এসব পর্যবেক্ষণ করছ। তোমাদের সৃষ্টির পর একটি জগৎ অবলোকন করছ, তাহলে মৃত্যুর পর যে আরেকটি জগৎ অবলোকন করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আল্লাহ এখানে জ্ঞাতব্য বিষয় দ্বারা একটি অজ্ঞাত বিষয়ের প্রতি প্রমাণ উপস্থাপন করছেন। আর এটা হল তর্কের ক্ষেত্রে প্রমাণ উপস্থাপনের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।

বর্ণনার ধারাবাহিকতাঃ

পৃথিবীর কথা বর্ণনা করার পর আল্লাহ আসমানের কথা বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত ৬ থেকে ১১ পর্যন্ত আয়াত বর্ণনায় একটি ধারাবাহিকতা রয়েছে। প্রথমে জমিনকে বিছানা বানিয়েছেন, এটাকে সুদৃঢ় করেছেন, বংশবিস্তারের জন্য নারী-পুরুষ সৃষ্টি করেছেন, কাজ করার জন্য যেহেতু শক্তি দরকার এবং শক্তি সঞ্চয়ের জন্য বিশ্রাম দরকার তাই ঘুমের ব্যবস্থা করেছেন, আর ঘুম সুখকর হওয়ার জন্য অন্ধকার প্রয়োজন, তাই রাতের ব্যবস্থা করেছেন, দেহে শক্তি সঞ্চারিত হওয়ার পর কাজ করার জন্য যেহেতু আলো দরকার, তাই দিনের ব্যবস্থা করেছেন। আবার দিন ও রাত্রীর মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। যদি কোনোটিকে অতিমাত্রায় দীর্ঘ করতেন তাহলে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হত।

পৃথিবীর বিষয় বর্ণনা করার পর আসমানের কথা বর্ণনা করেছেন। আসমান হল পৃথিবীর ছাদ স্বরূপ। এটাকে সুদৃঢ় করেছেন যাতে ভেঙে না পড়ে। পৃথিবীকে আলোময় করার জন্য উপরিভাগ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ প্রয়োজন, তাই সূর্য সৃষ্টি করেছেন। জমিতে চাষবাস উত্তম হওয়া ও সবুজায়ন হওয়ার জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন। বৃষ্টির জন্য মেঘ, মেঘের জন্য বাষ্পের প্রয়োজন। তাই সূর্যে তাপ দিয়েছেন যাতে পানি থেকে বাষ্প তৈরি করে বৃষ্টির কাজে সাহায্য করে। এখানে আল্লাহ তায়ালার ইঙ্গিত হল, এতসব কিছু পর্যবেক্ষণ করার পরও কেন তোমরা পরকালকে অস্বীকার করছ? এসব সৃষ্টি প্রমাণ করে, এসবের এক ¯্রষ্টা রয়েছেন এবং এসবের পশ্চাতে একটি পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলা বিদ্যমান আছে।

সৃষ্টি সংক্রান্ত প্রায় পাঁচশতের মতো আয়াত আছে। এসব আয়াতাবলী উল্লেখ করার মূল কারণ কী? এর মূল কারণ হল, এসব নিয়ে গবেষণা করে আল্লাহর অস্তিত্ব ও পরকালের সত্যতা সম্পর্কে সত্যদ্রষ্টা লাভ করা। প্রাক ইসলামের ধর্মগুলোতে এ রকম গবেষণা ও চিন্তার বিষয়ে বলা হয়নি। তাদের কাছে কোনো নবী প্রেরিত হলে তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনত না তারা মো‘জেযা দেখতে চাইত, আর এক্ষেত্রে তারা শাস্তি কামনা করত। শাস্তি কামনা করার একটা যৌক্তিক কারণ ছিল। কারণ, ঈমান না আনলে পরকালে শাস্তির ব্যাপারে নবীগণ সতর্ক করতেন। তবে তারা স্বাচ্ছন্দ্যের কথা জিজ্ঞাসা করত না। কারণ, যারা প্রশ্ন করত তারা ছিল সমাজের নামীদামী, সম্ভ্রান্ত ও ধনী সম্প্রদায়ের লোক। তারা এমনিতেই আরাম-আয়েশ ও স্বাচ্ছন্দ্যে নিমজ্জিত থাকত। উক্ত ধর্মসমূহ ও আমাদের ইসলাম ধর্মের মাঝে পার্থক্য আছে। পূর্ববতী ধর্মসমূহে মো‘জেযা ছিল নবীদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। আর ধর্মীয় গ্রন্থ ছিল জীবনবিধান। আর আমাদের ইসলাম ধর্মের কোরআন হল মো‘জেযা ও জীবনপদ্ধতি। তবে আমাদের নবীরও অনেক মো‘জেযা ছিল, কিন্তু আমাদের নবীর মো‘জেযা পূর্ববতী নবীদের মো‘জেযার মতো ছিল না। পূর্ববর্তী লোকেরা ঈমান না আনলে নবীকে শাস্তির মো‘জেযা প্রদর্শনের কথা বলত, ফলে তারা বিভিন্ন শাস্তির প্রকোপে স্বমূলে নির্বংশ হত। কিন্তু আমাদের ধর্মে কাফেররা কোনো প্রশ্ন করলে তাদেরকে প্রকৃতি বিজ্ঞান বা প্রাকৃতিক জগৎ নিয়ে গবেষণা করতে বলেছেন। অর্থাৎ- তোমরা এসব নিয়ে গবেষণা কর, আমার (আল্লাহ) অস্তিত্ব ও পরকালের সত্যতা পেয়ে যাবে। পূর্ববর্তী ধর্মের মো‘জেযা যেহেতু নবীদের সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তাই তারা যখন মৃত্যুবরণ করতেন, মো‘জেযা শেষ হয়ে যেত এবং পরবর্তীতে তাদের উম্মতেরা ধর্মীয় গ্রন্থে রদবদল করতে সক্ষম হত। কিন্তু আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থই হল স্বয়ং মো‘জেযা ও জীবনপদ্ধতি, তাই কেউ এ গ্রন্থে রদবদল করতে সক্ষম নয়। কারণ, মো‘জেযা হল আল্লাহর কারিশমা। এটাকে কেউ অনুলিপি করতে সক্ষম নয়। কিন্তু মো‘জেযা শেষ হয়ে গেলে মূল বৈশিষ্ট্যই শেষ হয়ে গেল। তখন তাতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা সহজ। সুতরাং কোরআন শরীফ মো‘জেযা ও জীবনপদ্ধতি হওয়া প্রমাণ করে, ইসলাম ধর্ম জ্ঞানের ধর্ম এবং এ গ্রন্থ কিয়ামত অবধি অপরিবর্তিত থাকবে; কেউ এতে চুলচেরা পরিবর্তন করতে পারবে না।

যে কারণে আল্লাহ অদৃশ্যঃ

এখানে একটি প্রশ্নের অবতারণা ঘটে। এতসব ঝামেলা না করে আল্লাহ নিজের অস্তিত্বকে একটু দেখিয়ে দিলেই তো পারতেন। সবাই ঈমান আনত। কিন্তু করলেন না কেন?

উত্তরে বলতে হয়, প্রথমতঃ ঈমান মানে হল অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। আর যদি তিনি নিজের জাতকে দেখাতেন তাহলে সেটা হত প্রত্যক্ষ দর্শনে বিশ্বাস স্থাপন। কিন্তু আল্লাহ চান লোকেরা তাকে না দেখে বিশ্বাস স্থাপন করুক। নবীর কথা সত্য বলে গ্রহণ করুক। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর জাতকে দেখার জন্য আমাদের নেত্রযুগল সক্ষম নয়। কারণ, তাঁর জাত নুরের তাজাল্লি দিয়ে ঘেরা। আমরা সাধারণ সূর্যের আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে ঘরের ভেতর দৃষ্টিপাত করলে কিছু দেখি না। সব অন্ধকার দেখি। তাহলে এই স্বল্প শক্তিসম্পন্ন চক্ষু দিয়ে আল্লাহর জাতকে কীভাবে দেখব? আর এর জ্বলন্ত উদাহরণ তো মূসা আ. নিজেই। তিনি যখন আল্লাহকে দেখতে চাইলেন, আল্লাহ তাকে বলেছিলেন, قَالَ لَنْ تَرَانِي وَلَكِنِ انْظُرْ إِلَى الْجَبَلِ فَإِنِ اسْتَقَرَّ مَكَانَهُ فَسَوْفَ تَرَانِي فَلَمَّا تَجَلَّى رَبُّهُ لِلْجَبَلِ جَعَلَهُ دَكًّا وَخَرَّ مُوسَى صَعِقًا –অর্থাৎ- ‘তুমি আমাকে কক্ষনো দেখতে পারবে না। বরং তুমি পাহাড়ের দিকে তাকাও, যদি এটা তার স্থানে স্থির থাকে তাহলে তুমি আমাকে দেখতে পারবে। অতঃপর যখন তার রব তার জন্য পাহাড়ে উদ্ভাসিত হলেন, এটা তাকে চূর্ণ করে ফেলল, আর মূসা মুর্ছা গেলেন।’ [সূরা-আ‘রাফ, আয়াত-১৪৩]  এখানে আল্লাহ শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন যদি পাহাড় স্থির থাকে, কিন্তু পাহাড় স্থির ছিল না। আর মূসা মুর্ছা গেলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে বলেননি যে, তুমি মুর্ছা যাবে। তোমার দৃষ্টি ক্ষীণ। কারণ এটা বললে তিনি হয়ত তার অপারগতার ব্যাপারে সন্দেহে নিপতিত হতেন। কিন্তু পরকালে মু’মিনগণ আল্লাহকে দেখতে পারবেন, কারণ, আল্লাহ নিজে তাঁর জাত আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করাবেন। হয়ত আমাদের চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে দেবেন, অথবা তাঁর নিজের তাজাল্লি যেন আমাদের দৃষ্টি ধাঁধিয়ে না দেয় সে ব্যবস্থা করবেন। এটা পরকালের কথা। প্রকৃতপক্ষে, এটা কীভাবে হবে সে ব্যাপারে তিনিই ভাল জানেন। আর এ দেখানোটা হবে দুনিয়াতে তাঁর প্রতি অদৃশ্য দর্শনে ঈমান আনার প্রতিদান স্বরূপ। বলা বাহুল্য যে, কাফেররা পরকালেও আল্লাহকে দেখতে পাবে না। কারণ, তারা দুনিয়াতে আল্লাহর বাণীর প্রতি বিশ্বাস করেনি।। তৃতীয়তঃ যদি তিনি দুনিয়ায় দেখা দিতেন তাহলে সব যুগের লোকেরা তাঁর দর্শন করতে আগ্রহ পোষণ করত, অন্যথা ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানাত। আর এভাবে একটি বিশৃঙ্খলা দেখা দিত। তবে তিনি এটা করতেন যদি আমাদের ঈমান আনলে তাঁর লাভ হত। কিন্তু তাঁর লাভ নেই, যা লাভ সে তো আমাদেরই।

উপরোক্ত নয়টি বিষয়ে আল্লাহর ¯্রষ্টাত্ব রয়েছে। নয়টি বিষয় হল, জমিন বিছানা স্বরূপ, পাহাড় পেরেক স্বরূপ, জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি, প্রশান্তিদায়ক ঘুম, রাত পোশাক স্বরূপ, জীবিকার জন্য দিন, সুদৃঢ় সপ্ত আকাশ, দীপ্তিমান সূর্য ও মেঘ থেকে বৃষ্টি বরিষণ এবং এখানে কাজ ও উপভোগ রয়েছে। আর এসবের অন্তরালে রয়েছে হিসেব-নিকেশ ও প্রতিদান। তাই আল্লাহ নি¤œবর্তী আয়াতে কিয়ামত দিবসের বৈশিষ্ট্য, নিদর্শন ও শাস্তির ধরন বর্ণনা করেছেন।

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ আল্লাহ তায়ালার এসব সৃষ্টি প্রমাণ করে তিনি পরকালেও আরেকটি জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং করবেনও।

দুইঃ পরকাল, প্রতিদান, নবুওয়ত, কোরআন, একত্ববাদ -এসবই সত্য। কিন্তু কেউ এটাকে স্বীকার করবে আবার কেউ স্বীকার করবে না।

তিনঃ মৃত্যুর পরই এসবের সত্যতার ব্যাপারে চাক্ষুষ প্রমাণ মিলবে।(আইসারুত তাফাসীর লি-আবি বকর আল-জাযায়েরী, ৫/৫০২।)

পরকাল ও বিচার দিবস সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا (17) يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا (18) وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا (19) وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا (20) إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21) لِلطَّاغِينَ مَآَبًا (22) لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا (23) لَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا (24) إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا (25) جَزَاءً وِفَاقًا (26) إِنَّهُمْ كَانُوا لَا يَرْجُونَ حِسَابًا (27) وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا كِذَّابًا (28) وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ كِتَابًا (29) فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا (30)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا (17)

শব্দার্থঃ إِنَّ = নিশ্চয়। يَوْمَ = দিন। الْفَصْلِ = বিচ্ছেদ, বিচার। كَانَ = ছিল। مِيقَاتًا = নির্দিষ্ট, নির্ধারিত সময়।

অর্থঃ নিশ্চয় বিচার দিবসের দিন হল নির্দিষ্ট। [আয়াত ১৭]

তাৎপর্যঃ

إِنَّ : নিশ্চয়। এ শব্দটি সন্দেহ অপসারণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

يَوْمَ الْفَصْلِ : পৃথক করার দিন, বিচার দিবস -উদ্দেশ্য হল, কিয়ামতের দিন। এ দিনটি হল একত্র হওয়া ও পাপ-পুণ্যের হিসাবের জন্য নির্ধারিত। এ দিন আল্লাহ তার বান্দাদের মাঝে ফায়সালা করবেন। সত্য ও মিথ্যা, নেককার ও বদকারের মাঝে ফায়সালা করবেন। কবর থেকে সবাই উঠে আসবে এবং তাদের কর্মফল গ্রহণ করবে।

كَانَ مِيقَاتًا : নির্দিষ্ট সময় তথা এ দিনটির জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় রয়েছে। এ দিনটি কবে সংঘটিত হবে তা আল্লাহর কাছেই নির্ধারিত। ইমাম কুরতুবী বলেন, ‘এই আয়াতটি প্রমাণ করে, মুশরিকরা পরকাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিল। তাই আল্লাহ তাদের হুশিয়ারী করে বলেন, কক্ষনো না, তারা শীঘ্রই জানবে, অর্থাৎ- মুহাম্মাদ স. যে কোরআন নিয়ে এসেছেন এবং তাদেরকে পরকালের ব্যাপারে যা বলেছেন, এর সত্যতা তারা শীঘ্রই জানবে।’(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭০।)

কিয়ামত দিবসের জন্য সময়কাল নির্ধারিত। কেউ আগে যাচনা করলেই তা প্রকাশ পাবে, এমন নয়। এÑদিন পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগত সকল মানবকুল, জিনজাতিসহ সকল প্রাণীকে উত্তোলন করা হবে। এ দিবসটি নির্দিষ্ট একটি সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে। হিসেব-নিকেশে একটু সময় বেশিও লাগবে না এবং কমও লাগবে না। বিচার শেষে, একদল জান্নাতে যাবে, আরেক দল জাহান্নামে যাবে।

এখানে হিসাব সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়, যেমন জনৈক ব্যক্তি আলী রাযিঃ এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কীভাবে একই সময়ে একই সাথে হিসাব নেবেন? তিনি বললেন, যেভাবে তিনি সবাইকে একই সাথে রিযিক দেন।(তাফসীর রাযী, ১৯/৫।) অর্থাৎ- বিচার পদ্ধতিটি হবে একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। ব্যক্তিকে তার আমলনামা দেয়া হবে এবং সাথে তার আমলের ফলাফলও সংযুক্ত থাকবে। যেমন বুথে গিয়ে কার্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে কত টাকা উঠাবে, কত টাকা অবশিষ্ট থাকবে তা জানতে পারে। এ জন্য দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ে না।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

বিচার দিবসের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। এটা তার সময়মতোই এসে দেখা দেবে। এটা একটি অদৃশ্যের বিষয়। এটা জানার কোনো মাধ্যম নেই।

يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا (18)

শব্দার্থঃ يَوْمَ = দিন, যে সময়, বা যেদিন। يُنْفَخُ = ফুঁৎকার দেয়া হবে। فِي = মধ্যে। الصُّورِ = শিঙা। فَـ = অতঃপর। تَأْتُونَ= তোমরা আসবে। أَفْوَاجًا [বহুবচন, এর একবচন হল فَوْجٌ]= দলে দলে।

অর্থঃ যেদিন শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে, অতঃপর তোমরা দলে দলে আসবে। [আয়াত ১৮]

তাৎপর্যঃ

يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ : যেদিন শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে –অর্থাৎ- যেদিন ইসরাফিল শিঙায় ফুঁৎকার দেবেন তোমরা তা শুনে দলে দলে বিচার স্থলের দিকে আসবে। কে ফুঁৎকার দেবেন -সে কথা এ আয়াতে বলা হয় নি। কারণ, এখানে ফুঁৎকার ক্রিয়া সংঘটিত হওয়াটিই মূল লক্ষ্য। কে দেবেন সেটা মূল লক্ষ্য নয়। স্মর্তব্য যে, শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে দুইবার। প্রথম বারে সবকিছু লয় হয়ে যাবে, এবং দ্বিতীয় বারে সবকিছু পুনরুজ্জীবিত হবে। আর এখানে দ্বিতীয়বার ফুঁৎকারের কথা বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ (68)

অর্থাৎ- আর শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে, আসমানে যারা আছে এবং জমিনে যারা আছে -সব অচেতন হয়ে যাবে; কিন্তু যাকে আল্লাহ চান সে ব্যতীত। অতঃপর তাতে আবার ফুঁৎকার দেয়া হবে, অতঃপর তারা দণ্ডায়মান হবে, অবলোকন করবে। [সূরা যুমার, আয়াত-৬৮]( তাফসীর ওয়াসীত – ড. মুহাম্মাদ সাইয়িদ আল-তানতাভী, ১৫/২৬৫।)

আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘দুই ফুঁৎকারের মাঝে চল্লিশ।’ তারা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু হুরায়রা! চল্লিশ দিন? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। তারা বললেন, চল্লিশ বছর? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। তারা বললেন, চল্লিশ মাস? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। মানুষের সকল অঙ্গই লয় হয়ে যাবে; একমাত্র মেরুদণ্ডের নিম্নাংশে অবস্থিত পুচ্ছাস্থি (পড়পপুী ড়ৎ ঃধরষনড়হব) ছাড়া, এখান থেকেই দ্বিতীয় সৃষ্টিকে গঠন করা হবে।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৫৩৬, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪১-২৯৫৫।)

অর্থাৎ- হাদিসে উল্লেখ আছে চল্লিশ সংখ্যার কথা। এটা কি বছর নাকি দিন নাকি মাস -এ ব্যাপারে লোকেরা আবু হুরায়রাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তা জানার কথা অস্বীকার করলেন। অর্থাৎ-তিনি জানেন না যে এ সংখ্যার দ্বারা কোনটি উদ্দেশ্য। আর পুচ্ছাস্থি হল, মানব মেরুদণ্ডেরর নিম্নাংশে অবস্থিত ক্ষুদ্র একটি হাড় যেটা কক্ষনো লয় হবে না, অথচ অন্য সকল কিছুই লয় হয়ে যাবে। এটা একটি বীজসদৃশ, যেটা থেকে একজন মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে, যেমন মৃত শস্য থেকে উদ্ভিদ গজায়, আবার তাতে দানা আসে।

আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত শুরু করবেন একটি মহা-নিনাদের মাধ্যমে। যেটার শব্দ শোনামাত্রই সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হবে -সে ঘুমে থাক অথবা জাগ্রত থাক। দৃশ্যমান বিপদের চেয়ে শ্রবণশীল বিপদ মারাত্মক পর্যায়ের। কর্ণ সব দিক থেকেই শুনতে পায়, পক্ষান্তরে, চোখের বেলায় এমন নয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে, চোখের চেয়ে কান বেশি সংবেদনশীল এবং এর পরিধি ব্যাপক। পক্ষান্তরে, দৃশ্যমানের চেয়ে শ্রবণযোগ্য শাস্তির পরিধিও ব্যাপক। এজন্যই আমাদের কানে চোখের মতো পর্দা দেয়া হয়নি। আর বড় কোনো শাস্তিই হয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এতে বিকট শব্দ হয়। এখন যদি চোখের মত কানেরও ঢাকনা সদৃশ পর্দা দেয়া হত এবং ঘুমানোর সময় তা বন্ধ হয়ে যেত, অতঃপর ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর আমরা না খোলা পর্যন্ত তা না খুলত, তাহলে কোনো বিস্ফোরণের শব্দ আমরা শুনতে পেতাম না। নানামূখী বিপদে নিপতিত হতাম। একজন মানুষ ঘুমালে সাথে সাথে তার প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঘুমিয়ে পড়ে একমাত্র কান ছাড়া। একজন ব্যক্তি ঘুমানোর পর তার চিন্তাশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়ে যায়। বাকি থাকে কেবল শ্রবণশক্তি। বলা বাহুল্য যে, আমাদের ঘুম ভাঙে তিনভাবে। ঘুম পূর্ণ হওয়ার দ্বারা, কোনো শব্দ শোনার দ্বারা, অথবা দেহে নাড়াচাড়া খাওয়ার দ্বারা। আর শোনার বিষয়টি হল বেশি সংবেদনশীল। চিন্তাশক্তি ঘুমিয়ে পড়ার কারণে আমরা ক্ষীণ শব্দে জাগ্রত হই না। তবে যদি শব্দের মাত্রা বেশি হলে কানের মাধ্যমে মস্তিষ্ক জাগ্রত হয় এবং চিন্তাশক্তি ফিরে পায়। তাই, যদি এতে ঢাকনা থাকত তাহলে কখন কোন দিক থেকে কোন বিপদ আসত তা বুঝতে পারতাম না। ফলে, আমরা সমূহ বিপদের মধ্যে নিপতিত হতাম। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আমাদের কানে পর্দা না দিয়ে আমাদের প্রতি বিশাল অনুকম্পা করেছেন যাতে আমরা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারি।

