নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা প্রসঙ্গে

আমরা সকল মাযহাবের মুসলিমরা নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করি। তবে নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার বিধান কী সে বিষয়ে আজ আমরা জানব। নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করার ব্যাপারে দুইটি মত রয়েছে।
হানাফী মাযহাবের মত হল, নামাযে কোরআনের যেকোনো স্থান থেকে পাঠ করা ফরজ। আর সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব এবং নামায সহিহ হওয়ার জন্য এই সূরা পাঠ করা শর্ত নয়। আর ইমাম আহমদ থেকে এমন একটি বর্ণনা আছে। অন্য যেকোনো সূরা অথবা আয়াত পাঠ করলেও নামায হবে তবে সূরা ফাতিহা পাঠ না করার কারণে ওয়াজিব তরক হবে। ফলে নামাযটি ত্রæটিপূর্ণ হবে।

আর জুমহুরগণ বলেন, সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরজ এবং নামায সহিহ হওয়ার জন্য এটা শর্ত।

হানাফী মাযহাবের দলিল হল, আল্লাহ বলেন, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ- কোরআন থেকে যা সহজ হয় তা তোমরা পড়ো। [সূরা মুযযাম্মিলঃ ২০]। এখানে আল্লাহ তায়ালা সূরা ফাতিহা পাঠ খাস না করে যেকোনো জায়গা থেকে সাধ্যমতো পড়তে বলেছেন।

আর জুমহুরদের দলিল হলঃ
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ أَنَّ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ: لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ
অর্থাৎ- উবাদা বিন আস-সামেত থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার নামায নেই বা নামায হল না।
[সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৭২৩, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩৯৪]

হাদিসের বাহ্যিকতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে জুমহুরগণ বলেন, নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরজ। এটা ব্যতীত নামায হবে না।
এ মতভেদটির ভিত্তি হল ফরজ ও ওয়াজিব প্রমাণিত হওয়াকে কেন্দ্র করে। উসূলের কিতাবে এর ব্যবহারে কেউ পার্থক্য করেন আবার কেউ পার্থক্য করেন না। হানাফী মাযহাবে ও ইমাম আহমদের এক মত অনুযায়ী ফরজ হল যা অকাট্য দলিল দিয়ে প্রমাণিত। যেমন কোরআনের আয়াত, হাদিস মুতাওয়াতের ও হাদিস মাশহুর। মুতাওয়াতের হল যে হাদিসের সনদের রাবীদের স্তরে পনের বিশ জন করে রাবী আছেন যারা মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করার ক্ষেত্রে একমত হতে পারেন না। এবং মাশহুরে রাবিদের সংখ্যা এর চেয়ে কম।
আর ওয়াজিব হল যেটা ধারণাপ্রসূত দলিল দিয়ে প্রমাণিত। যেমন খবরে ওয়াহেদ বা যেসব হাদিসগুলো প্রতি স্তরে একজন করে রাবী। যার কারণে হাদিসটি মুতাওয়াতের ও মাশহুরের পর্যায়ে পৌঁছেনি।
তবে কাযী ইবনে বাকিল্লানী বলেন, ফরজ ও ওয়াজিব সমার্থক। তবে ফরজ থেকে কিছু আছে যা ওয়াজিব নয়।
[আত-তাকরীব ওয়াল ইরশাদ, কাযী ইবনে বাকিল্লানী, ১/২৯৪-২৯৫]

একটি বিষয় জ্ঞাতব্য যে, ফরজ যেহেতু অকাট্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত এবং ওয়াজিব ধারণাপ্রসূত দলিল দিয়ে প্রমাণিত, তাই ধারণাপ্রসূত দলিল দিয়ে অকাট্য দলিলের উপর বৃদ্ধি করা যাবে না – এটা হল হানাফী মাযহাবের একটি উসূল।
হানাফী মাযহাব সূরা ফাতিহা পাঠ করাকে ওয়াজিব বলেন। তারা ফরজ বলেন না। কারণ, কোরআন দ্বারা যেকোনো আয়াত বা সূরা পাঠ করা ফরজ। কোরআন হল অকাট্য দলিল। আর সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব হয়েছে হাদিস তথা খবরে ওয়াহেদ দ্বারা। আর এই খবরে ওয়াহেদ দ্বারা কোরআনের বিধানের উপর অতিরিক্ত করে বলা যাবে না যে, সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরজ। কারণ, এই অতিরিক্তকরণটি তাদের নিকট নসখ হবে তথা কোরআনের বিধানকে রহিতকরণ করা হবে। আর কোরআনের বিধানকে খবরে ওয়াহেদ দ্বারা রহিত করা জায়েয নাই বা প্রমাণিত হবে না।
[হেদায়া ১/৪৮, কাশফুল আসরার ২/৩০৪, আল-বেনায়া -আইনী, ২/১৬৬]