فَتَأْتُونَ : فَاء মানে অতঃপর। এটা সংযুক্তি বর্ণ, পর্যায়ক্রমিক ধারা বর্ণনা করতে এসেছে। অতঃপর তোমরা আসবে – অর্থাৎ- পায়ে হেঁটে হেঁটে আসবে। تَأْتُونَ ক্রিয়ার ক্রিয়ামূল হল اِتْيَانٌ। মানে নিকটবর্তী স্থান থেকে আসা এবং যে আসাতে তেমন কষ্ট নেই। তাহলে এর দ্বারা এটা বোধগম্য হয় যে, যে যেখানেই থাক তথা যার কবর বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, কিয়ামতের ময়দানে তাকে পৌঁছতে তেমন শারীরিক কষ্ট করতে হবে না। প্রত্যেকের কবরকে কিয়ামতের ময়দানের নিকটবর্তী করা হবে।

أَفْوَاجًا : বা দলে দলে বোঝাতে যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের লোক একসাথে থাকে। তখন মু’মিন-মুশরিক ও নেককার- বদকার সকলে একসাথে দলে দলে যাবে।(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৩১।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

অতঃপর যখন শিঙায় দ্বিতীয় ফুঁৎকার দেয়া হবে তখন সকলে জাগ্রত হয়ে কবর থেকে উঠে দলে দলে কিয়ামতের ময়দানের দিকে গমন করবে।

وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا (19)

শব্দার্থঃ فُتِحَتْ = খুলে দেয়া হবে। السَّمَاءُ = আসমান। فَـ = অতঃপর। كَانَتْ = হবে, মূল অর্থ হল, ছিল। أَبْوَابًا = দরজা বা দরজা দরজা।

অর্থঃ এবং আসমানকে খুলে দেয়া হবে অতঃপর এটা দরজা দরজা হবে। [আয়াত ১৯]

তাৎপর্যঃ

فُتِحَتْ : খুলে দেয়া হবে। তবে এর মূল অর্থ হল, খোলা হয়েছে। এ কাজটি ভবিষ্যতে হবে। কিন্তু অতীতের ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে এটা বোঝাতে যে, এ কাজটি সংঘটিত হতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া, জ্ঞানের দিক দিয়ে আল্লাহর কাছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই।

السَّمَاءُ : আকাশ; সামা’ শব্দটির অর্থ ব্যাপক। উপরে যা কিছু আছে এবং আপনাকে ছায়া দেয় তাই আকাশ। যেমন ধরুন, আপনি ছাতার নিচে আছেন, সেটাও আপনার জন্য একটি আকাশ। ঘরের ছাদ আকাশ। মেঘমালা আকাশ। এক কথায় যা কিছু অন্য কোনো কিছুকে সংরক্ষণে কাজ করে সেটাই আকাশ। সে দৃষ্টিকোণ থেকে, বায়ুর যে স্তর রয়েছে সেসবও আকাশ বলে পরিগণিত হবে। কিন্তু এখানে আকাশ বলে উদ্দেশ্য হল শতশত আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত যে তারকারাজি রয়েছে, তারও উর্ধ্বে চারদিকে ঘিরে যে বেষ্টনী রয়েছে সেটাই হল আকাশ। এখানে আকাশ বলতে এটাই উদ্দেশ্য। তবে কোথাও কোথাও আকাশ বলতে মেঘমালা বা বৃষ্টি বরিষণও বোঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,  يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا-অর্থাৎ- তিনি তোমাদের উপর আকাশকে প্রেরণ করেন নিরবচ্ছিন্নভাবে তথা লাগাতার বৃষ্টি বর্ষণ করেন। [সূরা নূহ, আয়াত ১১]। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আকাশের কোনো সন্ধান খুঁজে পায় না, তাই বলে, আকাশ মানে শূন্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটা তাদের ভুল ধারণা। কারণ, তারা অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তারকারাজিরই সংবাদ আহরণ করতে পারেন নি, তাহলে তারা কীভাবে আকাশের সংবাদ নিয়ে আসবেন? আকাশ হল পার্থিব জগতের রক্ষাকবচ। এটা এর অভ্যন্তরে এ সৌরজগৎ, মিল্কিওয়েসহ অন্যান্য গ্যালাক্সিগুলোকে ধারণ করে আছে। এসব আলোময় তারকারাজি দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আকাশকে সুশোভিত করেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَحِفْظًا –অর্থাৎ- আর আমরা পৃথিবীর আসমানকে সুসজ্জিত করেছি তারকা দ্বারা এবং এটাকে সুরক্ষিত করেছি। [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ১২]

আকাশ বলতে মূল উদ্দেশ্যঃ

আমাদের এ সৌরজগৎ ও অন্যান্য সৌরজগতসহ যত ছায়াপথ আছে সবগুলোকে ঘিরে আছে প্রথম আকাশ। অতঃপর দ্বিতীয় আকাশ। সৌরজগতের যেকোনো গ্রহে যেতে অতিশয় শক্তির অধিকারী হলেই গমন করা যায়। যেমন নাসাসহ অন্যান্য মানমিনারগুলো তাদের স্পেইসশিপ প্রেরণ করছে বিভিন্ন গ্রহে। কিন্তু আসমান পেরিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তি হলেই চলবে না। উক্ত আসমান অতিশয় শক্ত। তাছাড়া, সেখানে পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত আছেন ফেরেশতা। তিনি যাকে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দরজা খুলে দেবেন কেবল সেই ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন। এখানে আকাশ বলতে শূন্যস্থলে বায়ুণ্ডলের নানাস্তর গ্রহণ করলে আকাশের মূল তাৎপর্য প্রস্ফুটিত হয় না। বায়ুমÐলের এ স্তরগুলো পেরোনো অথবা অন্য গ্রহে গমন করা, এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সিতে যাওয়ার জন্য শক্তি ও সময় হলেই সম্ভব। কিন্তু প্রকৃত আকাশ যেটা ধ্বংস হবে, তা পেরোনো সম্ভব নয়, কিন্তু ফেরেশতার অনুমতি ব্যতীত। যেমন মে‘রাজের হাদিসে আছে, আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার নিকট বোরাক নিয়ে আসা হল। বোরাক হচ্ছে চতুষ্পদ জন্তু, সাদা, লম্বা, গাধার চেয়ে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট। তার দৃষ্টির শেষ প্রান্তে সে তার পা রাখে। তিনি বললেন, ‘আমি তাতে সওয়ার হলাম। আমি বাইতুল মুকাদ্দাস-এ আসলাম। আমি তাকে সে খুঁটির সাথে বাঁধলাম যার সাথে নবীগণ বাঁধতেন।’ তিনি বলেন, ‘অতঃপর আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। তাতে দু’রাকায়াত নামায আদায় করলাম। অতঃপর বের হলাম। অতঃপর জিবরীল আমার নিকট মদের ও দুধের পাত্র নিয়ে আসলেন। আমি দুধের পাত্র গ্রহণ করলাম। জিবরীল আমাকে বললেন, আপনি ফিতরাত (স্বভাব বা প্রকৃতি) গ্রহণ করেছেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে প্রথম আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। আমি আদম (আ.)-এর সাক্ষাত পেলাম। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। তাকে বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে খালার দুই ছেলে ঈসা ইবনে মারইয়াম ও ইয়াহইয়া বিন যাকারিয়া আলাইহিমাস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তারা আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে ইউসূফ আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তাকে সৌন্দর্যের একাংশ দেয়া হয়েছে। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে চতুর্থ আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? সে বলল, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? সে বলল, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে ইদরীস আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলে। আল্লাহ বলেন, “আমি তাকে সমুচ্চিত স্থানে আরোহণ করিয়েছি।” অতঃপর আমাকে নিয়ে পঞ্চম আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে হারূন আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে ষষ্ঠ আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে মুসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা  হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি বাইতুল মা’মুর-এর দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। বাইতুল মা’মুর -এ প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশেতা প্রবেশ করে তথা তওয়াফ করে; তারা দ্বিতীয়বার সেখানে ফিরে আসে না। অতঃপর আমাকে নিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা গেলেন, যার পাতাসমূহ হাতির কানের ন্যায় এবং ফলগুলো হল বড় বড় কলসির ন্যায়। তিনি বলেন, যখন আল্লাহর নির্দেশ তাকে আবর্তিত করে নিল তখন সে এমন সৌন্দর্য লাভ করল যে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি নেই যেটা তার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে সক্ষম হবে। অতঃপর আমাকে যা ওহী প্রেরণ করার তা করা হল। দিনে-রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হল। আমি মুসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট আসলাম। তিনি বললেন, আপনার রব আপনার উম্মতের জন্য কী ফরজ করেছেন? আমি বললাম, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। তিনি বললেন, আপনি আপনার রবের কাছে গিয়ে বলুন হালকা করতে। কারণ আপনার উম্মত এটা পালন করতে পারবে না। আমি বনি ইসরাইলকে পরীক্ষা করেছি। আমি রবের কাছে ফিরে গেলাম এবং বললাম, হে রব, আমার উম্মতের ওপর হালকা করে দিন। তিনি পাঁচ কমালেন। আমি মুসা আ.-এর কাছে গেলাম এবং বললাম, পাঁচ কমিয়েছেন। তিনি বললেন, আপনার উম্মত এটা পারবে না। আপনি ফিরে যান এবং হালকা করতে বলুন। তিনি বলেন, আমি এভাবে আমার রব ও মুসা আ.-এর মাঝে আসা-যাওয়া করছিলাম। অবশেষে তিনি বলেন, হে মুহাম্মদ, প্রতি রাত-দিনে এ হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। প্রত্যেক নামাযের জন্য দশ। এভাবে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। যে নেক কাজ করার ইচ্ছা করে কিন্তু সে তা করে না, তার জন্য একটি নেকি লেখা হয়। আর যদি সে তা করে তাহলে তার জন্য দশটি লেখা হয়। যে পাপ করার ইচ্ছা করে কিন্তু সে তা করে না, তার জন্য কিছু লেখা হয় না। আর যদি সে তা করে তবে তার জন্য একটি পাপ লেখা হয়। তিনি বলেন, অতঃপর আমি অবতরণ করে মুসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট পৌঁছলাম এবং তাকে সংবাদ দিলাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনার রবের নিকট ফিরে যান এবং তার নিকট হালকা করার জন্য দরখাস্ত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি বললাম, আমি আমার রবের নিকট বারবার গিয়েছি যাবৎ আমি এখন লজ্জাবোধ করছি।’(সহিহ মুসলিম ,হাদিস নং ১৬২-২৫৯, ও সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৬৭৪, হাদিসটি সহিহ। )

فَكَانَتْ أَبْوَابًا : فَاء মানে অতঃপর। এটা সংযুক্তি বর্ণ, পর্যায়ক্রমিক ধারা বর্ণনা করতে এসেছে। أَبْوَابًا শব্দটি বহুবচন, এর একবচন হল بَابٌ। দরজা দরজা হবে। সেদিন বিশ্বচরাচরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এর বন্ধনে ভাঙন সৃষ্টি হবে। এর গঠন সুদৃঢ় থাকবে না। আসমান বিদীর্ণ করা হবে। এতে ফাটল সৃষ্টি করা হবে। ফলে, এটা দরজা দরজা সদৃশ হবে –অর্থাৎ দরজা যেমন উন্মুক্ত তেমনি আসমান এমন পরিমাণে বিদীর্ণ হবে যে, দরজার ন্যায় খোলা, উন্মুক্ত হয়ে যাবে। কোনো বাধাদানকারী ফেরেশতা থাকবে না। আসমানের ফেরেশতারা উক্ত দরজা দিয়ে অবতরণ করবেন। স্মর্তব্য যে, ফেরেশতারা অবতরণ করবেন বান্দাদের আমলনামা নিয়ে।

সৃষ্টির উপরিভাগে যেমন ধ্বংস দেখা দেবে, এর নিম্ন অংশ তথা পৃথিবীতেও ধ্বংস দেখা দেবে। লক্ষণীয় বিষয় হল, এত শক্ত, মজবুত, সুদৃঢ় একটি গঠন ভেঙে লয় হয়ে যাবে। আর এটা প্রমাণ করে, কিয়ামতের দিন হবে একটি ভয়ংকর দিন। তাহলে আদম সন্তানের উচিত এটা অনুধাবন করা যে, আল্লাহ যা চান তা তিনি করতে পারেন। সুতরাং পরকাল অবশ্যম্ভাবী।

ভাষা অলংকারঃ

এখানেتَشْبِيهٌ بَلِيغٌ  বা উপমা প্রদানে আধিক্য করা হয়েছে, ফলে উপমার অব্যয় পদ উল্লেখ করা হয় নি। আয়াতের মূল ধারা হল, وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ كَالْأَبْوَابِ في التَّشَقُّقِ وَالتَّصَدُّعِ- অর্থাৎ- আর আসমানকে খুলে দেয়া হবে, অতঃপর এটা দীর্ণ-চীর্ণ হওয়ার দিক দিয়ে দরজার মতো হবে।(তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/১৫। )

এখানে উপমা দেয়ার তাৎপর্য এটাও হতে পারে যে, দরজার যেমন চৌকাঠ থাকে, তেমনি আসমানের গাত্র দু’পাশে সরে গিয়ে দরজার মতো হবে। আবার এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, দরজার মধ্যবর্তী স্থান যেমন খোলা, উন্মুক্ত, তেমনি আসমানের গাত্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং তা দরজার মধ্যবর্তী খোলা স্থানের ন্যায় উন্মুক্ত ও খোলা হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

সেদিন আকাশসমূহ দীর্ণ-চীর্ণ হয়ে দরজার ন্যায় উন্মুক্ত হবে। আকাশে কোনো ফেরেশতা পাহারাদার হিসেবে থাকবে না। ফেরেশতারা বান্দাদের আমলনামা নিয়ে নেমে আসবে।

وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا (20)

শব্দার্থঃ سُيِّرَتْ = প্রবল ভাবে চালিত হবে, সঞ্চালিত হবে, অপসারিত হবে। الْجِبَالُ [একচবন الْجَبَل]= পাহাড়সমূহ। فَكَانَتْ = অতঃপর হবে। মূল অর্থ অতঃপর হয়েছিল। سَرَابًا = মরীচিকা।

অর্থঃ আর পাহাড়সমূহকে পরিচালিত করা হবে, অতঃপর তা মরীচিকা হবে। [আয়াত ২০]

তাৎপর্যঃ

سُيِّرَتْ : প্রবল ভাবে চালিত হবে। এর স্থান থেকে উপড়ে ফেলা হবে। তবে মূল অর্থ অতীত ক্রিয়ার। অর্থাৎ- প্রবল ভাবে চালিত হয়েছে, উপড়ে ফেলা হয়েছে, অপসারিত করা হয়েছে। কাজটি অবশ্যম্ভাবী বোঝানোর জন্য অতীত ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে।

الْجِبَالُ : পাহাড়সমূহ হল পৃথিবীতে পেরেকস্বরূপ। যখন এটাকে উপড়ে ফেলা হবে পৃথিবী আন্দোলিত হতে থাকবে। তাহলে এটা ইঙ্গিত দেয়, কিয়ামতের বিভীষিকার সাথে পৃথিবীর গাত্রও আন্দোলিত হতে থাকবে। এতে করে, ভয়ের সাথে আরো ভয় সংযুক্ত হবে।

فَكَانَتْ سَرَابًا : فَاء মানে অতঃপর। এটা সংযুক্তি বর্ণ, পর্যায়ক্রমিক ধারা বর্ণনা করতে এসেছে। سَرَابًا মানে মরীচিকা। অর্থাৎ- পাহাড়সমূহ উন্মূলিত হয়ে মরীচিকা সদৃশ হবে। সূরা ওয়াকিয়াতে আল্লাহ বলেন, وَبُسَّتِ الْجِبَالُ بَسًّا، فَكَانَتْ هَبَاءً مُنْبَثًّا – অর্থাৎ- ‘আর পাহাড়সমূহকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে, অতঃপর তা উড়ন্ত ধূলায় পরিণত হবে।’ [আয়াত-৫,৬]

তাহলে পাহাড় ধ্বংসের বিষয়টি হল নিম্নরূপঃ প্রথমে এগুলোকে এর মূল থেকে উন্মূলিত করা হবে, অতঃপর এগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে, অতঃপর ধূলা যেমন আকাশে উড়তে থাকে, ঠিক তেমনি এগুলো ধূলা হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে পড়বে, উড়তে থাকবে অথবা পাহাড়সদৃশ হয়ে থাকবে। অবলোকনকারী এগুলোকে মরীচিকার ন্যায় ভাববে। একজন পিপাসার্ত ব্যক্তি দূর থেকে যেমন মরীচিকাকে দেখে পানি মনে করে, অতঃপর কাছে গিয়ে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায় না; ঠিক তেমনি এসব পাহাড়গুলোও মরীচিকার মতো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ- দেখে মনে হবে পাহাড় আছে, কিন্তু যখন সেখানে যাবে, দেখবে পাহাড় নেই। পানি সদৃশ মরীচিকা যেমন পানিবিহীন, তেমনি ধূলা সদৃশ পাহাড়গুলোও পাহাড়বিহীন। আর তখন মানবকুল কবর থেকে উত্তোলিত হবে। পাহাড় ধ্বংস হওয়ার পর পৃথিবীর গাত্রে আন্দোলন সৃষ্টি হবে। এতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এ ভূমি ভিন্ন একটি ভূমিতে রূপান্তরিত হবে। মানবকুল একটি স্থির জায়গা অনুসন্ধান করবে আশ্রয়ের জন্য। আর পাহাড় যেহেতু পেরেক স্বরূপ তাই সে স্থানটি স্থির থাকাই যুক্তিযুক্ত, অথবা তারা পাহাড়ের পেছনে লুকাতে চাইবে হিসেব-নিকেশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, তখন তারা দূরপানে তাকিয়ে পাহাড় সদৃশ আবছায়া দেখতে পাবে, তা পাহাড় মনে করে সেখানে যাবে আশ্রয় নেয়ার জন্য, কিন্তু গিয়ে দেখবে সেখানে পাহাড় নেই, সেখানে আছে ধূলাবালি -যেমন একজন পিপাসার্ত ব্যক্তি পানির খোঁজে মরীচিকাকে পানি ভেবে তার পেছনে দৌঁড়ায়, গিয়ে দেখে পানি নেই -তা হল মরীচিকা, তখন হতাশায় ভোগে। অথবা, পাহাড় বিদীর্ণ হওয়ার পর উক্ত চূর্ণিত ধূলাবালি মরীচিকা সদৃশ উদ্ভূত হবে, অথচ তা ধুলাবালি। তবে এ ব্যাখ্যাটি নিলে পাহাড়ের মূল তাৎপর্য প্রস্ফুটিত হয় না যেমনটি হয় প্রথম ব্যাখ্যাটিতে। কারণ, পাহাড়কে মরীচিকার সাথে উপমা দেয়ার হেতু কী? পিপাসার্ত ব্যক্তি যেমন পানির খোঁজে মরীচিকাকে পানি মনে করে প্রতারিত হয়, তেমনি কিয়ামত দিবসে লোকেরা আশ্রয় অথবা লুকানোর জন্য দৃঢ় ও আড়াল স্থান অনুসন্ধান করবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا – অর্থাৎ- আর আমরা তাদেরকে একত্র করব, কাউকে ছেড়ে দেব না। [সূরা কাহফ, আয়াত-৪৭] এখানে যেহেতু ছেড়ে না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাহলে বোঝা যায়, হিসেব-নিকেশ থেকে মুক্ত থাকার জন্য কেউ কেউ পলায়নের প্রচেষ্টা করবে এবং পাহাড়ের অন্তরালে অন্তরীত হতে যাচনা করবে, অথবা ভূমি যেহেতু আন্দোলিত হতে থাকবে, অনেকে আশ্রয়স্থল খোঁজার জন্য পাহাড়ের নিকট যাবে, কিন্তু গিয়ে দেখবে পাহাড় নেই, তা ধূলোবালি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

আসমান চীর্ণ হওয়া, পাহাড় দীর্ণ হওয়া -এসব শক্তিশালী-সুদৃঢ় সৃষ্টি ধ্বংস হওয়া প্রমাণ করে প্রলয়ংকর দিবসটি অতিমাত্রায় ভয়ংকর হবে। আর এর দ্বারা মানবকুলকে সতর্ক করা হচ্ছে।

ভাষা অলংকারঃ

এখানে তাশবীহ বলীগ হয়েছে বা উপমা প্রদানে আধিক্য করা হয়েছে, ফলে উপমার অব্যয় পদ উল্লেখ করা হয় নি। আয়াতের মূল ধারা হল, وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ كالسَّرَابِ – অর্থাৎ- আর পাহাড়সমূহকে উন্মূলিত করা হবে, অতঃপর এটা মরীচিকার মতো হবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

পাহাড়সমূহকে তাদের স্বীয় স্থান থেকে অপসারিত করা হবে, অতঃপর তা মরীচিকা সদৃশ ধূলায় পরিণত হবে। দেখে মনে হবে পাহাড়, অথচ তা ধূলা, যেমন মরীচিকাকে দেখে মনে হয় পানি, অথচ তা অস্তিত্বহীন।

إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21)

শব্দার্থঃ إِنَّ =  নিশ্চয়। جَهَنَّمَ = জাহান্নাম, দোযখ। كَانَتْ = ছিল, হল। مِرْصَادًا = সুরক্ষিত ঘাঁটি।

অর্থঃ নিশ্চয় জাহান্নাম হল সুরক্ষিত ঘাঁটি। [আয়াত ২১]

তাৎপর্যঃ

 إِنَّ جَهَنَّمَ: إِنَّ শব্দটি গুরুত্ববাহী অক্ষর। جَهَنَّمَ শব্দটি হল ফারসী। এটাকে আরবি করা হয়েছে। এটা সাত প্রকার আগুন থেকে একটির নাম। তবে নামবাচক হিসেবে সকল জাহান্নামই উদ্দেশ্য।

مِرْصَادًا : [اِسْمُ آَلَةِ وَصِفَةُ مُشَبَّهَةٍ لِلْمُبَالَغَةِ مِنْ رَاصِدَةٍ] মানে পর্যবেক্ষিত, সুরক্ষিত ঘাঁটি, রাস্তা, সুমুখে যা আছে তাই মিরসাদ, আবার এটা হল উক্ত স্থান যেখানে কেউ তার দুশমনের জন্য ওৎ পেতে বসে থাকে। 

এখানে আল্লাহ হিসেব-নিকেশের পর শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমে বলেছেন কিয়ামতের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। আর এর পর তাদের জন্য অপেক্ষমান আছে জাহান্নাম যা হল একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। আল্লাহ এটাকে সৃষ্টি করেছেন কাফের, মুশরিকদেরকে শাস্তি প্রদানের জন্য। এখান থেকে পালাবার কোনো রাস্তা নেই। জাহান্নাম হল একটি ঘাঁটি -এ কথা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, এ ঘাঁটি মুসলিম, মুশরিক উভয়কেই পার হতে হবে। কিন্তু মুসলিমরা এ ঘাট পেরিয়ে জান্নাতে চলে যাবে। আর মুশরিক-কাফেররা জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হবে। এখানে ঘাঁটি বলতে আরেকটি বিষয় উদ্ভুত হয় যে, আমরা যেমন বিদেশে ভ্রমণ করার জন্য বিমানবন্দরে যাই, সেখানে ইমিগ্রেশনে লোক থাকে, তারা যাত্রীদের পাসপোর্টে সীল মেরে বিমানে উঠার অনুমতি দেয়। অতঃপর যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বিমানে আরোহণ করে, ঠিক তেমনি উক্ত জাহান্নামের ঘাঁটিতে জাহান্নাম ও জান্নাতের ফেরেশতারা অপেক্ষমান থাকবেন। তারা আগন্তুকদেরকে অভিবাদন জানাবেন। অর্থাৎ- যারা জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত বা জান্নাতে যাওয়ার ছাড়পত্র আছে তারা জান্নাতে চলে যাবে, আর যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

ইমাম রাযী বলেন, ‘এখানে দু’টি রূপ রয়েছে। যদি বলি ঘাঁটি বা আশ্রয়স্থল বলতে কাফেরদের আশ্রয়স্থল তখন এ আয়াতটি পরবর্তী আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত হবে, এটি পরিপূর্ণ আয়াত হবে না। অর্থাৎ- إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا لِلطَّاغِينَ – আর مَئَابًا শব্দটি مِرْصَادًا থেকে পরিবর্তিত রূপ বা বদল হবে। আর যদি বলি مِرْصَادًا বা ঘাঁটি শব্দটি শর্তহীন, তাহলে এটা মুসলিম ও কাফের উভয়কেই উদ্দেশ করবে এবং এটি একটি পূর্ণ আয়াত হবে এবং পরেরটি পৃথক আয়াত হবে।’(তাফসীর রাযী, ৩১/১৯। )

তবে এখানে শর্তহীন হওয়া এবং পরিপূর্ণ আয়াত হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ, কোরআনে আছে, আল্লাহ বলেন, وَإِنْ مِنْكُمْ إِلاَّ وَارِدُهَا – অর্থাৎ- তোমাদের মধ্যে কেউ নেই যে সেখানে অবতরণ করবে না। [সূরা মারইয়াম, ৭১] অর্থাৎ- মুসলিম-কাফের সবাইকেই জাহান্নামে অবতরণ করতে হবে বা জাহান্নামের ঘাঁটি পেরোতে হবে। নচেৎ কোনো মুসলিম জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যেমন, তাফসীর তাবারীতে আছে, হাসান বসরী বলেন, ‘জান্নাতে কেউ প্রবেশ করবে না যাবৎ না সে জাহান্নাম পার হবে।’ কাতাদা বলেন, ‘এ আয়াত আমাদেরকে জানান দেয় যে, জাহান্নাম পেরোনো ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে না।’ সুফিয়ান বলেন, ‘জাহান্নামের উপর তিনটি ব্রিজ আছে।’(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫৯। )

মিকসাম ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, জাহান্নামের ব্রিজে সাতটি প্রতিবন্ধকতা বা বাধা আছে। প্রথমটায় বান্দাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে দ্বিতীয়টিতে যাবে। সেখানে নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে তৃতীয়টিতে যাবে। সেখানে যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে চতুর্থটিতে যাবে। সেখানে রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে পঞ্চমটিতে যাবে। সেখানে তাকে হজ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে ষষ্ঠটিতে যাবে। সেখানে তাকে ওমরা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে পারে তাহলে সপ্তমটিতে যাবে। সেখানে তাকে অত্যাচার, নির্যাতন-নীপিড়ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি বের হতে সক্ষম হয় তাহলে তো পেরিয়ে গেল। আর সক্ষম না হলে বলা হবে, তোমরা তার নফল আমলসমূহ দেখ। যদি থাকে তাহলে তার দ্বারা পূর্ণ করা হবে। এ প্রক্রিয়া শেষ করার পর সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।(তাফসীর বঘভী, ৮/৩১৪।)

কাফের-মুশরিকরা জাহান্নামে যাবে ঠিক আছে, তবে মু’মিনদেরকে কেন জাহান্নামের ঘাঁটি পেরোতে হবে? এর উত্তর হল, প্রথমেই একটি কথা বলে নেই, মু’মিন যাদের জন্য জান্নাত ফায়সালা হয়ে গেছে, তাদের জন্য জাহান্নামে অবতরণ হবে আরামদায়ক। আগুন তাদের পোড়াবে না। তবে আগুনের ছোঁয়া লাগাতে হবে, কারণ, মানুষ মাত্রই কিছু ভুল-ত্রুটি থাকেই। কিন্তু আল্লাহ এই ভুলত্রুটিও মুক্ত করে জান্নাতে নেবেন, যাতে সে সকল পঙ্কিলতামুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। তাই জাহান্নামের অগ্নিতে একটু স্পর্শ হলেও লাগতে হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

কিয়ামতের হিসাব-নিকাশ পেরিয়ে যাওয়ার পর তাদের প্রত্যেকের জন্য অপেক্ষারত থাকবে জাহান্নাম। এ ঘাঁটি পেরোনোর পর যারা জান্নাতে যাওয়ার তারা জান্নাতে চলে যাবে। আর যারা জাহান্নামে যাওয়ার তারা জাহান্নামে যাবে।

لِلطَّاغِينَ مَآَبًا (22)

শব্দার্থঃ لِـ = জন্য। الطَّاغِينَ = সীমালঙ্ঘনকারী। مَئَابًا = আশ্রয়স্থল।

অর্থঃ সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য আশ্রয়স্থল। [আয়াত ২২]

তাৎপর্যঃ

لِلطَّاغِينَ : এটা বহুবচন। এর একবচন হল اَلطَّاغِي। মানে সীমালঙ্ঘন কারী। সীমালঙ্ঘন করা দুইভাবে হয়ে থাকে। প্রথমতঃ কাফের যারা আল্লাহর উপর ঈমান না এনে কুফরি করেছে। নবী-রাসূলদের বিরোধিতা করেছে। এ সকল অহংকারীদের জন্য আল্লাহ জাহান্নামের আগুন নির্ধারণ করে রেখেছেন। এটা হল ধর্মের ব্যাপারে তাদের সীমালঙ্ঘন করা। অথবা উক্ত মুসলিম যারা হালাল-হারাম না মেনে বিরোধিতা করেছে। আর দ্বিতীয় প্রকার হল, মু’মিন যারা মানুষের সাথে অন্যায় আচরণ করে। তবে এর অধীনে প্রথম প্রকারও অন্তর্ভুক্ত। এটা হল পার্থিব ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করা। এই দ্বিতীয় প্রকার সীমালঙ্ঘনকারীরা যারা মু’মিন আল্লাহ যখন যাচনা করবেন তখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা হতে পারে নিপীড়িতদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করার মাধ্যমে, অথবা আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নিপীড়িতদেরকে কোনো প্রতিদান প্রদান করতঃ খুশি করার মাধ্যমে। তবে আয়াতের ধারাভাষ্যে যারা শিরক করেছে, কুফরি করেছে তারাই উদ্দেশ্য।

مَئَابًا : آَبَ يَؤُوبُ أُوبَةً : إِذَا رَجَعَ। প্রত্যাবর্তন করার স্থল বা আশ্রয়স্থল। এ শব্দটি প্রমাণ করে, পরকালই হল আসল ঠিকানা। এ দুনিয়া হল ক্ষণিকের জন্য ভ্রমণ স্বরূপ আসা। পরকালে আশ্রয়স্থল হল দু’টিঃ জান্নাত ও জাহান্নাম। জাহান্নাম হল কাফেরদের আশ্রয়স্থল, আর জান্নাত হল মো’মিনদের আশ্রয়স্থল যারা আল্লাহর প্রতি আশ্রয়ের পথ চয়ন করেছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

এই জাহান্নামই হল সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য আশ্রয়স্থল। তারা এখান থেকে পলায়ন করতে পারবে না।

لَابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا (23)

শব্দার্থঃ لاَبِثِينَ = অবস্থানকারীরা, অবস্থান করবে। فِيهَا = এতে বা জাহান্নামে। أَحْقَابًا = দীর্ঘসময় বা যুগের পর যুগ Ñউদ্দেশ্য হল অনন্তকাল।

অর্থঃ সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে। [আয়াত ২৩]

তাৎপর্যঃ

لاَبِثِينَ : এ শব্দটিকে দু’ভাবে পড়া যায়- لاَبِثِينَ ও لَبِثِينَ। ইমাম তাবারী বলেন, আলিফ দিয়ে বা لاَبِثِينَ পড়াটাই বেশি সঠিক।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫৯।) ইমাম র্ফারা বলেন, উভয়টার অর্থ একই। ইমাম যমখশরী বলেন, আলিফ ব্যতীত শব্দটি বা لَبِثِينَ অর্থগত দিক দিয়ে বেশি শক্তিশালী।(তাফসীর রাযী, ৩১/১৯।) কারণ এটা সিফাতের সিগা। মানে, অবস্থানকারীরা। তবে এটা বর্তমান ক্রিয়ারও অর্থ দেয়। কারণ, এটা কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া। মানে, অবস্থান করবে।

فِيهَا : এতে বা জাহান্নামে। هَا সর্বনামের আরোপ হল এক আয়াত পূর্বে উল্লেখিত জাহান্নাম।

أَحْقَابًا : এ শব্দটি হল حُقُبٌ ও حُقْبٌ এর বহুবচন। حُقُبٌ শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। যেমন তাফসীর কুরতুবীতে আছে, ইবনে উমর, আবু মুহাইসিন ও আবু হুরায়রা বলেন, হুকুব (حُقُبٌ) মানে আশি বছর। ইবনে আব্বাস বলেন, একবছর হল তিনশত ষাট দিন। আর দুনিয়ার হিসাব অনুযায়ী একদিন হল এক হাজার বছর। ইবনে উমর রাযি. এটাকে রাসূলুল্লাহ স. এর প্রতি মারফু‘ হিসেবে বর্ণনা করেন। আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, এক বছর হল তিনশত ষাট দিনে যা এ দুনিয়ার দিনের সমান। ইবনে উমর থেকে আরো বর্ণিত আছে, হুকুব মানে চল্লিশ বছর। ইমাম সুদ্দি বলেন, সত্তর বছর। আবার বলা হয় এক হাজার মাস। বুশাইর বিন কা‘ব বলেন, তিনশত বছর। হাসান বসরী বলেন, আহকাব (أَحْقَابًا) বলতে কত সময় উদ্দেশ্য তা কেউ জানে না। অনেকে বলেন, একশত হুকুব। এক হুকুব হল সত্তর হাজার বছর। আর একদিন হল এক হাজার বছর তোমাদের হিসেব অনুযায়ী, তথা পৃথিবীর হিসেব অনুযায়ী।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭৮-১৭৯।)

তবে ইমাম তাবারী আবু হুরায়রা রাযি.-এর কথাকে এভাবে উল্লেখ করেন, আবু হুরায়রা বলেন, হুকুব হল আশি বছর। একবছর হল তিনশত ষাট দিনে। আর একদিন হল একহাজার বছর।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৬১-১৬২।)

ইমাম তাবারী উল্লেখ করেন, আলী রাযি. হেলাল আল-হাজারীকে বলেন, আল্লাহর কিতাবে হুকুব কতদিন পাও? তিনি বললেন, আশি বছর। প্রতি বছর বারো মাসে। প্রতি মাস ত্রিশ দিনে। প্রতিদিন একহাজার বছর।

কাতাদা বলেন, পরকালের বছর হিসেবে হুকুব হল আশি বছর। হাসান আল-বসরীকে উক্ত আয়াত (لاَبِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, আহকাব বা কয়েক হুকুব-এর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করা ব্যতীত। কিন্তু লোকেরা বলে, এক হুকুব হল সত্তর হাজার বছর। আর উক্ত সত্তর হাজার বছরের প্রতিটি দিন হল এক হাজার বছরের সমান তোমাদের হিসেব অনুযায়ী।(সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীনদের বাণীকে আছর বলা হয়। ) তাঁর থেকে আরেকটি আছর বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আহকাব কী, এটা কেউ জানে না। তবে হুকুব হল সত্তর হাজার বছর, আর প্রতিদিন হল একহাজার বছর।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৬২।)

ইমাম কুরতুবী ইমাম ছা‘লাবীর বরাত দিয়ে একটি হাদিস উল্লেখ করেন, উমর বিন আল-খাত্তাব বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যে জাহান্নামে প্রবেশ করবে সে আহকাব বা কয়েক হুকুব অবস্থান না করা পর্যন্ত সেখান থেকে বের হবে না। এক হুকুব হল আশি এবং আরো কয়েক বছর। আর একবছর হল তিনশত ষাট দিনে। আর একদিন হল এক হাজার বছর তোমাদের হিসেব অনুযায়ী।’ আল-কুরযী বলেন, তেতাল্লিশ হুকুবে এক আহকাব। প্রতি হুকুবে হল সত্তর হেমন্ত বা বছর। প্রতি হেমন্ত হল সাতশত বছরে। প্রতি বছর হল তিনশত ষাট দিনে। আর প্রতিদিন হল একহাজার বছর।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭৯। )

এ হাদিসটি ইবনে উমর রাযি.-এর বরাত দিয়ে আবু বকর আল-শাফেয়ী তার আল-ফাওয়ায়েদুশ শহীর বিল গাইলানিয়াত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

যাহোক, এ শব্দটির ব্যাখ্যায় নানা মত রয়েছে। তবে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হল, কাফেরদের জন্য অনন্তকাল। আর মুসলিম গোনাহগার যারা জাহান্নামে যাবে তারা কয়েক হুকুব অবস্থান করার পর আল্লাহ যখন যাচনা করবেন তখন জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবার আল্লাহ শুরু থেকেও চাইলে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন। কিন্তু গোনাহভোগের শাস্তি হল কয়েক হুকুব।

এখানে একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়, সেখানে তারা কয়েক হুকুব অবস্থান করবে – সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝা যায়, একটি সময় পর তা শেষ হয়ে যাবে। তাহলে এর দ্বারা একটি বিষয় অনুধাবন করা যায় যে, একসময় জাহান্নাম লয় হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত হল, জান্নাত ও জাহান্নাম লয় হবে না। এটা অনন্তকাল থাকবে। জাহমিয়াদের কথা হল, জাহান্নাম লয় হয়ে যাবে। অনেকে ইবনে তাইমিয়ার প্রতি জাহান্নাম লয় হওয়ার কথাটি সম্পৃক্ত করেছেন। কিন্তু এটা তাঁর প্রতি একটি মিথ্যারোপ করা হয়েছে। তিনি কোথাও এ কথা উল্লেখ করেননি। তবে তাঁর ছাত্র ইবনে কাইয়িম আল-জাওযিয়া এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব ভুগছিলেন। তিনি তার আল-ওয়াবেল আল-সাইয়িব, তরিকুল হিজরাতাইন, শিফাউল আলীল, ও আল-সাওয়ায়েক আল-মুরসালা গ্রন্থে এ বিষয়ে বিভিন্ন কথা উল্লেখ করেছেন। তার থেকে দু’টি মত রয়েছে, একটি হল, জাহান্নাম লয় হয়ে যাবে, এবং আরেকটি হল, তিনি তার এ মত থেকে প্রত্যাবর্তন করতঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত গ্রহণ করেছেন যে, জাহান্নাম লয় হবে না। আর এটি হল তার শেষের মত।

জাহান্নাম লয় হওয়ার চিন্তাটি এসেছে এই আয়াত ও সূরা হুদের ১০৬ ও ১০৭ নং আয়াত থেকে। সেখানে আল্লাহ বলেন,

فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ (106) خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ (107)

অর্থাৎ- ‘আর যারা অবাধ্য হয়েছে বা পথভ্রষ্ট হয়েছে, তারা জাহান্নামে অবস্থান করবে। তাদের জন্য রয়েছে দীর্ঘশ্বাস ও কর্কশ আওয়াজ। তারা সেখানে অবস্থান করবে যতদিন আকাশ ও জমিন থাকে। কিন্তু আপনার রব যা যাচনা করেন। নিশ্চয় আপনার রব করিতকর্মা যা তিনি যাচনা করেন।’ [সূরা হুদ, আয়াত ১০৬-১০৭]

আমরা এ বিষয়টি নিয়ে সূরা হুদে সবিস্তারে আলোচনা করব, ইন শা- আল্লাহ। এখানে পরিমিতটুকু আলোচনা করছি। خَالِدِينَ এ শব্দটির মূল ধাতু হল, خُلُودٌ। এ শব্দের মূল অর্থ হল দীর্ঘকাল অবস্থান করা, কিন্তু যদিও এর অর্থ অনাদি-অনন্তকাল নেয়া হয়। আবার আহকাব মানে কয়েক হুকুব। তাহলে শব্দদ্বয় প্রমাণ করে জাহান্নাম চিরকাল থাকবে না। সূরা নাবা’য় উক্ত আয়াতের পরে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, আবার সূরা হুদেও জাহান্নামে অবস্থান করার পর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তাই স্কলারদের মত হল, এখানে যে দীর্ঘকাল অবস্থানের কথা বলা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হল, জাহান্নামীরা একই ধরনের শাস্তিতে দীর্ঘকাল বা আহকাব বা কয়েক হুকুব পর্যন্ত ভুগতে থাকবে। তারপর শাস্তির ধরন পরিবর্তন করা হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমিক ধারা অব্যাহত থাকবে। আগুনের জাহান্নাম থেকে বরফের জাহান্নামে যাবে। কখনো দীর্ঘশ্বাস ও উচ্চবাচ্যে ভুগবে, আবার কখনো গরম পানি ও পুঁজ পানে ভুগবে -এভাবে শাস্তির ধরন পরিবর্তন হবে।

তাফসীর আল-খাযেন-এ  لاَبِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا -আয়াতের কয়েকটি ব্যাখ্যা করেন এভাবেঃ

প্রথমতঃ হাসান বসরী বলেন, আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের জন্য কোনো সময় উল্লেখ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, তারা সেখানে কয়েক হুকুব তথা হুকুবের পর হুকুব অবস্থান করবে। এর উদ্দেশ্য হল, একটি হুকুব শেষ হবে, আরেকটি হুকুব প্রবেশ করবে- এভাবে চলতে থাকবে অনন্তকাল। সুতরাং আহকাবের অনন্তকাল অবস্থান করা ছাড়া আর কোনো অর্থ নেই। ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যদি জাহান্নামবাসীরা জানত, তারা জাহান্নামে দুনিয়ার নুড়ির সংখ্যার ন্যায় সেখানে অবস্থান করবে তাহলে তারা খুশি হত। আর যদি জান্নাতবাসীরা জানত, তারা দুনিয়ার নুড়ির সংখ্যার ন্যায় জান্নাতে অবস্থান করবে, তাহলে তারা দুশ্চিন্তা করত।

দ্বিতীয়তঃ আহকাব মানে অনন্তকাল উদ্দেশ্য নয়। বরং এই আহকাব পরিমাণ সময় তারা শীতলতা আস্বাদন করবে না, পানীয় আস্বাদন করবে না, তবে গরম পানি ও পুঁজ। তাহলে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন আহকাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন রকম শাস্তিতে ভুগবে।

তৃতীয়তঃ এ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে আরেকটি আয়াত দ্বারা। আল্লাহ বলেন, فَذُوقُوا فلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا – অর্থাৎ-‘অতঃপর আমরা তোমাদের শাস্তি বৈ আর কিছু বৃদ্ধি করব না।’ [সূরা নাবা, আয়াত ৩০]। এ আয়াত দ্বারা সংখ্যা দূরীভূত হয়েছে এবং চিরকাল নির্ধারিত হয়েছে।(তাফসীর আল-খাযেন, আলাউদ্দীন আল-বাগদাদী, ৭/২০১। )

তবে ইমাম কুরতুবী এই তৃতীয় নম্বর ব্যাখ্যায় মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘ সংখ্যা দূরীভূত হয়েছে এবং চিরকাল নির্ধারিত হয়েছে’ -এটা একটি সংবাদ। আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ Ñঅর্থাৎ- ‘তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যাবৎ উট সূঁচের ছিদ্রে প্রবেশ করবে।’ [সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৪০] এটা হল কাফেরদের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ- উট যেমন সূঁচের ছিদ্রে কখনও প্রবেশ করতে পারবে না, তারাও কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না। তবে যারা পাপিষ্ঠ মু’মিন, পাপ করেছে, তাদের ব্যাপারে আয়াতটি রহিত হওয়া মানে হল সময় নির্দিষ্ট হওয়া। অর্থাৎ তারা নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করতঃ জান্নাতে প্রবেশ করবে।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭৯।)

জাহান্নাম যে লয় হবে না সে বিষয়ক আরো প্রমাণাদিঃ

আল্লাহ বলেন, كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا أُعِيدُوا فِيهَا –অর্থাৎ- তারা যতবারই সেখান [জাহান্নাম] থেকে বের হতে চাইবে তাদেরকে সেখানে প্রত্যাবর্তন করানো হবে। [সূরা সাজদা, আয়াত ২০]

আল্লাহ বলেন, كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُودًا غَيْرَهَا-অর্থাৎ- তাদের চামড়া যতবারই পেকে যাবে বা পুড়ে যাবে, তাদের চামড়াকে ভিন্ন আরেক চাড়মায় পরিবর্তন করে দেব। [সূরা নিসা, আয়াত ৫৬]

আল্লাহ বলেন, ثُمَّ لاَ يَمُوتُ فِيهَا وَلاَ يَحْيَا – অর্থাৎ- সে সেখানে মরবে না এবং জীবিতও হবে না। [সূরা আ‘লা, আয়াত ১৩]

ইবনে উমর রাদ্বি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আল্লাহ তায়ালা জান্নাতবাসীকে জান্নাতে এবং জাহান্নামবাসীকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। অতঃপর এক ঘোষক ঘোষণা দেবেন, ওহে জান্নাতবাসীরা! আর মৃত্যু নেই। ওহে জাহান্নামবাসীরা! আর মৃত্যু নেই। যে যেখানে আছে সে সেখানে চিরকাল থাকবে।(সহিহ মুসলিম, ৪/২১৮৯, হাদিস নং ৪২-২৮৫০। (জাহান্নাম লয় হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ইবনে কাইয়িম আল-জাওযিয়ার উক্ত কিতাবগুলো অধ্যয়ন করুন। আর জাহান্নাম লয় না হওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আলী আল-হারবী কর্তৃক প্রণীত: কাশফুল আসতার লি-ইবতালে ইদ্দিআয়ে ফানায়িন নার গ্রন্থটি পড়ুন।))

তাৎপর্যগত অর্থঃ

কাফের-মুশরিকরা জাহান্নামে যুগের পর যুগ, অনাদি-অনন্তকাল অবস্থান করবে যার কোনো শেষ নেই। যুগের পর যুগ আসতেই থাকবে পালাক্রমে।

لَا يَذُوقُونَ فِيهَا بَرْدًا وَلَا شَرَابًا (24)

শব্দার্থঃ لاَ يَذُوقُونَ = তারা স্বাদ আস্বাদন করবে না। فِيهَا = তাতে, সেখানে। بَرْدًا = ঠাণ্ডা, শীতল। لاَ = না, মানে আস্বাদন করবে না। شَرَابًا = পানীয়।

অর্থঃ তারা সেখানে শীতলতা ও পানীয় আস্বাদন করবে না। [আয়াত ২৪]

তাৎপর্যঃ

لاَ يَذُوقُونَ فِيهَا : তারা সেখানে আস্বাদন করবে না -এটা ইঙ্গিত দেয়, সেখানে তারা ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবে না। তারা সেখানে আস্বাদন করবে মাত্র। এ অবস্থা যেমন জাহান্নামীদের, তেমনি জান্নাতীদেরও।

بَرْدًا وَلاَ شَرَابًا : بَرْدًا মানে ঠাণ্ডা বা শীতলতা বলতে ঠাণ্ডা পানি, শীতল বায়ু। আবার কাতাদা বলেন, প্রশান্তি। মুজাহিদ, সুদ্দি ও আবু উবায়দা বলেন, ঘুম। بَرْدٌ শব্দটি আরবেব এক গোত্রের নিকট ঘুম শব্দেও ব্যবহৃত হয়। আর شَرَابًا মানে পানীয় যা দ্বারা পিপাসা নিবারণ করা হয়।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৭।)

অর্থাৎ- তারা সেখানে জাহান্নামের দাহ্য ও তীব্র গরম থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য আত্মা শীতলকারী কোনো ঠাণ্ডা পানির স্বাদ আস্বাদন করবে না অথবা মন জুড়ানো শীতল বায়ু উপভোগ করতে পারবে না। এমনকি পিপসা নিবারণের জন্য সাধারণ কোনো পানীয়ও পাবে না। আর ঘুম অর্থ নিলে এর তাৎপর্য দাঁড়ায়ঃ তারা শাস্তির প্রকোপ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য ঘুম যাচনা করবে, কিন্তু তারা ঘুমাতে পারবে না। বলা বাহুল্য যে, আমরা যখন ঘুমাই তখন আমরা দেহের নানা রোগের ব্যথা-বেদনা অনুভব করি না। ব্যথাও যেন ঘুমিয়ে পড়ে! তেমনি, ক্ষুৎপিপাসাও অনুভব করি না। অর্থাৎ- ঘুম মানুষকে শীতল করে দেয়। বলা হয়, ঘুম হল একপ্রকার মৃত্যু। আবার প্রশান্তি অর্থে নিলে এর অর্থ হয়, ঠাণ্ডা এসে তাদের মনে প্রশান্তি এনে দেবে না এবং জাহান্নামের গরমের তীব্রতাও দূর করবে না। যেমন আরবরা বলেন, আল্লাহ তোমার জীবনকে শীতল করুন বা আরামদায়ক করুন। কারণ, তীব্র গরমে শীতলতা স্পর্শের অনুভূতিই ভিন্ন রকম।(রূহুল বয়ান, ইসমাইল হাক্কী, ১০/২৩৪।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

জাহান্নামীরা সেখানে আগুনের তীব্রতা থেকে উপশম লাভের জন্য ঠাণ্ডা ও পানীয় কামনা করবে। কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হবে না। বরং তাদেরকে যা দেয়া হবে তা হল, যেমন আল্লাহ বলেনঃ

إِلَّا حَمِيمًا وَغَسَّاقًا (25)

শব্দার্থঃ إِلاَّ = কিন্তু। حَمِيمًا = তীব্র গরম। غَسَّاقًا = পুঁজ, বিগলিত চর্বি, অতিশয় ঠাণ্ডা।

অর্থঃ কিন্তু তীব্র গরম ও পুঁজ। [আয়াত ২৫] [অর্থাৎ- তারা সেখানে তীব্র গরম এবং পুঁজ আস্বাদন করবে।]

তাৎপর্যঃ

حَمِيمًا : এ শব্দের তিনটি অর্থ আছে। প্রথমঃ ইবনে আব্বাস বলেন, অতিশয় গরম যেটা জ্বালিয়ে দেয়। দ্বিতীয়ঃ ইবনে যায়েদ বলেন, জাহান্নামীদের চোখের অশ্রু যা কোনো এক হাউজে জমা হবে, অতঃপর তাদেরকে পান করানোর জন্য দেয়া হবে। তৃতীয়তঃ সুদ্দি বলেন, জাহান্নামীদের জন্য এক প্রকার পানীয়।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৭।)

غَسَّاقًا : এ শব্দের ক্ষেত্রে কয়েকটি মত রয়েছে। প্রথমঃ ইবনে উমর বলেন, গাঢ় পুঁজ। দ্বিতীয়ঃ ইবনে আব্বাস বলেন, অতিশয় ঠাণ্ডা যা দেহের অঙ্গকে পৃথক করে ফেলবে। তৃতীয়ঃ কাতাদা বলেন, জাহান্নামবাসীদের পুঁজ। চতুর্থঃ ইবনে যায়েদ বলেন, তহাভিয়াদের ভাষায় এটা পুতিগন্ধময় বস্তু। আরেক অর্থ হল, বিগলিত চর্বি যা আগুনে জ্বলসে যাওয়ার ফলে জাহান্নামীদের দেহ থেকে যা নির্গত হবে।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৭। )

এখানে দু’টি শব্দের যে বিভিন্ন অর্থ বলা হয়েছে, এগুলোর তাৎপর্য হল গলাধঃকরণ ও ত্বক দ্বারা অনুধাবনের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং শব্দগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করার জন্য আমাদেরকে يَذُوقُونَ শব্দের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে। এ শব্দটির মূল ধাতু হল ذَوْقٌ, অর্থ হল, স্বাদ গ্রহন করা বা স্বাদ আস্বাদন করা। এটা সাধারণত হয় জিহ্বা দ্বারা, আর পূর্ণতা পায় গলাধঃকরণের মাধ্যমে। তখন অর্থ দাঁড়াবে, তারা সেখানে ঠাণ্ডা পানি ও পানীয়-এর স্বাদ আস্বাদন করবে না কিন্তু অতিশয় গরম পানি ও পুঁজ ছাড়া। অর্থাৎ- যখনই তারা ঠাণ্ডা পানি ও পানীয় যাচনা করবে, তাদেরকে অতিশয় গরম পানি ও পুঁজ-বিগলিত চর্বি পরিবেশন করা হবে। তখন ঠাণ্ডার পরিবর্তে গরম পানি ও পানীয়-এর পরিবের্ত পুঁজ পরিবেশন করা হবে। আবার যদি ত্বক দ্বারা অনুভব করা বা উপলব্ধি করা বোঝায় -প্রকারান্তরে, এটাও এক প্রকার স্বাদ আস্বাদন করা হয় তবে তা ত্বকের দ্বারা অনুধাবন করার মাধ্যমে- তখন অর্থ দাঁড়াবে, তারা সেখানে ঠাণ্ডা ও পানীয় আস্বাদন করবে না কিন্তু অতিশয় গরম এবং অতিমাত্রায় হিম। অর্থাৎ- তারা শীতল বায়ু কামনা করলে গরমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে যা তাদেরকে আরো জ্বলসে দেবে, অথবা তীব্র ঠাণ্ডা বরফ দেয়া হবে যা দেহের অঙ্গকে জমাট বেঁধে ঠাণ্ডায় হিম করে ফেলবে। অর্থাৎ- অতিশয় গরমের কারণেও দেহ জ্বলসে যাবে এবং অতিশয় ঠাণ্ডার কারণেও দেহ হিম হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে, জাহান্নাম আগুন ও বরফ উভয় প্রকারই আছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

ভাষা অলংকারঃ

২৪ নং আয়াতের بَرْدًا এবং ২৫ নং আয়াতের حَمِيمًا -এর মাঝে طِبَاقٌ বা বৈপরীত্য হয়েছে।(তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/১৫। )

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা সেখানে যতবারই ঠাণ্ডা ও পানীয় যাচনা করবে, তা না দিয়ে, পরিবর্তে তাদেরকে উষ্ণ ও পুঁজ দেয়া হবে।

جَزَاءً وِفَاقًا (26)

শব্দার্থঃ جَزَاءً = শাস্তি, প্রতিদান। وِفَاقًا = সঙ্গতি, মিল, অনুযায়ী।

অর্থঃ সঙ্গতিপূর্ণ শাস্তি। [আয়াত ২৬]

তাৎপর্যঃ

جَزَاءً وِفَاقًا : সঙ্গতিপূর্ণ শাস্তি অথবা সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিদান বলতে উদ্দেশ্য হল, তারা তাদের পাপের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয় মতো শাস্তি ভোগ করবে। তারা যে পাপ করেছে তার জন্য যে শাস্তির জন্য তারা উপযুক্ত সেই শাস্তিই তারা ভোগ করবে। যারা কুফরী করেছে তারা তাদের কুফর অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবে। যে শিরক করেছে সে শিরকের শাস্তি পাবে। শিরক থেকে যেমন বড় কোনো পাপ নেই, তাই তার জন্য চিরকাল জাহান্নামে অবস্থান করার চেয়ে বড় কোনো আর শাস্তি নেই। আর যারা মুসলিম তবে গোনাহে লিপ্ত ছিল তারা তাদের পাপ অনুযায়ী শাস্তি ভোগ করবে। অতঃপর পাপ মোচিত হয়ে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না। পক্ষান্তরে, যারা জান্নাতে যাবে তারা তাদের আমলের তুলনায় আল্লাহর অনুকম্পায় অধিক আরাম-আয়েশ উপভোগ করবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তারা তাদের পাপের তুলনায় যতটুকু শাস্তির উপযুক্ত তাদেরকে ততটুকু শাস্তিই দেয়া হবে। তার চেয়ে একটুও বেশি শাস্তি দেয়া হবে না। আল্লাহ বলেছেন যে, তাদের শাস্তি হল তাদের পাপ অনুযায়ী। তাই এখানে তাদের পাপের কথা উল্লেখ করছেন। প্রথমতঃ

إِنَّهُمْ كَانُوا لَا يَرْجُونَ حِسَابًا (27)

শব্দার্থঃ إِنَّهُمْ = নিশ্চয় তারা। كَانُوا لاَ يَرْجُونَ = আশা করত না, ভয় করত না। حِسَابًا = হিসাব বা পরকালে পাপ-পূণ্যের হিসাব-নিকাশ।

অর্থঃ নিশ্চয় তারা হিসাবের ভয় করত না। [আয়াত ২৭]

তাৎপর্যঃ

মুশরিকরা হিসাব-নিকাশের ভয় করত না, ফলে পরকালে বিশ্বাস করত না। তাই পৃথিবীতে নানা অনিষ্ট কাজে লিপ্ত হতে দ্বিধা করত না। উত্তম কাজে এগিয়ে যেত না। আর পরকালের ভয় না থাকার কারণে তারা কোরআনকে অস্বীকার করেছে এবং রাসূলের উপর ঈমান আনেনি।

إِنَّهُمْ : إِنَّ শব্দটি গুরুত্ববাহী শব্দ। এটা কাফেররা যে পরকালে হিসাবের ভয় করত না তা নিশ্চিত করার জন্য এসেছে।

كَانُوا لاَ يَرْجُونَ : আশা করত না, আশাবাদী ছিল না, কামনা করত না, তবে এখানে অর্থ হল, ভয় করত না। এখানে مَا كَانُوا يَرْجُونَ না বলে كَانُوا لاَ يَرْجُونَ বলা হয়েছে। দু’টি শব্দের মাঝে পার্থক্য আছে। তা হলঃ كَانُوا لاَ يَرْجُونَ এর দ্বারা আশা বা ভয় না হওয়াটা প্রমাণিত হয়েছে। মানে তাদেরকে পরকালের বিষয়ে সংবাদ দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারা এটা থেকে দূরে থেকেছে, অস্বীকার করেছে। আর مَا كَانُوا يَرْجُونَ মানে আশা বা ভয় প্রমাণিত হয়নি। কারণ, তারা এ বিষয়ে জানত না। ফলে, তারা ভয় করেনি। কিন্তু আল্লাহ তো তাদেরকে জ্ঞাপন করেছেন, কিন্তু তারা ভয় করেনি, এটা থেকে দূরে থেকেছে।

يَرْجُونَ ক্রিয়াটির মূল ধাতু হল رَجَاءٌ, মানে আশা। ইমাম রাযি এখানে দু’টি প্রশ্ন উত্থাপন করেন। একটি হল, মানুষের জন্য হিসাব হল একটি কষ্টকর বিষয়। আর কষ্টের বিষয়ে আশা উল্লেখ না করে ভয় উল্লেখ করা হয়। তাহলে এখানে ভয় উল্লেখ না করে আশার কথা কেন উল্লেখ করলেন? উচিত ছিল, ‘তারা হিসাবের ভয় করত না’ বলা -এর উত্তরে বলেন, প্রথমতঃ মুকাতিলসহ অন্যান্য ব্যাখ্যাতাগণ বলেন, ‘এখানে তারা আশা করত না’ মানে তারা ভয় করত না। উপমা স্বরূপ উল্লেখ করেন, আল্লাহ বলেন, مَا لَكُمْ لاَ تَرْجُونَ لِلََّهِ وَقَارًا Ñ অর্থাৎ- ‘তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহকে সম্মানের সাথে ভয় করছ না?’ এখানে رَجَاءٌ মানে ভয় করা, তবে শাব্দিক অর্থ আশা করা।

দ্বিতীয়ঃ মু’মিনের করণীয় হল আল্লাহর রহমতের প্রতি আশা রাখা। কারণ, এটা তর্কাতীত যে, কুফর ব্যতীত অন্য সকল পাপকাজের তুলনায় সওয়াবের ভাগ অনেক বেশি। তাহলে এখানে এ আয়াতটি (إِنَّهُمْ كَانُوا لاَ يَرْجُونَ حِسَابًا) প্রমাণ করে যে, তারা মু’মিন ছিল না।

তৃতীয়ঃ এখানে رَجَاءٌ – আশা বলতে উদ্দেশ্য হল تَوَقُّعٌ বা প্রত্যাশা। প্রত্যাশাজনিত শব্দাবলীর মাঝে আশা শব্দটি একটু উঁচু পর্যায়ের। এখানে সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই জাতিবাচক শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ- উচিত ছিল তারা পরকালে হিসাবের আশা করবে, উদ্দেশ্য হল হিসাবের মাধ্যমে সওয়াবের আশা করবে।

চতুর্থঃ এখানে মু’মিনদের জন্য সতর্কবাণী আছে যে, আল্লাহর সাথে হিসাবের ক্ষেত্রে আশা বা ইতিবাচক বিষয়টি ভয়ের চেয়ে বেশি। কারণ, ভয়ের নির্দেশের দিক থেকে সওয়াবের ক্ষেত্রে বান্দার জন্য আল্লাহর উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি শাস্তির ক্ষেত্রে আল্লাহর জন্য বান্দার উপর অধিকার রয়েছে। আর দয়ালু অন্যের উপর তার অধিকার পরিহার করেন, কিন্তু তার উপর অন্যের প্রাপ্য বা হক ছেড়ে দেন না। আর হিসাবের ক্ষেত্রে সওয়াবের দিকটাই বেশি ভারী, তাই ভয় উল্লেখ না করে আশা উল্লেখ করেছেন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, কাফেররা তো আরো নিকৃষ্ট বড় বড় পাপ করেছিল। তাহলে সেসকল পাপকাজের কথা উল্লেখ না করে পরকালে বিশ্বাস বা হিসাবের ভয় না করার কথা উল্লেখ করলেন কেন?