তাহলে সূরা ফাতিহা পাঠের ক্ষেত্রে কোরআন যা অকাট্য এবং খবরে ওয়াহেদ যা ধারণাপ্রসূত -এ দুইটিতে সাংঘর্ষিক হচ্ছে। কোরআন বলে যেকোনো সূরা পাঠ করা ফরজ আর হাদিস বলে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে। উভয়টিকে বহাল রাখতে গিয়ে হানাফী মাযহাব বলে, কোরআনের আয়াত অনুযায়ী কোরআনের যেকোনো সূরা পাঠ করা ফরজ। আর হাদিস দ্বারা সূরা ফাতেহা পাঠ করা ওয়াজিব। তাহলে, দুইটি বিধানকে আপন স্থানে রেখে আমল করা হয়ে গেল। তবে যদি কেউ বলে যে, সূরা ফাতেহা পাঠ করা ফরজ তাহলে এর দ্বারা কোরআনের বিধান তথা যেকোনো সূরা পাঠ করা ফরজকে রহিত করা হল বা অকাট্য দলিল যাতে কোনো সন্দেহ নেই তথা কোরআনের আয়াতের মান খর্ব করা হল। এই উভয়টিই ত্রুটিপূর্ণ। তাই সূরা ফাতিহা পাঠ করাকে ফরজ বলে আমল করা যাবে না।
[উসূলুস সারাখসী, ১/১১২-১১৩]

হানাফী মাযহাব তাদের মতের সমর্থনে নামাযে ত্রæটিকারী ব্যক্তির হাদিস দিয়ে দলিল পেশ করেন। তা হলঃ
… ثم قَالَ له النبي صلى الله عليه وسلم: إِذَا قُمْتَ إِلَى الصَّلاَةِ فَكَبِّرْ ثُمَّ اقْرَأْ مَا تَيَسَّرَ مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ…
অর্থাৎ- নামাযে ত্রুটিকারী ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যখন নামাযে দাঁড়াও, তাকবীর বলো, অতঃপর কোরআন থেকে যা সহজ হয় পড়।
[সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৭২৪, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩৯৭]

জুমহুরগণ উক্ত আয়াতের উত্তরে বলেন, এটা রাতের নামাযের সাথে বা তাহাজ্জুদের সাথে খাস, যেমন ইবনে আব্বাস বলেছেন।
[আয-যখীরা, ২/১৮৪, নাইলুল আওতার, ৩/১১৭৩]

তবে আবু বকর আল-জাসসাস তাদের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, যদিও আয়াতটি রাতের নামাযের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে তবে এর মূলনীতি বা বিধান হল ব্যাপক। অর্থাৎ অবতীর্ণ হওয়া খাস বা বিশেষায়িত তবে হুকুম ব্যাপক। এর প্রমাণ হল ত্রুটিকারী ব্যক্তির নামায।
[আহকামুল কোরআন, ১/১৯]

জুমহুরগণ এর উত্তরে বলেন, ত্রুটিকারী ব্যক্তির নামাযে কিরাত পড়ার দ্বারা ফাতিহা সম্ভাবনা রাখে, অথবা তিনি সূরা ফাতিহা পাঠ করতে পারতেন না, হয়তো সূরা ফাতিহা অবতীর্ণ হওয়ার আগে ছিল, এসব সম্ভাবনা থাকার কারণে প্রমাণ দেয়া সঠিক হবে না।
[আল-মুগনী, ১/৫২০, ফাতহুল বারী ২/২৪৩, আল-মুহাল্লা ৩/২৩৯]