উত্তর হলঃ যারা পরকালে বিশ্বাস করে তারা উত্তম কাজে এগিয়ে যায় এবং অপছন্দনীয় ও নিকৃষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকে এজন্য যে তারা পরকালে এর দ্বারা উপকৃত হবে। কিন্তু যে পরকালকে অস্বীকার করে সে উত্তম কাজে অগ্রগামী হয় না এবং নিকৃষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকে না। আর আল্লাহর বাণী إِنَّهُمْ كَانُوا لاَ يَرْجُونَ حِسَابًا অর্থাৎ- নিশ্চয় তারা হিসাবের ভয় করত না -একটি সতর্কবাণী দেয় যে, তারা সকল নিকৃষ্ট ও নিষিদ্ধ কাজ করেছিল এবং সকল উত্তম ও কল্যাণকর কাজ পরিহার করেছিল। কারণ, তারা পরকালে হিসাব-নিকাশের ভয় করত না।(তাফসীর রাযী, ৩১/২০।)

এ আয়াতটি ইঙ্গিত দেয় যে, পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে যে শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হল মুশরিক-কাফেরদের জন্য নির্ধারিত। তা হবে অতি ভয়ংকর শাস্তি। আর মু’মিন যারা পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের পথে চলেনি, প্রবৃত্তির মোহে পড়ে পাপকাজে লিপ্ত হয়েছে, আল্লাহ চাইলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে পারেন, আবার চাইলে পাপের শাস্তি ভোগ করিয়ে জান্নাতে পাঠাতে পারেন। তবে এদের শাস্তি হবে কাফেরদের তুলনায় লঘু।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

কাফেরদেরকে পরকালে হিসাবের কথা জ্ঞাপন করার পরও তারা এটাকে ভয় করত না। ফলে, তারা নানা অনিষ্ট কাজে জড়িত থাকত। তাদের দ্বিতীয় প্রকার নিকৃষ্ট কাজ ছিলঃ

وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا كِذَّابًا (28)

শব্দার্থঃ وَكَذَّبُوا = আর তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করল, অস্বীকার করল। بِئَايَاتِنَا = আমাদের আয়াতসমূহকে। كِذَّابًا = অস্বীকার করার মত করে বা তীব্রভাবে।

অর্থঃ আর তারা আমাদের আয়াতসমূহকে তীব্রভাবে অস্বীকার করল। [আয়াত ২৮]

তাৎপর্যঃ

وَكَذَّبُوا بِئَايَاتِنَا : وَ সংযুক্তি বর্ণ। كَذَّبُوا ক্রিয়াটি بَابُ تَفْعِيلٍ থেকে এসেছে। মানে কোনো কিছুকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা, অস্বীকার করা। بِئَايَاتِنَا মানে আমাদের আয়াতসমূহকে বা কোরআনকে।

كِذَّابًا : এটা بَابُ تَفْعِيلٍ Ñএর আরেক প্রকার ক্রিয়ামূল। مَصْدَرٌ مِنْ فِعْلِ كَذَّبَ، أي كِذَّابًا وَتَكْذِيبًا। এর অর্থঃ অস্বীকার করার মত করে অস্বীকার করা বা তীব্রভাবে অস্বীকার করা, প্রত্যাখ্যান করা, মিথ্যা বলা বা অতিমাত্রায় মিথ্যা বলা। এ ক্রিয়ামূলটি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে ক্রিয়ার বিশেষ গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। এটা এখানে مَفْعُولٌ مُطْلَقٌ  (ক্রিয়াবাচক কর্ম)  হয়েছে।

লক্ষণীয় যে, এখানে শব্দের কঠোরতা রয়েছে। কারণ, তারা অস্বীকারকরণে অতিশয় কঠোর ছিল। তাই তাদের শাস্তিও হবে অতিশয় কঠোর ভাবে।

এটা হল তাদের দ্বিতীয় প্রকার নিকৃষ্ট কাজ যে তারা একত্ববাদ স্বীকার না করার কারণে কোরআন যেটাকে রাসূলুল্লাহ স. নিয়ে এসেছেন তা অস্বীকার করেছিল, আর এটা অস্বীকার করার দ্বারা তাঁর নবুওয়তকেও অস্বীকার করা হল। অর্থাৎ- একত্ববাদের যে সকল বিষয় আছে তারা সেসব বিষয়কে অস্বীকার করল এবং যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও পাপাচারে লিপ্ত হল। কিন্তু এখানে অন্যান্য পাপগুলোর কথা উল্লেখ করা হয় নি। কারণ এর চেয়ে আর বড় কোনো পাপকাজ নেই। তাই বাকিগুলো উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। তাহলে তাদের কর্মধারা হলঃ তারা পরকালে হিসাবের ভয় করত না। ফলে, তারা পরকালে বিশ্বাস করত না। পরকালে বিশ্বাস না করার কারণে আল্লাহকে বিশ্বাস করত না। আল্লাহকে বিশ্বাস না করার কারণে কোরআনকে বিশ্বাস করত না। কোরআনকে বিশ্বাস না করার কারণে রাসূলুল্লাহ স. কে রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করত না। তাহলে, সবকিছুর মূল হল পরকালে হিসাবের ভয়।

শায়খ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘তাদের কুফরের উপর অটল থাকার মূলনীতি ছিল দু’টি। প্রথমঃ একটি অনস্তিত্ব বিষয়কে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ- পুনরুত্থান। দ্বিতীয়ঃ কোরআন ও রাসূলকে মিথ্যার প্রতি সম্পৃক্ত করা। তাই অনস্তিত্বকে ভিত্তি করে অনস্তিত্ব বিষয় দিয়ে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, অর্থাৎ- শীতলতা ও আত্মাপ্রশান্তকারী পানীয় থেকে বঞ্চিত করে। আর অস্তিত্বকে ভিত্তি করে অস্তিত্ব বিষয় দিয়ে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, অর্থাৎ- গরম পানি ও পুঁজ দ্বারা।’(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৩৮।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

কাফেরদের মনে পরকালে হিসাবের ভয় না থাকার কারণে তারা কোরআন ও তাঁর আয়াতসমূহকে তীব্রভাবে অস্বীকার করত। তারা যেহেতু এসবে কঠোর ছিল, তাই আল্লাহ তায়ালাও তাদের কর্মকে গণনা করে রাখবেন কঠোরভাবে। যেমন তিনি বলেনঃ

وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ كِتَابًا (29)

শব্দার্থঃ كُلَّ= প্রত্যেক। شَيْءٍ = বস্তু। أَحْصَيْنَاهُ = আমরা তা গণনা করেছি। كِتَابًا = লিখিত আকারে।

অর্থঃ আমরা সবকিছু লিখিত ভাবে গণনা করে রেখেছি। [আয়াত ২৯]

তাৎপর্যঃ

وَكُلَّ شَيْءٍ : প্রত্যেক বস্তু বা সবকিছু বলতে উদ্দেশ্য হল, শারীরিক কর্ম, কথাবার্তা, মস্তিষ্কজনিত চিন্তা। তবে মনের নিভৃত কোণে প্রাথমিক চিন্তার উৎসারিত বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত নয়। সেসব লিখিত হয় না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তা-ও জানেন। আর মস্তিষ্কজনিত চিন্তার বিষয়ও ফেরেশতারা লিখে রাখেন তথা যদি পুণ্যের কাজ হয় তাহলে সওয়াব লিখে রাখেন। তবে পাপকাজের চিন্তা হলে তা সংঘটিত না হওয়া পর্যন্ত লিখেন না।

যেমন হাদিসে আছে, ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রবের কাছ থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা পুণ্য ও পাপ উভয়টাই লিখেছেন, অতঃপর এটা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। যে ব্যক্তি ভাল কাজের চিন্তা করে কিন্তু সে তা করে না আল্লাহ তার জন্য একটি পূর্ণ সওয়াব লিখেন। আর যে ব্যক্তি তা করে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য তা দশগুণ থেকে সাতশতগুণ বরং আরো অধিক অধিক গুণে বর্ধিত করেন। আর যে ব্যক্তি পাপকাজ করার চিন্তা করে কিন্তু সে তা করে না তাহলে তার জন্য একটি পূর্ণ সওয়াব লিখেন। আর যদি সে তা চিন্তা করে এবং অতঃপর তা সম্পাদন করে তাহলে তার জন্য একটি পাপ লিখেন।’(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬৪৯১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২০৭-১৩১, হাদিসটি সহিহ। )

সহিহ মুসলিম এর বর্ণনায় একটু বৃদ্ধি রয়েছে, তা হলো, আল্লাহ তা (পাপ) মুছে দেন। আর আল্লাহ তায়ালার রোষানলে নিপতিত হবে না কিন্তু যে ধ্বংসশীল।

أَحْصَيْنَا : শব্দটির ক্রিয়ামূল হল إِحْصَاءٌ, মানে গণনা করা। এর মূল ধাতু হল حِصَاءٌ, মানে নুড়ি। কারণ, তখন লোকেরা গণনার ক্ষেত্রে নুড়ি ব্যবহার করত  যাতে গণনা যথাযথ হয়। সূ² রূপে গণনা করাকে إِحْصَاءٌ বলা হয়।

كِتَابًا : এ শব্দটি أَحْصَيْنَا ক্রিয়ার অর্থ থেকে مَفْعُولٌ مُطْلَقٌ (ক্রিয়াবাচক কর্ম) হয়েছে। । আর আল্লাহ مَفْعُولٌ مُطْلَقٌ (ক্রিয়াবাচক কর্ম) -এর ক্ষেত্রে  إِحْصَاءً না বলে  كِتَابًا বলেছেন। কারণ, গণনা বা হিসাব সূ² হওয়ার চরম পর্যায় হল লিখে রাখা। মানে, আমরা লিখে রেখেছি। শব্দ দু’টির অর্থ সূ² ও প্রশ্নাতীত হওয়ার দিক থেকে একই।(তাফসীর ওয়াসীত, ড. মুহাম্মাদ সাইয়িদ, ১৫/২৫৬ ও তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা যুহাইলী, ৩০/১৯। ) এখানে দু’টি শব্দ মূলত দু’টি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। إِحْصَاءٌ বলতে গণনার সূ²তা বোঝানো হয়েছে এবং كِتَابًا বলতে সংরক্ষণের দিক দিয়ে বিশেষ যত্নশীল হওয়া বোঝানো হয়েছে।

তারা যা করত আল্লাহ তা সবিস্তারে জানতেন। তিনি তাঁর ফেরেশতা যারা লেখালেখির কাজে নিযুক্ত, তাদের দিয়ে লওহে মাহফুযে সবকিছু লিখে রেখেছেন। তাদেরকে তাদের কর্মফলের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। এটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকবে না। কিন্তু তবুও কাফেররা তাদের কর্মকে অস্বীকার করবে এবং নিজেকে ব্যতীত অন্য কাউকে সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করবে না। তখন আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে তাদের কর্ণ, দৃষ্টি ও ত্বককে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করাবেন। আল্লাহ বলেন, حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ –অর্থাৎ- যখন তারা সেখানে (জাহান্নাম) আসবে, তাদের বিরুদ্ধে তাদের কর্ণ, দৃষ্টি ও ত্বক সাক্ষ্য প্রদান করবে। [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ১৯]

এÑআয়াতটি جُمْلَةٌ مُعْتَرِضَةٌ বা দুই আয়াত তথা আগের ও পরের আয়াতদ্বয়ের মাঝে আপতিত, অনুপ্রবিষ্ট বাক্য হয়েছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে রাখবেন। অর্থাৎ- লিখে রাখার কাজটি পাপ-পুণ্য উভয়টিরই হবে। ভাল কর্ম হলে ভাল ফল ভোগ করবে, আর মন্দ হলে মন্দ ফল ভোগ করবে। যে যতটুকু ফল ভোগ করার ততটুকুই করবে, এতে কোনো ত্রæটি করা হবে না। কিন্তু কাফেরদের সাজা হবে আরো কঠোর। তারা যেহেতু আল্লাহর উপর ঈমান না এনে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে, তাই সেখানে তাদের শাস্তি আরো ক্রমশঃ বৃদ্ধি করা হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلَّا عَذَابًا (30)

শব্দার্থঃ فَذُوقُوا = সুতরাং তোমরা আস্বাদন কর। فَلَنْ نَزِيدَ = আমরা কক্ষনো বৃদ্ধি করব না। كُمْ= তোমাদের। إِلاَّ = কিন্তু। عَذَابًا = শাস্তি।

অর্থঃ সুতরাং তোমরা আস্বাদন কর। তোমাদের প্রতি শাস্তি ব্যতীত আমরা অন্য কিছু বৃদ্ধি করব না। [আয়াত ৩০]

তাৎপর্যঃ

فَذُوقُوا : فَاءٌ এখানে تَعْلِيلِيَّةٌ বা কারণ দর্শাতে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ওহে কাফেররা! তোমরা যেহেতু পরকাল অস্বীকার করেছ, আল্লাহকে অস্বীকার করেছ, ফলস্বরূপ তোমরা শাস্তি আস্বাদন কর।

فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا : فَاءٌ  এখানে সংযুক্তি বর্ণ হয়েছে এবং শাস্তির পর্যায়ক্রমিক ধারা বর্ণনা করার জন্য এসেছে। এ অংশটুকু তথা আমরা তোমাদের শাস্তি বৈ অন্য কিছু বৃদ্ধি করব না, বোঝায়, কাফেরদের দুঃখ, দুর্দশা আরো বৃদ্ধি পাবে, মনে নিরাশতার উপস্থিতি ঘটবে। কারণ, তারা শয়তানের অনুরসরণ করতঃ পরকালকে অস্বীকার করত, কোরআনকে অস্বীকার করত এবং অন্যান্য খারাপ কাজ করত। তাই তাদের শাস্তি আরো ক্রমশঃ বৃদ্ধি করা হবে। অর্থাৎ- তোমরা যেহেতু পরকালকে অস্বীকার করেছিলে, কোরআন অস্বীকার করেছিলে, এখন সেই অস্বীকার করার দরুণ শাস্তি ভোগ কর।

বৃদ্ধি করা মানে হল একই প্রকার বস্তুর সাথে একই প্রকার বস্তুর সংযুক্তি, অথবা একই প্রকার উদ্দেশ্যের সাথে একই প্রকার উদ্দেশ্যের সংযুক্তি। একটি প্রশ্ন আসে, এখানে যে শাস্তি বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে, তা কীভাবে? কারণ, সমপর্যায়ের আগুনের সাথে সমপর্যায়ের আগুন সংযুক্ত হলে তাতে তো আগুন গুণগত শক্তি বৃদ্ধি পাবে না। এর উত্তরে বলা যায় যে, এটা হতে পারে কয়েকভাবে। প্রথমঃ যখন তারা এক প্রকার শাস্তিতে ভুগতে থাকবে, তখন ভিন্ন আরেকটি শাস্তি যোগ হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, زِدْنَاهُمْ عَذَابًا فَوْقَ الْعَذَابِ –অর্থাৎ- ‘আমরা তাদের জন্য শাস্তির উপর শাস্তি বৃদ্ধি করব।’ [সূরা নাহল, আয়াত ৮৮] যেমন একজন রোগীর এক অসুখের সাথে আরেকটি অসুখ যুক্ত হয়, ফলে তার যন্ত্রণা আরো বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ঃ তারা যে শাস্তিতে ভুগছে সেই শাস্তির মাত্রা বৃদ্ধি করা হবে।

আয়াতটি না-বোধক শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছে এবং পরের অংশ উক্ত আয়াতটির অর্থকে হ্যাঁ-বোধক করে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে, তাদের শাস্তি অনন্তকাল বহাল থাকবে এবং এতে প্রতিনিয়ত নাব্যতা আনা হবে। তাদের শাস্তির মাত্রা ক্রমশঃ বৃদ্ধি করা হবে যাতে কষ্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। কারণ, একই প্রকার শাস্তি পেতে পেতে দেহে তা অনেকটা সহনীয় হয়ে পড়বে। তাই সদা শাস্তি বৃদ্ধি করা হবে, আর এতে তাদের দুঃখ-দুর্দশা ও পেরেশানী আরো বৃদ্ধি পাবে।(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৪২। )

এখানে একটি প্রশ্ন আসে, আল্লাহ বলেছেন, তাদের শাস্তি বৃদ্ধি করা হবে, আবার ২৬ নং আয়াতে বলেছেন, শাস্তি হবে তাদের পাপের অনুযায়ী। তাহলে শাস্তি যদি বৃদ্ধি করা হয়, এটা তো অন্যায় করা হবে তাদের প্রতি, তাই নয় কি? উত্তরে বলতে হয়, তারা পরকালকে অস্বীকার করেছে, কোরআনকে অস্বীকার করেছে, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতঃ আল্লাহকে অস্বীকার করেছে, এসব অস্বীকার করার শাস্তিই হল তাদের শাস্তি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়া। তাই তাদের প্রতি অন্যায় করার প্রশ্নই আসে না। আর যদি ধরে নেয়া হয় যে, শাস্তির শেষ পরিস্থিতির মাত্রা যেটা হবে সেটাই মূল শাস্তি বা সেটাই তাদের প্রাপ্য ও অধিকারী তাহলে প্রথমে যে তাদের প্রতি শাস্তি প্রয়োগে মাত্রা কম হবে এটা হবে তাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণা।(সারর্মমঃ তাফসীর রাযী, ৩১/২১ ও তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/২০।)

ইবনে কাসির লিখেন, আব্দুল্লাহ বিন আমর বলেন, فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا এই আয়াতের চেয়ে জাহান্নামবাসীদের জন্য কঠিন কোনো আয়াত নাযিল হয়নি। তারা সর্বদা কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তিতে ভুগতে থাকবে।

ইবনে কাসির একটি হাদিস উল্লেখ করেন, হাসান বসরী আবু বারযা আসলামীকে জাহান্নামবাসীদের ব্যাপারে কোরআনে কঠিন আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সা. কে পাঠ করতে শুনেছি। তিনি স. পাঠ করলেন, فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا। অতঃপর তিনি বললেন, জাতিরা আল্লাহর নাফরমানী করার কারণে ধ্বংস হয়েছে। ইবনে কাসির বলেন, হাদিসটি দ্বয়ীফ।(তাফসীর ইবনে কাসির, ৮/৩০৮। )

এ আয়াতে একটি প্রশ্ন আসে, আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি জাহান্নামীদের সাথে কথা বলবেন না। যেমন তিনি বলেন, وَلاَ يُكَلِّمُهُمُ اللَّهُ وَلاَ يَنظُرُ إِلَيْهِمْ – অর্থাৎ ‘তাদের সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না এবং তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন না।’ [সূরা আলে- ইমরান, আয়াত ৭৭] অথচ এখানে তিনি তাদের সাথে কথা  বলেছেন এই বলে, অতঃপর তোমরা আস্বাদন কর। এটা কীভাবে হল?

অধিকাংশ ব্যাখ্যাগণ এর উত্তরে বলেন, আল্লাহ তাদের সাথে উপকারমূলক উত্তম ও নরম কথা বলবেন না।(তাফসীর রাযী, ৩১/২১।)

ভাষা অলংকারঃ

আল্লাহ তায়ালা উপরোক্ত আয়াতগুলোতে নাম পুরুষবাচক শব্দ ব্যবহার করেছেন, আর এ আয়াতে মধ্যম পুরুষবাচক ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন এটা বোঝানোর জন্য যে, তাঁর ক্রোধ অতিমাত্রায় পৌঁছেছে, তাই তাদেরকে ধিক্কার দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা আস্বাদন কর।’ ভাষা ব্যবহারের এ ধরনকে আরবিতে اَلْاِلْتِفَاتُ مِنَ الْغَيْبِ إِلَى الْخِطَابِ বা নাম পুরুষ থেকে মধ্যম পুরুষে রূপান্তর বলা হয়। ভাষা অলংকারের দিক থেকে এটা করা হয় শ্রোতা বা পাঠকের রুচিতে পরিবর্তন আনার জন্য।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

তোমরা দুনিয়াতে থাকাবস্থায় পরকালকে অস্বীকার করেছিলে, এখন, যাও, জাহান্নামে প্রবেশ কর। সেখানে দহনশাস্তি আস্বাদন কর। আর আমরা তোমাদের শাস্তি বৈ অন্য কিছু বৃদ্ধি করব না।

১৭ থেকে ৩০ নং পর্যন্ত আয়াতের সাধারণ মর্মার্থঃ

এই আয়াতগুলোর আগে যেসব আয়াত আছে, সেসবে আল্লাহ প্রমাণ করেছেন যে, এ পৃথিবী লয় হবে। আরেকটি পৃথিবী সৃষ্টি করা হবে। তারপর এখানে বলেন, উক্ত পৃথিবীতে সেখানে হিসেব-নিকেশ হবে। তার জন্য নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। উক্ত হিসেব-নিকেশ নির্দিষ্ট সময়েই শেষ হবে। আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রত্যেকের হিসাব একসাথেই হবে এবং এতে কোনো হেরফের হবে না, যেমন তিনি এ ধরায় সবাইকে একসাথে রিযিক প্রদান করেন। শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে। এর আওয়াজ কানে পৌঁছা মাত্রই সকলে জীবিত হবে এবং মু’মিন-মুশরিক, বদকার-নেককার সকলে দলে দলে হাশরের ময়দানে একত্র হবে। সেদিন আসমান বিদীর্ণ হয়ে চৌচির হয়ে দরজার মতো উন্মুক্ত হবে যাতে ফেরেশতারা বান্দাদের হিসাবের দফতর নিয়ে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হোন। পাহাড় উন্মূলিত হয়ে ধূলায় পরিণত হয়ে পাহাড় সদৃশ ভাসমান থাকবে। লোকেরা হিসেবের ডামাডোল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পাহাড়ের আড়ালে অবগুণ্ঠিত হতে চাইবে। কিন্তু গিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে সেটা মরীচিকার মতো ধূলা বৈ কিছু নয়। সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য জাহান্নামে ঘাঁটি থাকবে। তাদেরকে পেরোনোর সুযোগ দেয়া হবে কিন্তু ছাড়পত্র না থাকার কারণে তারা জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবে। কাফেররা সেখানে অনন্তকাল ভুগতে থাকবে। আগুনের তাপে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। একটুখানি শীতলতা অনুভব করার জন্য আকুতি জানাবে, একটুখানি পানীয় যাচনা করবে আত্মাকে শান্ত করার জন্য। কিন্তু তাদের এ বাসনা পুরণ হবার নয়। তাদেরকে দেয়া হবে অতিশয় গরম পানি এবং পুঁজ, বিগলিত চর্বি ও ঘর্ম। তাদের শাস্তি হবে তাদের কর্ম অনুযায়ী। কারণ, তারা পরকালকে অস্বীকার করত, কোরআনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করত। আর এ দু’টোকে অস্বীকার করার কারণে তারা নানা পাপকাজে জড়িত থাকত। কিন্তু আমরা তাদের সকল কর্মকে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি। তারা এসব হিসাব অস্বীকার করলে তাদের কর্ণ, দৃষ্টি ও ত্বক তাদেরই বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করবে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যেহেতু পরকাল, কোরআন, আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকার করতে, এখন তার স্বাদ আস্বাদন কর। তোমাদের শাস্তি বাড়বে বৈ কমবে না। তবে তোমাদের প্রতি শাস্তি প্রয়োগে কোনো অন্যায় করা হবে না। কারণ, শাস্তির চরম মাত্রাই হল তোমাদের মূল শাস্তি, কিন্তু প্রথমে তোমাদের প্রতি এর মাত্রা কম আকারে প্রয়োগ করা হবে এবং ক্রমশঃ তা বর্ধন করা হবে যাতে শাস্তির বিভীষিকা তোমরা ভালভাবে অনুধাবন করতে পার।

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ কিয়ামত দিবসে সবাই একত্র হবে, পাপ-পুণ্যের হিসাব হবে এবং এই দিবসটির নির্দিষ্ট সময় কেবল আল্লাহই জানেন।

দুইঃ কিয়ামতের শুরু হবে কয়েকটি ভয়ংকর জিনিস দ্বারা। তা হল, শিঙায় ফুঁৎকার। অতঃপর লোকেরা কবর থেকে উঠে আসবে। আসমান বিদীর্ণ হবে। পাহাড় মূলোৎপাটিত হয়ে ধূলায় রূপান্তরিত হবে।

তিনঃ সীমালঙ্ঘনকারীদের দোষারোপ বর্ণনা করা হয়েছে এবং যালেমদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে।

চারঃ পরকালকে অস্বীকার করা এবং অস্বীকারকারীদের নিন্দাবাদ করা হয়েছে।

পাঁচঃ মু’মিন ও কাফের সকলের কর্ম লিপিবদ্ধ করে রাখা হয় এবং পরকালে কর্মের প্রতিদান দেয়া হবে।

ছয়ঃ পরকাল ও প্রতিদানের বিশ্বাসের ভিতকে সুদৃঢ় করা হয়েছে।

সাতঃ জাহান্নামীদের শাস্তি অনন্তকালের জন্য। এর কোনো শেষ নেই। তারা কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি ভোগ করবে। তারা শীতলতা ও পানীয় পাবে না।(তাফসীর মুনির, ড. ওযাহবা আল-যুহাইলী, ৩০/২০ ও আইসারুত তাফাসীর, আবু বকর আল-জাযায়েরী, ৫/৫০৪।)

এ সূরাতে যেহেতু সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তিদের প্রশ্নের কথা উল্লেখ করতঃ আল্লাহ উত্তর দিয়েছেন, তাই তাদেরকে হুমকি প্রদর্শনের জন্য শাস্তির কথা আগে উল্লেখ করেছেন। এবং এর পরে জান্নাতবাসীদের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এটা হল কোরআনের সাধারণ ভাষ্যরীতি যে, যেখানেই হুমকি-ধমকি ও শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়, সেখানেই আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসিতার কথা উল্লেখ করা হয়। তবে বর্ণনায় আগপিছ হয়। তাই এমনটি এখানেও ঘটেছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا (31) حَدَائِقَ وَأَعْنَابًا (32) وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا (33) وَكَأْسًا دِهَاقًا (34) لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا كِذَّابًا (35) جَزَاءً مِنْ رَبِّكَ عَطَاءً حِسَابًا (36)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا (31)

শব্দার্থঃ إِنَّ = নিশ্চয়। لِلْمُتَّقِينَ = মুত্তাকীদের জন্য, ভীরুদের জন্য। مَفَازًا = সফলতা।

অর্থঃ আর মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সফলতা। [আয়াত ৩১]

তাৎপর্যঃ

إِنَّ : এটা গুরুত্ববাহী শব্দ। মুত্তাকীগণ যে সফলকাম হবে তা নিশ্চিতকরণের জন্য গুরুত্ববাহী শব্দ এসেছে।

الْمُتَّقِينَ : শব্দটি اِسْمُ الْفَاعِلِ বা কর্তৃবাচ্য Ñবিশেষণের বিশেষ্য। এটা এসেছে تَقْوَى থেকে। এর মাসদার হল  اِتِّقَاءٌএবং মূল ধাতু হলوَقَايَةٌ । মানে বেঁচে থাকা, ভয়। অর্থাৎ ভয়ের কারণেই উক্ত কাজ থেকে দূরে থাকে। الْمُتَّقِينَ এর অর্থ হলঃ যারা আল্লাহর ভয়ে শিরক, গোনাহ তথা হারাম কাজ থেকে নিরাপদে থাকে, এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনে ও উত্তম কাজ করে। আল্লাহ তায়ালা এর সংজ্ঞায় বলেন, الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ Ñ অর্থাৎ- যারা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, এবং আমরা তাদেরকে যা রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। [সূরা বাকারা, আয়াত-৩]

ইমাম রাযী বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, একজন বান্দা ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকীর দরজায় পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না সে সন্দেহযুক্ত কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সন্দেহহীন কাজ থেকে বেঁচে থাকবে।(তাফসীর রাযী, ২/২৫৮। )

অর্থাৎ- সন্দেহহীন বা সমস্যাহীন বা বৈধ কাজ থেকেও বিরত থাকবে যে কাজ করার ফলে সমস্যাযুক্ত কাজে জড়িয়ে পড়ার ভয় আছে।

উক্ত হাদিসটি ইমাম হাকেম তার মুসতাদরাক গ্রন্থে আতিয়া বিন সাআ‘দ থেকে বর্ণনা করেছেন। তবে হাদিসের শুরুতে শব্দে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু অর্থ একই। হাদিসটিকে তিনি শাইখাইন তথা ইমাম বোখারী ও ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবী তার সাথে সহমত পোষণ করেছেন।(মুসতাদরাক লিল-হাকেম, ৬/৩৪৫, হাদিস নং ৭৮৯৯।)

ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, মুত্তাকী হল তারা যারা প্রবৃত্তি কর্তৃক আহূত কাজ পরিহার করে আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার জন্য এবং তাঁর পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সত্য বলে জ্ঞান করে।(তাফসীর রাযী, ২/২৫৮। )

আল্লাহ বলেছেন, اتَّقُوا اللَّهَ – তোমরা আল্লাহকে ভয় কর [সূরা নিসা, আয়াত-১], এবং অন্যত্র বলেছেন, اتَّقُوا النَّارَ-তোমরা জাহান্নামকে ভয় কর। [আলে ইমরান, আয়াত-১৩১] অর্থাৎ- ভয় কর মানে দূরে থাকো, তাহলে অর্থ দাঁড়ায়, তোমরা আল্লাহ থেকে দূরে থাক; তোমরা আগুন থেকে দূরে থাক। তাহলে বিষয়টি কেমন অসমঞ্জস মনে হচ্ছে না?

উত্তর হল, আল্লাহকে ভয় কর বা আল্লাহ থেকে দূরে থাক মানে হল, আল্লাহর একটি গুণ আছে যে, তিনি জালাল বা প্রতাপশালী। এ গুণের দ্বারা আল্লাহ কাফেরদের শাস্তি দেবেন, তাই ভয় করা মানে হচ্ছে, তাঁর জালাল গুণের সম্মুখে একটি পর্দা ঢেলে দেয়া যাতে তিনি আমাদেরকে উক্ত গুণের উপর ভর করে শাস্তি না দেন। অর্থাৎ যেসব কাজ আল্লাহকে ক্রোধভাজনে পরিণত করে সেসব কাজ থেকে দূরে থাকা। আর আগুন থেকে বেঁচে থাকা মানে আমরা এমন কাজ করব যা আমাদের জাহান্নামে প্রবেশের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জাহান্নামের শাস্তি হল আল্লাহর জালাল গুণাবলী থেকে। কারণ এর দ্বারা তিনি কাফেরদেরকে শাস্তি দেবেন।(তাফসীর আল-শা‘রাভী, ১/১৪৭। )

এখানে الْمُتَّقِينَ শব্দটি চয়নে ভাষা প্রয়োগের তাৎপর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সবিশেষ সূ²দর্শন লাভ হয়েছে। কারণ, পূর্বের আয়াতগুলোতে জাহান্নামের শাস্তির কথা উল্লেখিত হয়েছে। আর এখানে জান্নাতের কথা শুরু হয়েছে। আর জান্নাতে প্রবেশ করবে তারাই যারা জাহান্নামের শাস্তির সুমুখে পর্দা ঢেলেছে, মানে জাহান্নামে যাওয়ার কাজটি তারা করেনি, তা থেকে তারা বিরত থেকেছে। আর এটা অর্জিত হয়েছে تَقْوَى বা اِتَّقَاءٌ শব্দ দ্বারা, অর্থাৎ- বেঁচে থাকার শব্দ দ্বারা।

مَفَازًا : মীম এখানে مَصْدَرٌ مِيمِيٌّ, সফলতা বা সফলতার স্থান বা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছা, মানে জান্নাত।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

নিশ্চয় মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সফলতা বা জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত লাভ তথা জান্নাতে বসবাস করার সৌভাগ্য। আর এটা হল দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমানের ফল। সেখানে যা থাকবে সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

حَدَائِقَ وَأَعْنَابًا (32)

শব্দার্থঃ حَدَائِقَ = বাগানসমূহ। وَ = ও, এবং। أَعْنَابًا = আঙ্গুরসমূহ। তবে উদ্দেশ্য হল সকল প্রকার ফল এবং ফলের গাছ।

অর্থঃ বাগানসমূহ ও ফলদায়ক গাছপালাসমূহ। [আয়াত ৩২]

তাৎপর্যঃ

حَدَائِقَ : শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হলে حَدِيقَةٌ। শব্দটির মূল হল حَدَقَةٌ, মানে অক্ষিগোলক। এ অক্ষিগোলকে পানি থাকে। حَدَائِقَ শব্দের তাৎপর্য হল সেখানে নানাজাতীয় ফলমূলের গাছ আছে। উক্ত ফলমূলে পানি থাকে। সেই পানি থাকার দৃষ্টিকোণ থেকে অক্ষিগোলক ও ফলের মাঝে সাদৃশ্য রয়েছে।

أَعْنَابًا : শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হলে عِنَبٌ। মানে আঙ্গুর। তবে উদ্দেশ্য হল সকল ফলমূল। আর আঙ্গুরে যেহেতু পানির ভাগ বেশি, তাই এটির কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

জান্নাতে তাদের জন্য থাকবে বিভিন্ন ধরনের বাগান ও বিভিন্ন ফলের গাছ। তারা ইচ্ছেমতো এগুলোর স্বাদ আস্বাদন করবে। জান্নাতের ফলমূল ও পানীয়-এর কথাই বেশি উল্লেখিত হয়েছে। কারণ, সেখানে কেউ উদরপূর্তির জন্য আহার গ্রহণ করবে না। তারা সেখানে এসব পানাহার করবে কেবল স্বাদ আস্বাদনের জন্য।

وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا (33)

শব্দার্থঃ وَ = ও, এবং। كَوَاعِبَ = উঠন্ত স্তন। أَتْرَابًا = সমবয়সী।

অর্থঃ উঠন্ত স্তনবিশিষ্টা সমবয়সী হুর। [আয়াত ৩৩]

তাৎপর্যঃ

كَوَاعِبَ : শব্দটি বহুবচন। এর একবচন كَاعِبٌ। মানে, উঠন্ত-সুডৌল-বর্ধনশীল স্তন যেটা নুয়ে পড়েনি বা পঞ্চদশী/ ষোড়শী হুর।

أَتْرَابًا : শব্দটি বহুবচন। এর একবচন تِرْبٌ। সমবয়সী। অর্থাৎ- সেখানে তারা হুর পাবে যাদের বয়স ১৫/১৬। সকল হুর হবে সমবয়সী। এখানে এই বয়সী হুর বলার কারণ হল, পুরুষরা এই বয়সী সুন্দরী মেয়েদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করে। কারণ, তাদের চেহারায় একধরনের মনোহর থাকে। এরা ধৈর্যশীল পুরুষদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে, না হোক সেটা প্রবৃত্তির দৃষ্টিকোণ থেকে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

জান্নাতে তারা আপন মনোরঞ্জনের জন্য সমবয়সী হুর পাবে যারা হবে সুডৌল-উঠন্ত স্তনবিশিষ্টা।

وَكَأْسًا دِهَاقًا (34)

শব্দার্থঃ وَ = ও, এবং। كَأْسًا= পেয়ালা। دِهَاقًا = পরিপূর্ণ, ভরা।

অর্থঃ এবং পরিপূর্ণ পেয়ালা। [আয়াত ৩৪]

তাৎপর্যঃ

كَأْسًا : যখন একটি গ্লাসে মদ অথবা পানীয় থাকে তখন তাকে আরবিতে كَأْسٌ বলে। শূন্য গ্লাস বা পেয়ালাকে كَأْسٌ বলে না। উক্ত গøাসগুলো মদে পরিপূর্ণ থাকবে। এ মদ দুনিয়ার মাতাল জাতীয় মদ নয়। তা হল পবিত্র, মাতলামী মুক্ত।

دِهَاقًا : মানে একটি পাত্র পরিপূর্ণ হয়ে চারদিক দিয়ে বেয়ে পড়া। ইবনে আব্বাস বলেন, পরিপূর্ণ। ইকরিমা বলেন, পর্যায়ক্রমে। অর্থাৎ- মদভর্তি পেয়ালা পর্যায়ক্রমে একটার পর একটা আসতেই থাকবে। ইবনে আতা বলেন, এর মানে স্বচ্ছ।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, আহমদ আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৮-১৮৯। )

উক্ত তিনটি অর্থই একসাথে গ্রহণ করা যায়। অর্থাৎ- জান্নাতে স্বচ্ছ মদে পরিপূর্ণ পেয়ালা পর্যায়ক্রমে আসতে থাকবে, যাবৎ তারা তৃপ্ত হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য যে, মদ পানীয়-এর একটি প্রকার। তাই সেটিও জান্নাতে থাকবে। তবে জান্নাতের মদ দুনিয়ার মদের মতো নয়। সেখানকার মদে ঝাঁজ থাকবে না। সেটা হবে পবিত্র, ঝাঁজবিহীন, সুমিষ্ট। কিন্তু দুনিয়ার মদে ঝাঁজ থাকার কারণে তা পরিপৃপ্তি সহকারে পান করা যায় না, ঢক ঢক করে গলাধঃকরণ করতে হয়। কিন্তু ফলের রস বা জুস পান করতে গেলে তা তৃপ্তি সহকারে ধিরে ধিরে পান করা যায়। জান্নাতবাসীরা সেখানে মদ-পানীয়সমূহ জুসের মতো তৃপ্তি সহকারে পান করবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

জান্নাতবাসীদের জন্য তাদের চাহিদা মোতাবেক একের পর একের পর্যায়ক্রমে স্বচ্ছ-পরিপূর্ণ পানীয় বিশিষ্ট পেয়ালা আসতে থাকবে যাবৎ তারা পরিতৃপ্ত হয়ে যাবে।

لَا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا كِذَّابًا (35)

শব্দার্থঃ لاَ يَسْمَعُونَ = তারা শুনবে না। فِيهَا = তার মধ্যে বা সেখানে। لَغْوًا = অনর্থক কথা, ত্রæটিপূর্ণ বা অসম্পূর্ণ কথা। وَلاَ = এবং না অর্থাৎ- এবং শুনবে না। كِذَّابًا = মিথ্যা কথা।

অর্থঃ তারা সেখানে অনর্থক কথা শুনবে না এবং মিথ্যা কথাও শুনবে না। [আয়াত ৩৫]

তাৎপর্যঃ

لاَ يَسْمَعُونَ فِيهَا : তারা শুনবে নাঃ এখানে দু’টি রূপ রয়েছেঃ মুজাহিদ বলেন, জান্নাতে শুনবে না। ইয়াহইয়া বিন সালাম বলেন, পানীয় বা মদ পান করার সময় শুনবে না।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, আহমদ আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৯। )

لَغْوًا : অনর্থক কথার ক্ষেত্রে চারটি রূপ রয়েছেঃ ইবনে আব্বাস বলেন, বাতিল কথাবার্তা। সুদ্দি বলেন, মদ পান করার সময় কসম খাওয়া। মুজাহিদ বলেন, গালিগালাজ দেওয়া। এবং হাসান বসরী বলেন, পাপজনিত কথাবার্তা।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, আহমদ আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৯।)

وَلاَ كِذَّابًا : আর মিথ্যা কথার ক্ষেত্রে তিনটি রূপ রয়েছেঃ সাঈদ বিন জুবাইর বলেন, একে অপরের সাথে মিথ্যা কথা বলবে না। হাসান বসরী বলেন, ঝগড়াঝাটি করবে না। কাতাদা বলেন, পাপজাতীয় কথাবার্তা বলবে না।(তাফসীর আল-মাওয়ারদী, আহমদ আল-মাওয়ারদী, ৬/১৮৯।)

 যদি সেখানে শুনবে না বলতে জান্নাত উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এর তাৎপর্য হল, এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, সেখানকার পরিবেশ পবিত্র, উচ্চ মনমানসিকতাপূর্ণ, যা দেখে মন খুশি হয়। পক্ষান্তরে, দুনিয়ার পরিবেশ এমন নয়। এখানে মু’মিনরা বেদনাদয়ক কথা শুনে, মিথ্যা কথা শুনে, গালিগালাজ শুনে, অনর্থক কথা শুনে। কিন্তু জান্নাত এমন নয়। সেখানে তারা অনর্থক কথা শুনবে না, মিথ্যা কথা শুনবে না। সেটা হল চিরস্থায়ী শান্তির জায়গা এবং সকল ত্রæটি থেকে মুক্ত।(তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আলÑযুহাইলী, ৩০/২৩।)

আর যদি পানীয় পান করার সময় বোঝায়, তাহলে, ‘পান করার সময় শুনবে না’ নিলে এর অর্থ হয়ঃ তারা যখন জান্নাতে মদ বা পানীয় পান করবে তখন অনর্থক কথা ও একে অপরকে মিথ্যা কথা বলবে না -যেমনটা দুনিয়ায় হয়। অর্থাৎ- দুনিয়ায় মদ পান করার সময় মস্তিষ্ক অবসাদগ্রস্ত হয় এবং মাতাল হয়ে আজেবাজে বকে, অনর্থক কথা বলে, একে অপরকে মিথ্যা কথা বলে। কারণ, যখন মস্তিষ্ক ঠিক থাকে না তখন মিথ্যা বলে নাকি বাজে বকে তার কোনো ইয়ত্তা থাকে না। কিন্তু জান্নাতে মদ পান করার ফলে মস্তিষ্ক অবসাদগ্রস্ত হবে না, মাতাল হবে না। ফলে, সে আজেবাজে বকবে না এবং মিথ্যা বলবে না। সুতরাং, যখন মাতাল হয়ে আজেবাজে ও মিথ্যা কথা বলার সময় হয় তখনই যেহেতু মাতাল হবে না, আজেবাজে বকবে না, মিথ্যা কথা বলবে না, তাহলে অন্য সময় তো আজেবাজে বকা ও মিথ্যা কথা না বলাই আরো বেশি যুক্তিযুক্ত।

এই যে অর্থের দ্বৈততা দেখা দিয়েছে, এটা সংঘটিত হয়েছে মূলত فِيهَا শব্দের هَا সর্বনামটির আরোপকে কেন্দ্র করে। এর আরোপ যদি নেয়া হয় পেয়ালা, তাহলে অর্থ হল, জান্নাতে মদ বা পানীয় পান করার সময় অনর্থক কথা শুনবে না। কারণ, দুনিয়াতে মদ পান করার সময় মস্তিষ্কে পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু জান্নাতে মদ পান করার সময় মস্তিষ্কে মাতলামি সৃষ্টি হবে না। আবার এর আরোপ যদি নেয়া হয় জান্নাত, তাহলে অর্থ হল, তারা জান্নাতে অনর্থক কথা শুনবে না।(তাফসীর রাযী, ৩১/২৪। )

আরেকটি প্রশ্ন হল, তারা সেখানে মিথ্যা শুনবে না। এখানে মিথ্যার আরবি শব্দটি হল كِذَّابٌ। এটা আধিক্য অর্থে বোঝায়। মানে তারা অতিমাত্রায় মিথ্যা কথা শুনবে না। যেমন, وَكَذَّبُوا بِـئَايَـاتِنَا كِذَّابًا – অর্থাৎ- তারা আমাদের আয়াতসমূহকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার মতো করে মিথ্যা সাব্যস্ত করল বা অতিমাত্রায় মিথ্যা সাব্যস্ত করল। এখানে এ অর্থটি তাদের কর্তৃক মিথ্যা সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে আধিক্য বোঝানোর জন্য যথার্থই। কিন্তু প্রশ্ন হলে, এখানে তিনি বললেন যে, তারা সেখানে বা জান্নাতে অতিমাত্রায় মিথ্যা কথা শুনবে না, তাহলে বোঝা যায়, তারা কিছু কিছু মিথ্যা কথা শুনবে। যেমন তিনি বলেন, لاَ يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلاَ تَأْثِيمًا Ñঅর্থাৎ- তারা সেখানে অনর্থক কথা শুনবে না, এবং পাপজনিত কথা শুনবে না। [সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত-২৫] এখানে পাপজনিত কথা বলতে উদ্দেশ্য হল বড় মিথ্যা। তাহলে বোঝা যায় তারা ক্ষুদ্র মিথ্যা কথা শুনবে। এখানে মূলত এমনটি উদ্দেশ্য নয়। এখানে আধিক্য বলতে উদ্দেশ্য হল, তারা সেখানে মিথ্যা কথা শুনবে না মোটেও। এখানে আধিক্য বলতে ‘না’ কে প্রভাবিত করা উদ্দেশ্য; মিথ্যাকে নয়। কারণ, ইমাম কেসায়ীর মতে كِذَّابٌ কে كَذِبٌ হালকা বা تَخْفِيفٌ করেও পড়া যায়। আর তখন এটা আধিক্য ও গুরুত্ব উদ্দেশ্য করবে ‘না’ কে। মানে তারা মিথ্যা কথা শুনবে না না না।(তাফসীর রাযী, ৩১/২৪। )

আরবি ভাষার অলংকার শাস্ত্রের একটি বিধান হল, যদি কোনো বিষয়কে ‘না’ করা হয়, তখন এর বিপরীতটি সবিশেষ গুরুত্ব পায়। অর্থাৎ- তারা মিথ্যা কথা শুনবে না মানে হল, তারা সদা সর্বদা সত্য কথা শুনবে, মিথ্যা কথা তাদের নাগালও পাবে না। এ আয়াতের আরেকটি উদ্দেশ্য হল, যেসব দুশমনরা কোরআনকে মিথ্যা বলত, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ফলে, জান্নাতবাসীরা মিথ্যা কথা শোনা থেকে মুক্ত থাকবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

জান্নাত হল একটি পবিত্র স্থান। সেখানে কোনো অনর্থক, আজেবাজে কথা শুনবে না। সেখানে প্রতারণা থাকবে না। তাই কেউ মিথ্যা কথা বলবে না এবং কেউ তা শুনবে না।

جَزَاءً مِنْ رَبِّكَ عَطَاءً حِسَابًا (36)

শব্দার্থঃ جَزَاءً = প্রতিদান। مِنْ = থেকে। رَبِّكَ = আপনার রব। عَطَاءً = দান। حِسَابًا = হিসাব, যথেষ্ট।

অর্থঃ আপনার রবের পক্ষ থেকে রয়েছে প্রতিদান-যথেষ্ট পরিমাণ দান। [আয়াত ৩৬]

তাৎপর্যঃ

جَزَاءً مِنْ رَبِّكَ : আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রতিদান। তথা আমলের বিনিময়ে যে প্রাপ্তি তা উদ্দেশ্য।

 عَطَاءً حِسَابًا : মানে যথেষ্ট পরিমাণ দান।

ইমাম রাযী বলেন, এখানে কয়েকটি মাসআলা রয়েছেঃ প্রথমঃ যাজ্জাজ বলেন, তাদেরকে প্রতিদান দেয়ার মতো প্রতিদান দিয়েছেন, তেমনি দানও দিয়েছেন। এখানে جَزَاءٌ ও عَطَاءٌ বা প্রতিদান ও দান একই অর্থে।

দ্বিতীয়ঃ এখানে আল্লাহ তায়ালা একই বিষয়কে প্রতিদান ও দান বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রতিদান হল যেটা অধিকার প্রমাণের দাবি রাখে। আর দান হল যেটা অধিকার প্রমাণের দাবি রাখে না। আর দুইটা বিপরীতমূখী শব্দ একই সাথে সহাবস্থান নেতিবাচক। উত্তর হল, প্রতিশ্রæতির বিধান অনুযায়ী অধিকার প্রাপ্তির প্রমাণ ঘটে; এমন নয় যে, কাজটি আল্লাহর উপর অত্যাবশ্যক করে দেয় সওয়াব প্রদানকে। সুতরাং আল্লাহ কর্তৃক প্রতিশ্রæতি প্রদান অনুযায়ী সে কাজের প্রতিদান পাবে এবং কাজের ফলস্বরূপ যেহেতু আল্লাহর জন্য সওয়াব দেয়া অবশ্য করণীয় নয়, তাই সে দৃষ্টিকোণ থেকে এটা দান হবে।

তৃতীয়ঃ حِسَابًا শব্দের কয়েকটি রূপ রয়েছে। প্রথমঃ যথেষ্ট পরিমাণ। যেমন বলা হয়, আমার জন্য যা যথেষ্ট তা আমাকে দিয়েছে। দ্বিতীয়ঃ حِسَابًا শব্দটি নেয়া হয়েছে حَسَبْتُ الشَّيْءَ  থেকে। মানে আমি গণনা করেছি, মূল্যায়ন করেছি। আর عَطَاءً حِسَابًا মানে হল, তিনি যে দ্বিগুণ বা কয়েকগুণ বেশি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে অনুযায়ী যা দান করা আবশ্যক। কারণ, প্রতিদানের বিষয়টি আল্লাহ তিনভাবে উল্লেখ করেছেন। একপ্রকার হল দশগুণ, আরেক প্রকার সাতশত গুণ। আরেক প্রকার যার কোনো শেষ নেই। যেমন তিনি বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّـابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ –অর্থাৎ- ধৈর্যশীলদের প্রতিদান অগণিত হিসেবে প্রদান করা হয়। [সূরা যুমার, আয়াত-১০]। তৃতীয়ঃ ইবনে কুতাইবা বলেন, عَطَاءً حِسَابًا মানে অধিক পরিমাণ, أَحْسَبْتُ فُلاَنًا মানে আমি তাকে অনেক দিয়েছি। চতুর্থঃ আল্লাহ তাকে কর্মের সওয়াব দেবেন এবং সাথে সাথে বাড়তি অনেক দানও দেবেন। পঞ্চমঃ কাফেরদের জন্য যেমন আল্লাহ বলেছেন , তেমনি মুমিনদের ক্ষেত্রেও বলেছেন। অর্থাৎ- আমি তোমাদের কর্মের সওয়াব হিসাব করে রেখেছি যাতে তোমাদের কাজের সওয়াবে কোনো কমতি না হয়।(তাফসীর রাযী, ৩১/২৫। )

ভাষা অলংকারঃ

আয়াতসমূহের শেষ শব্দগুলোতে ছন্দ খচিত হয়েছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার আমল অনুযায়ী যতটুকু প্রতিদান প্রাপ্তি তা যথাযথই পাবেন, এবং তাঁর পক্ষ থেকে আরো অধিক পরিমাণে দান পাবেন যা হবে তাঁর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি অনুকম্পা। অর্থাৎ- আল্লাহ আমাদের আমলের বিনিময়ও দেবেন এবং আরো অধিক দেবেন।

৩১ থেকে ৩৬ নং পর্যন্ত আয়াতসমূহের সাধারণ মর্মার্থঃ

আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের শাস্তির কথা বলার পর মুত্তাকীদের জান্নাতে অবস্থান করার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আল্লাহ মানুষকে সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাই সে প্রবৃত্তি বিলাসী। একজন প্রবৃত্তি বিলাসী পুরুষকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, হেমন্তের এক হিমেল বিকেল আপনি কীভাবে কাটাতে চান? সে বলবে, কোনো এক ছায়াবীথি পত্রপল্লবে ঘেরা পার্কে। সাথে থাকবে প্রেয়সী। হাতে থাকবে ড্রিংকস। এমনই একটি বিষয় এখানে ফুটে উঠেছে। দুনিয়ায় প্রবৃত্তির মোহে পড়ে প্রবৃত্তি বিলাসী হওয়া যাবে না। কারণ, এর জায়গা এ দুনিয়া নয়। এর জন্য হল জান্নাত। সেখানে বাগানে হরেক রকমের ফলমূলের গাছ থাকবে। সাথে থাকবে লাস্যময়ী ললনা -সেটাও আবার দু/একটি নয়, একাধিক। কারণ, পুরুষ মাত্রই একাধিক নারীগমনে ইচ্ছাপোষণ করে। এটাই পুরুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আর এজন্যই জান্নাতে থাকবে একাধিক পটলচেরা ডাগর ডাগর হরিণীর ন্যায় আনতনয়না হুর। তারা হবে ষোড়শী কন্যাসদৃশ আকর্ষণীয়া। চেহারায় থাকবে কান্তি, কমনীয়তা ও মনোহর। বাগানে পায়চারী করার সময় এ সকল ললনার পাশাপাশি হাতে থাকবে পানীয়। একটার পর একটা আসতেই থাকবে। তা পান করার ফলে মস্তিষ্কে বিক্রিয়া ঘটবে না। ফলে, বাজে বকবে না, মিথ্যা বলবে না। তারা তাদের কর্মের ফল তো ভোগ করবেই, তদুপরি উদ্বৃত্ত পাবে কয়েকগুণ।

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ মুত্তাকীদের জন্য বিশেষ সম্মান রয়েছে।

দুইঃ জান্নাত হল সুন্দরতম নেয়ামতসমৃদ্ধ স্থান।

তিনঃ মিথ্যা ও অসম্পূর্ণ কথাবার্তা অশোভন।(আইসারুত তাফাসীর, আবু বকর আল-জাযায়েরী, ৫/৫০৭। )

উপসংহারে এসে আল্লাহ তাঁর নিজের বড়ত্বের পরিচয় দিচ্ছেন যে, সেদিন নেতৃত্ব তাঁর হাতে থাকবে, তাঁর নির্দেশ চলবে এবং কাফেরদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা সত্তে¡ও তা অনুসরণ না করার ফলে তারা কী কামনা করবে, তা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الرَّحْمَنِ لَا يَمْلِكُونَ مِنْهُ خِطَابًا (37) يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا (38) ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآَبًا (39) إِنَّا أَنْذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيبًا يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُولُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا (40)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الرَّحْمَنِ لَا يَمْلِكُونَ مِنْهُ خِطَابًا (37)

শব্দার্থঃ رَبِّ = রব, প্রতিপালক। السَّمَاوَاتِ [একবচন: السَّمَاء]= আসমানসমূহ। الْأَرْضِ= জমিন, পৃথিবী। وَمَا = এবং যা/ আর যা। بَيْنَهُمَا = দুই বা উভয়ের মাঝে। الرَّحْمٰنِ = রহমান।  لاَ يَمْلِكُونَ= মালিক হবে না। مِنْهُ = তাঁর থেকে। خِطَابًا = কথা বলা।

অর্থঃ আসমানসমহূ ও জমিন এবং এতদুভয়ের মাঝে যা আছে সেসবের প্রতিপালক হলেন রহমান, তাঁর পক্ষ থেকে তারা কেউ কথা বলার আধিপত্য পাবে না। [আয়াত ৩৭]

তাৎপর্যঃ

আয়াতটি পড়ার ক্ষেত্রে কারীগণ মতভেদ করেছেন। মদীনাবাসীরা رَبُّ ও  الرَّحْمٰنُকে পেশ দিয়ে পড়েছেন। তখন رَبُّ হবে উদ্দেশ্য (ংঁনলবপঃ-مبتدأ ) এবংالرَّحْمٰنُ  হবে বিধেয় (ঢ়ৎবফরপধঃব-خبر )। অথবা رَبُّ একটি উহ্য উদ্দেশ্যের বিধেয় হবে। আর বসরা ও কূফাবাসীরা رَبِّ কে যের দিয়ে এবং الرَّحْمٰنُ  কে পেশ দিয়ে পড়েছেন। কথাগুলো বর্ণনা করার পর, ইমাম তাবারী বলেন, ‘সকলভাবেই পড়া সঠিক। তবে আমার কাছে رَبِّ কে যের দিয়ে পড়া বেশি উত্তম। কারণ, এটা جَزَاءً مِنْ رَبِّكَ এর সাথে সংলগ্ন। এখানে رَبِّكَ যের দিয়ে তাই। এবং الرَّحْمٰنُ  কে পেশ দিয়ে পড়াটা বেশি উত্তম। কারণ, এটা উক্ত অংশ থেকে একটু দূরে।’(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৭৫।)

رَبِّ : রব শব্দের অর্থ হল, প্রতিপালক Ñমানে যিনি দয়ামায়া দিয়ে সবাইকে ও সবকিছুকে লালনপালন করেন। যার যা প্রয়োজন তা ব্যবস্থা করেন। এই রব যিনি আসমান ও জমিনকে সৃষ্টি করেছেন এবং এর মাঝে যারা আছেন যেমন ফেরেশতা, মানবজাতি ও জিনজাতি এবং যা কিছু আছে সবকিছুর জীবন প্রবাহের ব্যবস্থা করেছেন; এতে তিনি কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি। তাই এর বিধেয় হিসেবে ‘রহমান’ শব্দ উল্লেখ করেছেন। এ শব্দটি দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তিনি এ ধরায় মুসলিম-মুশরিক প্রত্যেকের প্রতি দয়াশীল। তা না হলে মুশরিকরা কোনো রিযিক পেত না। আর পরকালে এ শব্দটি সম্পৃক্ত হল কেবলমাত্র মু’মিনদের সাথে। মুশরিকদের সাথে নয়। তারা মু’মিনরা সেখানে অনেক অনেক নেয়ামত পাবে যা তাদের কর্মের তুলনায় বেশি থাকবে।

السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ : আকাশসমূহ ও পৃথিবী -এ দু’টোর সংজ্ঞা আগে চলে গেছে। তবে আকাশসমূহ বলতে যে সপ্ত আকাশ বলা হয়ে থাকে, তন্মধ্যে প্রথম আকাশকে আল্লাহ সুসজ্জিত করেছেন তারকারাজি দ্বারা। এর পর দ্বিতীয়, তৃতীয় -এভাবে সপ্তম আকাশ। আবার আকাশ বলতে পৃথিবীর বায়ুস্তরও বোঝায় যা এটাকে সুরক্ষিত রাখে।

وَمَا بَيْنَهُمَا الرَّحْمٰنِ : এবং এই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর মাঝে যা কিছু আছে – ফেরেশতা, জিন ও মানুষ থেকে শুরু করে সকল প্রকার সৃষ্টি -সবকিছুর প্রতিপালক হলেন আপনার প্রতিপালক যিনি হলেন রহমান। রব বা প্রতিপালক শব্দটিতে তাৎপর্য ও দয়া বেশি, তেমনি রহমান শব্দেও দয়ার পরিমাণ বেশি। আর এর ফলে বিধর্মীরা দুনিয়ায় রিযিক লাভ করে। কিন্তু সেই দয়ার্দ্র প্রতিপালক পরকালে কঠোর হবেন।

لاَ يَمْلِكُونَ مِنْهُ خِطَابًا : তারা কথা বলার আধিপত্য পাবে না -কারণ, সেদিন তারা আল্লাহর প্রতাপ দেখে ভীত হবে। ‘তারা’ সর্বনামের আরোপের ক্ষেত্রে তিনটি মত রয়েছে। প্রথমঃ ইবনে আব্বাস থেকে আতা বর্ণনা করেন, তারা বলতে উদ্দেশ্য হল মুশরিকরা। তারা একে অপরকে খেতাব করবে না। তবে মুসলিমরা একে-অপরের ব্যাপারে সুপারিশ করবে। আর আল্লাহ তাদের সুপারিশ কবুল করবেন। দ্বিতীয়ঃ কাযি বলেন, তারা বলতে উদ্দেশ্য হল মু’মিনগণ। তারা আল্লাহকে কোনো বিষয়ে খেতাব করে কিছু বলার অধিকার রাখবে না। তৃতীয় হল, আসমান ও জমিন এবং এ দুইয়ের মাঝে যারা আছে তারা, তথা যারা সেদিন উপস্থিত থাকবে, যেমন- ফেরেশতা, মানবজাতি, জিনজাতি। আর এ মতটিই অধিক সঠিক। কথা বলার আধিপত্য বা শক্তি না পাওয়া বলতে উদ্দেশ্য হল সকলে। তবে বর্ণনা দৃষ্টে বোঝা যায়, রাজা-বাদশা। কারণ, মজলিসে তাদের কথা বলার জন্য কারো কাছ থেকে তাদের অনুমতি নিতে হয় না। তবে অন্যদেরকে তাদের কাছ থেকে নিতে হয়। পরকালে যেহেতু তাদেরই অনুমতি থাকবে না, তাহলে অন্যদের তো কথা বলার শক্তি থাকার প্রশ্নই আসে না। আবার নিকটবর্তী ফেরেশতাও হতে পারে যারা সবসময় আল্লাহর নির্দেশ পালন করতেন, তাঁর সাথে কথা বলতেন, তারাও সেদিনের ভয়াবহতায় বিহŸল হয়ে পড়বে এবং কথা বলার শক্তি রাখবে না বা সাহস পাবে না। আর কথা বলতে উদ্দেশ্য হল, সেটা হতে পারে আল্লাহ তায়ালার সাথে কথা বলা, অথবা কারো সাথে কোনো বিষয়ে কথা বলা, অথবা কারো ব্যাপারে সুপারিশ করা। তবে এটা সম্ভব হবে কেবল তখনই, যখন আল্লাহ কাউকে অনুমতি দেবেন।(তাফসীর রাযী, ৩১/২১-২২, তাফসীর আল-বাহর আল-মুহীত, আবু হাইয়ান আল-আন্দালুসী, ৮/৪০৭।)

এ আয়াত দ্বারা এ বিষয়টি রহিত করা হয়েছে যে, নেতৃস্থানীয় যে মুশরিকরা মনে করত, তারা দুনিয়াতে যেমন আধিপত্যশীল, পরকাল যদি সংঘটিত হয় তাহলে সেখানেও তারা আধিপত্যশীল হবে।

يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلَائِكَةُ صَفًّا لَا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا (38)

শব্দার্থঃ يَوْمَ = দিন, যেদিন। يَقُومُ = দাঁড়াবে। الرُّوحُ = রূহ -অনেকের মতে জিবরীল আ.। الْمَلاَئِكَةُ = ফেরেশতা। صَفًّا = সারিবদ্ধ হয়ে। لاَ يَتَكَلَّمُونَ  = তারা কথা বলবে না। إِلاَّ = কিন্তু। مَنْ = যাকে। أَذِنَ = অনুমতি দেবেন। لَهُ = তাকে। الرَّحْمٰنُ = রহমান। قَالَ = বলল, এখানে অর্থ হল, বলবে। صَوَابًا = সঠিক।

অর্থঃ যেদিন রূহ এবং ফেরেশতা সারিবদ্ধ হয়ে দণ্ডায়মান হবে, তারা কেউ কথা বলবে না কিন্তু যাকে রহমান অনুমতি দেবেন, এবং সে সঠিক কথা বলবে। [আয়াত ৩৮]

তাৎপর্যঃ

يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلائِكَةُ صَفًّا : মানে যেদিন বা কিয়ামতের দিন। রূহ এবং ফেরেশতা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। এ আয়াতটি সেদিনকার ভয়াবহতার ইঙ্গিত দেয় যে, সেদিন ফেরেশেতারাও ভীত হয়ে সারিবদ্ধ থাকবে এবং কথা বলার সাহস রাখবে না। ফেরেশতা শব্দটির তাৎপর্য পরিষ্কার। তবে রূহের ব্যাপারে আটটি মত রয়েছে। যেমনঃ

প্রথমঃ রূহ হলেন ফেরেশতাদের মধ্য থেকে একজন ফেরেশতা। ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, আল্লাহ আরশের পরে তার চেয়ে প্রকাণ্ড কোনো কিছুই সৃষ্টি করেননি। কিয়ামত দিবসে সে একাই এক সারি হবে, আর অন্যান্য ফেরেশতারা সকলে এক সারি হবে …। ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, রূহ হলেন সপ্ত আকাশ ও সপ্ত জমিন থেকে বৃহদাকার। তিনি দৈনিক বারো হাজার তাসবিহ পাঠ করেন। প্রতি তাসবিহের বিনিময়ে আল্লাহ এক ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। কিয়ামত দিবসে সে একাই এক সারি হবে, অন্যান্যরা আরেক সারি হবে।

দ্বিতীয়ঃ শা‘বী, যাহহাক ও সাঈদ বিন যুবায়ের বলেন, তিনি জিবরীল আ.।

তৃতীয়ঃ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রূহ বলতে উদ্দেশ্য হল আল্লাহর সৈন্যদের মধ্য থেকে এক সৈন্য। তাদের মাথা, হাত ও পা আছে। তারা পানাহার করে।

পঞ্চমঃ ইবনে নাজিহ বলেন, তারা হলেন ফেরেশতাদের সংরক্ষক।

ষষ্ঠঃ হাসান বসরী ও কাতাদা বলেন, রূহ বলতে উদ্দেশ্য হল বনি আদম। অর্থাৎ- রূহবিশিষ্ট।

সপ্তমঃ বনি আদমের রূহসমূহ, যেগুলো সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, অতঃপর ফেরেশতারা দাঁড়াবে। আর এটা সংঘটিত হবে দুই ফুঁৎকারের মাঝখানে, রূহকে দেহে সঞ্চালিত করার পূর্বে।

অষ্টমঃ যায়েদ বিন আসলাম বলেন, এটা হল কোরআন।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৮৭।)

لاَ يَتَكَلَّمُونَ إِلاَّ مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمٰنُ : তারা কথা বলবে না কিন্তু রহমান যাকে অনুমতি দেবেন। তারা বলতে উদ্দেশ্য হল, সেদিন যারা উপস্থিত থাকবে সকলে। তারা কথা বলার শক্তি রাখবে তবে তারা আল্লাহর জালাল দেখে এতটাই ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে যে কথা বলার সাহস পাবে না। কিন্তু আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন। এই অনুমতি দেয়াটা হবে উক্ত ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুকম্পা। তাই এখানে ‘রহমান’ শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন, ‘কিন্তু রহমান যাকে অনুমতি দেবেন’।

এখানে প্রশ্ন আসে, সেদিন তথায় ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন তথা অগণিত ব্যক্তি, জিন, ফেরেশতা থাকবে। প্রত্যেককে এক এক করে তো অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে, অনুমতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে কীভাবে?

এটা হবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। এটা হতে পারে, তাদের আমলনামার ফলাফল যেভাবে তারা পাবে সেভাবেই কোনো বার্তা পাবে যে, সে উক্ত বিষয়ে কথা বলার অনুমতি পেয়েছে। অথবা হতে পারে, অনুকম্পাগ্রহীতা ব্যক্তি কোনো এলহাম পাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে।

وَقَالَ صَوَابًا : এবং সে সত্যÑসঠিক কথা বলবে। অর্থাৎ- আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন সে সত্য-সঠিক বৈ বলবে না।

অর্থাৎ- সেদিনের রাজত্ব হবে কেবল আল্লাহ তায়ালার জন্যই। যেমন হাদিসে আছে, আবু হুরায়রা রাযি. রাসূলুল্লাহ স. থেকে বর্ণনা করেন। তিনি স. বলেন, ‘আল্লাহ জমিনকে মুষ্টিবদ্ধ করবেন, আসমানকে ডানহাতে মুড়িয়ে নেবেন। অতঃপর বলবেন, আমিই বাদশাহ। কোথায় পৃথিবীর রাজা-বাদশাহরা?’(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬১৫৪।) 

দুনিয়াতে রাজা-বাদশাহদের সাথে কথা বলার শক্তি ও সাহস রাখে কেবলমাত্র তারাই যারা তাদের নিকটজন এবং একনিষ্ট সেবক। তেমনি কেয়ামত দিবসে কথা বলার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ। তাঁর প্রিয় বান্দারাই যখন কথা বলার সাহস পাবে না, তখন অন্যরা তো প্রশ্নাতীত ভাবেই কথা বলার সাহস ও সুযোগ পাবে না। তবে কথা বলতে পারবে কেবল দুইটি শর্তেঃ প্রথম শর্তঃ যাকে আল্লাহ কথা বলার অনুমতি দেবেন সে কথা বলবে। যেমন আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يَأْتِ لاَ تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلاَّ بِإِذْنِهِ – অর্থাৎ- সেদিন আসবে, যেদিন কোনো প্রাণ তাঁর অনুমতি ব্যতীত কথা বলবে না। [সূরা হুদ, আয়াত-১০৫]। দ্বিতীয় শর্ত হলঃ সে সত্য-সঠিক কথা বলবে। আর এ কথা হবে সুপারিশ করার জন্য। যদি সুপারিশকারীর জন্য অনুমতি হয় তাহলে উদ্দেশ্য হল, সত্য কথা বলবে, মানে যার ব্যাপারে সে সুপারিশ করবে সেক্ষেত্রে সঠিক কথা বলবে, মিথ্যা সুপারিশ করবে না বা যে জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত নয় তাকে জান্নাতের ব্যাপারে সুপারিশ করবে না। আর যদি অনুমতি সুপারিশকৃত ব্যক্তির জন্য হয় বা যার জন্য সুপারিশ করা হবে সে উদ্দেশ্য হয় তাহলে উদ্দেশ্য হল, সে ব্যক্তি দুনিয়ায় সত্য-সঠিক কথা বলেছে তথা একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল।(তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/২৭। )

ভাষা অলংকারঃ

এখানে রূহ শব্দটি খাস বা নির্দিষ্ট, বিশেষিত এবং মালায়িকা শব্দটি ব্যাপক বা আম। এখানে আমকে খাসের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

সেদিন আল্লাহর বড়ত্ব, প্রতাপ ও ক্রোধ প্রকাশিত হবে, সেদিন তা দেখে সকলে ভীত হবে এবং কেউ কথা বলার সাহস পাবে না, সেদিন আল্লাহর নিকটতম ফেরেশতা জিবরীল ও অন্যান্য ফেরেশতারাসহ সকলে আল্লাহর বড়ত্ব দেখে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, ভয়ে কথা বলার সাহস পাবে না। সেদিন কেবলমাত্র সে-ই কথা বলবে যাকে আল্লাহ কথা বলার অনুমতি দেবেন। এবং সে সুপারিশ করার ব্যাপারে সত্য-সঠিক কথা বলবে যে জান্নাতের উপযুক্ত কেবল তার ব্যাপারে।

ذَلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَآَبًا (39)

শব্দার্থঃ ذٰلِكَ = ঐ, উক্ত দিন। الْيَوْمُ = দিন। الْحَقُّ = সত্য। فَـ = অতঃপর। مَنْ = যে। شَاءَ = কামনা করল, চাইল, তবে এখানে কামনা করে, চায়। اتَّخَذَ = বানিয়ে নিল, ধারণ করল। إِلَىٰ = দিকে। رَبِّهِ = তার রবের। مَئَابًا = আশ্রয়স্থন, প্রত্যাবর্তনস্থল।

অর্থঃ উক্ত দিনটি সত্য। অতঃপর যে যাচনা করে সে তার রবের প্রতি আশ্রয়স্থল বানিয়ে নেয়। [আয়াত ৩৯]

তাৎপর্যঃ

ذٰلِكَ الْيَوْمُ الْحَقُّ : উক্ত দিবস যেদিন কেউ কথা বলার ক্ষমতা রাখবে না, যেদিন সকলে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে, সে দিন বা কিয়ামত দিবসটি প্রকৃতই সংঘটিত হবে। এটা অবশ্যম্ভাবী, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ مَئَابًا : فَاء এখানে فَصِيحَةٌ  হয়েছে। অর্থাৎ- ধারা ভাষ্যমতে এটা একটি উহ্য শর্তের উত্তর হয়েছে। তা হল, তোমরা যখন এসব জানলে, অতঃপর যে তার প্রতিপালকের কাছে আশ্রয়স্থল বানাতে চায়, সে যেন তাই করে এবং এটাই উত্তম আশ্রয়স্থল।

অর্থাৎ- পরকালে কিয়ামত দিবসে খারাপ-ভাল কী হবে তোমরা সবই জানলে। এখন যে ব্যক্তি পরকালে মুক্তিলাভ করতে চায়, যে ব্যক্তি কামনা করে যে, পরকালে তার আশ্রয়স্থল হবে আল্লাহর কাছে। সে যেন এ দুনিয়াতেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে সৎকর্ম করতঃ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। পাপকর্ম বর্জন করতঃ শাস্তি থেকে দূরে থাকে এবং পরকালে আল্লাহর কাছে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করে নেয়। ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেননি। একজন ব্যক্তি এ বিষয়ে স্বাধীন। তবে ঈমান না আনলে এজন্য পরকালে তার শাস্তি হবে।

এ আয়াতটি ইঙ্গিত দেয়, এ দুনিয়া হল আমাদের জন্য ক্ষণস্থায়ী আবাসস্থল। এখানে আমরা যাযাবর সদৃশ। প্রকৃত আবাসস্থল হল পরকাল। সুতরাং যে ¯্রষ্টা ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে প্রেরণ করতে পারেন তিনি প্রশ্নাতীতভাবে স্থায়ী আবাসস্থলের জন্য পুনরুত্থান করতে পারেন, তিনি সক্ষম এবং করবেনও। মৃত্যুর পরই এ সত্যতা সকলের নিকট সত্য বলে উদ্ভাসিত হবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

কিয়ামত দিবসের সবকিছু তোমরা জানলে। উক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত সংঘটিতব্য। তাই যে ব্যক্তি যাচনা করে, পরকালে তার আশ্রয়স্থল হবে জান্নাত, তাহলে সে যেন আল্লাহর প্রতি পথ বানিয়ে নেয় তথা ঈমান আনে। আর যে তা না চায়, সে তার স্বীয় এখতিয়ারাধীন।

إِنَّا أَنْذَرْنَاكُمْ عَذَابًا قَرِيبًا يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ وَيَقُولُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا (40)

শব্দার্থঃ إِنَّا = নিশ্চয় আমরা। أَنْذَرْنَا = আমরা সতর্ক করেছি। كُمْ= তোমাদেরকে। عَذَابًا قَرِيبًا = নিকটবর্তী শাস্তি বা পরকালে অপেক্ষমান শাস্তি। يَوْمَ = যেদিন। يَنْظُرُ = দেখবে, অবলোকন করবে। الْمَرْءُ = মানুষ- নারী ও পুরুষ উভয়ই। مَا = যা। قَدَّمَتْ = অগ্রে পেশ করেছে। يَدَاهُ = তার দুইহাত। وَيَقُولُ = এবং বলবে। الْكَافِرُ = কাফের। يَا لَيْتَنِي  = হায় আফসোস আমি যদি। كُنْتُ = আমি হতাম। تُرَابًا = মাটি।

অর্থঃ নিশ্চয় আমরা তোমাদেরকে নিকটবর্তী শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করেছিলাম, যেদিন মানুষ দেখবে তার কর্ম যা তার দুইহাত অগ্রে পেশ করেছিল। আর কাফেররা বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি মাটি হতাম! [আয়াত ৪০]

তাৎপর্যঃ

إِنَّا أَنْذَرْنَاكُمْ : إِنَّا মানে নিশ্চয় আমরা। সন্দেহ দূরীভূত করার জন্য এসেছে। أَنْذَرْنَا মানে আমরা সতর্ক করেছি। নিশ্চয় আমরা সতর্ক করেছি বলতে সতর্কীকরণটি নিশ্চিত সংঘটিত হয়েছে। তাই, কিয়ামত দিবসে এ জন্য কোনো আপত্তি চলবে না। কেউ বলবে, আমাদের কাছে রাসূল আসেনি -এমন দাবি সেদিন গ্রহণ করা হবে না।

এখানে كُمْ বা ‘তোমাদেরকে’ বলতে আল্লাহ খেতাব করেছেন কুরাইশ গোত্রের কাফের ও আরবের মুশরিকদেরকে, তবে বিশ্বের সকল কাফের-মুশরিক এর অন্তর্ভুক্ত। এ আয়াতে কাফেরদের শেষ পরিণতির কথা উল্লেখ করেছেন। এ আয়াতের ধারাভাষ্য হল, আজ তোমরা পরকালকে অস্বীকার করছ, আমরা তোমাদেরকে নিকটতম শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করছি, কিন্তু তোমরা তা বিশ্বাস করছ না। কিন্তু তোমরা আজ দুনিয়াতে যা করছ সেসবের প্রতিদান কী হবে সেটা পরকালে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করবে।

عَذَابًا قَرِيبًا : ‘নিকটবর্তী শাস্তি’ -বলতে উদ্দেশ্য হল, যা কিছুই ভবিষ্যতে ঘটবে তাই নিকটবর্তী। কারণ, একটি করে দিন গড়িয়ে যাচ্ছে, আর সে দিনটি ঘনিয়ে আসছে। তাছাড়া, প্রতিটি ব্যক্তির মৃত্যুর পরই তার কবরের শাস্তি শুরু হয়ে যায়। একজন মানুষের সাধারণ আয়ু ষাট থেকে সত্তর বা আশি বছর। আর এ দুনিয়ায় সময়কাল ও আমাদের জীবনকাল পরকালের অনন্তর সময়ের তুলনায় অত্যল্পই। তাই, সে তুলনায় শাস্তি অতীব নিকটবর্তী।

يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدَاهُ : যেদিন মানুষ দেখবে যা তার হাত অগ্রে প্রেরণ করেছে। ‘মানুষ দেখবে’- এখানে কয়েকটি মত রয়েছে। প্রথমঃ এ শব্দটি বলতে মু’মিন ও মুশরিক, নারী ও পুরুষ সবাই বোঝায়। সেদিন মু’মিন-মুশরিক প্রত্যেকে তার কৃতকর্মের ফল পর্যবেক্ষণ করবে। যারা তাকওয়াপূর্ণ কাজ করেছে তারা সওয়াবের অধিকারী হবে। আর যারা কুফর করেছে তারা শাস্তি ভোগ করবে। দ্বিতীয়ঃ আতা বলেন, এখানে মানুষ বলতে কাফের উদ্দেশ্য। কারণ, পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে মু’মিনগণ তার কৃত কর্মের ফলও অবলোকন করবে এবং আল্লাহর ক্ষমার পরাকাষ্ঠাও অবলোকন করবেন, কিন্তু কাফেররা স্বীয় কৃতকর্মের ফল তথা শাস্তি বৈ অন্য কিছু অবলোকন করবে না। তৃতীয়ঃ হাসান বসরী বলেন, এখানে মানুষ বলতে উদ্দেশ্য হল, মু’মিন। প্রমাণ স্বরূপ বলেন, আয়াতের পরের অংশে আছে, কাফেররা বলবে, হায় আফসোস! যদি মাটি হতাম! এটা হল কাফেরদের পরিস্থিতির বর্ণনা। তাহলে প্রথম অংশ হবে মু’মিনদের পরিস্থিতির বর্ণনা। দ্বিতীয়তঃ মু’মিনগণ ভাল-মন্দ উভয় ধরনের কর্মই করে। তাই সে ভীত ও আশান্বিত থাকে ফলাফল কী দাঁড়ায়! পক্ষান্তরে, কাফেরদের শাস্তি অনিবার্য। তাই তাদের অপেক্ষার প্রয়োজন নেই যে, ফলাফলা কী দাঁড়াবে। কারণ, অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়ের জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।

যারা বলেন, উত্তম কাজ সওয়াবকে অবধারিত করে এবং মন্দ কাজ শাস্তিকে অবধারিত করে, তারা এ আয়াত দিয়ে প্রমাণ পেশ করেন। তা না হলে, লোকেরা তাদের কৃতকর্মের ফল সওয়াব নাকি শাস্তি অবলোকন না করে অন্য কিছু অবলোকন করত। এর উত্তর হল, এখানে সওয়াব ও শাস্তি হবে আল্লাহর প্রতিশ্রæতি ও নির্ধারণ অনুযায়ী; কিন্তু কর্ম তার স্বীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নয়।(তাফসীর রাযী, ৩১/৩৩।)

وَيَقُولُ الْكَافِرُ يَا لَيْتَنِي كُنْتُ تُرَابًا : আর কাফেররা বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি মাটি হতাম! -তারা মাটি হতে যাচনা করবে; কারণ তারা তাদের কর্মফল দেখবে জাহান্নামে প্রবেশ।

আমরা এ জগতে যেসব কাজ করি, তন্মধ্যে কিছু কাজের ফল আমরা এ দুনিয়াতেই ভোগ করি। আর কিছু কাজ আছে সেসবের ফল আমরা এ দুনিয়াতে ভোগ করতে পারি না। একটি সূত্র হল, কর্তার ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া কর্তার দিকেই প্রত্যানীত হয় -সে দৃষ্টিকোণ থেকে, যেসব কাজ পার্থিব, সেসবের ফল আমরা এ দুনিয়ায় ভোগ করি। পক্ষান্তরে, যেসব কাজ অপার্থিব, সেসবের ফল আমরা এ জগতে ভোগ করতে পারি না। সেসবের ফল ভোগ করব পরকালে। হয়ত জান্নাত নয়তো জাহান্নাম। কাফেররা সেদিন মাটি হওয়ার যাচনা করবে এবং বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি মাটি হতাম! এখানে কয়েকটি ব্যাখ্যা আছেঃ প্রথমঃ কিয়ামত দিবসে মু’মিনগণ তাদের আমলনামা দেখবে, এবং সকল গোনাহের কাজ থেকে ক্ষমার আশা করবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذٰلِكَ لِمَن يَشَآءُ –অর্থাৎ- এছাড়া বা শিরক ব্যতীত তিনি সব গোনাহ ক্ষমা করবেন যাকে চান। [সূরা নিসা, আয়াত ৪৮]

পক্ষান্তরে, কাফেররা ক্ষমার আশা করবে না। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنََّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ –অর্থাৎ- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করাকে ক্ষমা করবেন না।’ [সূরা নিসা, আয়াত ৪৮] তাই কাফেররা কামনা করবে, ইশ! আমি যদি মাটি হতাম! বিধান পালনে বাধ্য হওয়ার জন্য জীবিত না হতাম! দ্বিতীয়ঃ পুনরুত্থানের আগেই যদি মাটি হতাম! এর মানে হল, আমাকে যদি হিসেব-নিকেশের জন্য প্রেরণ করা না হতো। যেমন আল্লাহ বলেন,  يَوْمَئِذٍ يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَعَصَوُا الرَّسُولَ لَوْ تُسَوَّى بِهِمُ الْأَرْضُ – অর্থাৎ- যারা কুফরী করেছে এবং রাসূলের অবাধ্য হয়েছে, সেদিন তারা কামনা করবে, যদি তাদেরকে জমির সাথে মিশিয়ে ফেলা হত। [সূরা নিসা, আয়াত ৪২] তৃতীয়ঃ তারা মাটি হওয়ার যাচনা করবে, কারণ তারা পশুপাখিকে দেখবে, বিচার শেষে তথা কিসাস গ্রহণ শেষে তারা মাটিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। যেমন হাদিসে আছে, আসম আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহর বাণী, أٌمَمٌ أَمْثَالُكُمْ- অর্থাৎ- তোমাদের মতোই উম্মত, এর ব্যাখ্যায় বলেন, কিয়ামত দিবসে চতুষ্পদ জন্তু, সরিসৃপ, পাখিসহ সকল সৃষ্টিজীবকে পুনরুত্থিত করা হবে। প্রত্যেকেই আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায় বিচার লাভ করবে যে, তিনি শিঙহীন প্রাণীকে শিং যুক্ত থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করাবেন। [বিচার শেষে] অতঃপর তিনি সেগুলোকে বলবেন মাটি হয়ে যেতে। তেমনি কাফেররা বলবে, হায় আফসোস! আমি যদি মাটি হতাম!( আল-মুসতাদরাক লিল- হাকেম। হাদিস নং ৩২৩১। তিনি হাদিসটিকে মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহিহ বলেছেন এবং যাহাবী তার সাথে সহমত পোষণ করেছেন। আবার উক্ত কিতাবের ৮৭১৬ নং হাদিসে আছে, কাফেররা প্রাণীগুলোকে মাটি হয়ে যেতে দেখবে, এবং অতঃপর তারাও কামনা করবে মাটি হয়ে যেতে। ) ফলে, সে শাস্তি থেকে মুক্তি পেত। চতুর্থঃ সুফিবাদগণ বলেন, ‘আমি যদি মাটি হতাম’ এর অর্থ হল, ইশ! আমি যদি আল্লাহর অনুসরণে নত হতাম, অহংকারী ও অবাধ্য না হতাম! পঞ্চমঃ কাফের ইবলিস আদম ও তাঁর সন্তান এবং তাদের সওয়াব দেখবে এবং তামান্না করবে সেই বস্তু হতে যেটাকে সে তুচ্ছ সাব্যস্ত করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, خَلَقْتَنِي مِن نَّارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ –অর্থাৎ- আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। [সূরা আ‘রাফ, আয়াত ১২] আল্লাহ তায়ালাই এর ভেদ সম্পর্কে ভাল জানেন।(তাফসীর রাযী, ৩১/৩৩।)

ভাষা অলংকারঃ

আয়াতসমূহের শেষ শব্দগুলোতে ছন্দ খচিত হয়েছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আমরা তোমাদেরকে নিকটতম শাস্তির সতর্কবাণী প্রদান করছি। কিন্তু তোমরা কাফেররা বিশ্বাস করছ না। সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তিই তার আমল পর্যবেক্ষণ করবে যা সে এ দুনিয়ায় পেশ করেছে, এবং তার কর্মফল কী তা-ও পর্যবেক্ষণ করবে। মু’মিনগণ জান্নাতের কামনা করবে। আর পাপী মু’মিনরা ক্ষমালাভের আশা করবে। কিন্তু, কাফের-মুশরিকরা সেদিন মাটি হওয়ার যাচনা করবে। কারণ, তারা দেখবে, শিরকের কোনো ক্ষমা নেই। এর ফল নির্ঘাত জাহান্নামে প্রবেশ।

৩৭ থেকে ৪০ নং পর্যন্ত আয়াতসমূহের সাধারণ মর্মার্থঃ

প্রথম আয়াতটি ইঙ্গিত দেয়, আজ দুনিয়াতে তোমরা প্রতাপশালীরা যারা ইচ্ছেমতো সত্য ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলছ, কোরআন, পরকাল ও রাসূলুল্লাহর সত্যতার ব্যাপারে আপত্তি তুলছ, কিন্তু সেদিন তোমরা সকলে কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলবে। বলা বাহুল্য যে, রাজা-বাদশাহসহ আধিপত্যশীলদের বৈশিষ্ট্য হল, কথা বলার জন্য তারা কারো কাছে কোনো অনুমতি গ্রহণ করে না। কিন্তু সেদিন প্রত্যেকের রাজত্ব রহিত হয়ে যাবে।

সেদিন যাদেরকে কথা বলার অনুমতি দেয়া হবে, কেবলমাত্র তারাই কথা বলবে এবং তারা সত্য-সঠিক বৈ মিথ্যা কথা বলবে না।

শেষ আয়াতে এসে আল্লাহ কাফেরদেরকে হুমকি দিচ্ছেন। শুরু করেছেন তাদের কথার মাধ্যমে এবং শেষও করছেন তাদের কথার মাধ্যমে। অর্থাৎ- তোমরা যারা দুনিয়াতে আজ পরকালের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছ, সন্দেহ করছ, তোমরাই সেই পরকালে শাস্তির খড়গ দেখে মাটিতে রূপান্তরিত হওয়ার কামনা করবে।

শেষের দুই আয়াত প্রমাণ করে, কিয়ামত দিবসে মানুষ দুইভাগে বিভক্ত হবেঃ মু’মিন এবং কাফের। মু’মিনগণ ঈমান আনার কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে এবং তাঁর নিকটবর্তী হবে। আর কাফেররা অস্বীকার করার কারণে তাঁর ক্রোধভাজনে পরিণত হবে।

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ সেদিনের অবস্থা ও পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। কেউ কথা বলার সাহস পাবে না।

দুইঃ পুনরুত্থান ও প্রতিদানের বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করে।

তিনঃ উত্তম কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ করার ব্যাপারে উজ্জীবিত করে।(আইসারুত তাফাসীর, আবু বকর আল-জাযায়েরী, ৫/৫০৭। )

চারঃ শাস্তির ভয়াবহতা পর্যবেক্ষণ করে কাফেররা মাটিতে রূপান্তরিত হতে চাইবে। এ আয়াতটি প্রমাণ করে, মানবজাতি শ্রেষ্ঠ জাতি বলে বিবেচিত হবে যদি সে মু’মিন হয়, তা না হলে, সে চতুষ্পদ জন্তু ও পাখির চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ, সেগুলোর বিচার শেষে মাটিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে, তাদেরকে শাস্তি আস্বাদন করতে হবে না। কিন্তু জাহান্নামী মানবজাতি মাটি হতে চাইলেও তার বাসনা পূরণ হবার নয়।

পাঁচঃ এ সূরাটি প্রমাণ করে, কর্তার ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া কর্তার দিকেই প্রত্যানীত হয়। মু’মিনগণ তাদের ঈমান আনার ফলস্বরূপ জান্নাত লাভ করবে, আর মুশরিকরা ঈমান না আনার ফলস্বরূপ জাহান্নামের অতল গহ্বররে প্রক্ষিপ্ত হবে।

Share this:

Leave a Comment