মুহাম্মাদ বিন কুদামা হানাফী মাযহাবের দলিল তথা এই ত্রুটিকারী ব্যক্তির নামাযের হাদিস সম্পর্কে বলেন, যার সারমর্ম হল, আমরা একমত হয়েছি যে, তিনি নামাযে ত্রæটিকারী ছিলেন এবং আমরা একমত হয়েছি যে, যে ব্যক্তি নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে না সে ত্রুটিকারী হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি সূরা ফাতিহা নির্দিষ্ট না করে তাকে যেকোনো জায়গা থেকে পড়তে বলে থাকেন, তাহলে সূরা ফাতিহা পাঠ না করার কারণেও তিনি ত্রুটিকারী থাকবেন। এই ত্রুটি তার থেকে দূর হবে না। তবে এটা অন্যান্য সূরার ক্ষেত্রে এমন নয়। কারণ, যদি সে সূরা ফাতিহা পাঠ করে এবং অন্যান্য সূরা পাঠ না করে তাহলে সে ত্রুটিকারী থাকবে না।
[আল-মুগনী, ১/৫২০]

ইবনে কুদামার কথাটি প্রকারান্তরে হানাফী মাযহাবের সাথে মিলে যাচ্ছে। কারণ, হানাফী মাযহাব মতে কেউ যদি সূরা ফাতিহা পাঠ না করে অন্য কিছু পাঠ করল তাহলে কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক ফরজ আদায় হলেও হাদিসের নির্দেশ মোতাবেক সূরা ফাতিহা পাঠ না করার কারণে ওয়াজিব আদায় হল না। ফলে, নামায ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে সে ত্রুটিকারীই হয়ে গেল।

আর হানাফী মাযহাব যে বলেছে সূরা ফাতিহা পাঠ করাকে ফরজ করলে খবরে ওয়াহেদ দ্বারা কোরআনের উপর বৃদ্ধি করা হয় যা জায়েয নাই। কারণ, এর দ্বারা কোরআনের বিধানকে রহিত করা হয়- এর উত্তরে জুমহুরগণ বলেন, সূরা ফাতিহা পাঠ করার হাদিসটি খবরে ওয়াহেদ নয় বরং এটা মুতাওয়াতের এবং মাশহুর। উম্মত এটাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। এ হাদিসটিকে কাত্তানী, গুমারী এবং বোখারী মোতাওয়াতের হাদিসে গণনা করেছেন।
[নযমুল মুতানাছের, ৬২-৬৩, আল-এতহাফ লিল গুমারী, ৮৬]

খবরে ওয়াহেদ দ্বারা কোরআনের উপর হানাফী মাযহাবে বৃদ্ধি করা জায়েয না থাকলেও তবে অন্যান্য মাযহাবে তা জায়েয। কারণ, এর দ্বারা তারা কোরআনের বিধানকে রহিতকরণ উদ্দেশ্য করেন না। বরং কোরআনের বর্ণনা হিসেবে গ্রহণ করেন।

তবে আইনী সূরা ফাতিহার হাদিসটিকে মাশহুর হওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, তাবেয়ীগণ এ মাসআলায় মতভেদ করেছেন। আর মাশহুর হল যেটা তাবেয়ীগণ গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া মাশহুর হাদিস দ্বারা অতিরিক্ত করা জায়েয আছে যদি অন্য কোনো অর্থের সম্ভাবনা না থাকে। কিন্তু উবাদার হাদিসটি সম্ভাবনা আছে যে এটা পরিপূর্ণতাকে নিষেধ করেছে। নামায সঠিক হওয়াকে নিষেধ করেনি। কারণ, সহিহ মুসলিমে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ صَلَّى صَلاَةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَهْىَ خِدَاجٌ
অর্থাৎ- যে ব্যক্তি নামায পড়ল তবে তাতে সূরা ফাতেহা পাঠ করল না তাহলে তা ত্রুটিপূর্ণ হল। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩৯৫]
[আল-বেনায়া, ১/১৬৪-১৬৫]

তবে আইনীর প্রতি একটি প্রশ্ন উঠে যে, তাবেয়ীনদের মধ্যে কে কে মতভেদ করেছেন তাদের নাম তিনি উল্লেখ করেননি। তাই তার কথাটিতে অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে দুই-একজন যদি মতভেদ করে থাকেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং, যদি ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পাঠ করল না, তার নামায নেই বা নামায হল না’ -হাদিসটিকে মুতাওয়াতের অথবা মাশহুর বলে গণ্য করা হয় তাহলে হানাফী মাযহাবেও এর দ্বারা কোরআনের উপর বৃদ্ধি করা জায়েয আছে তথা সূরা ফাতিহা পাঠকে ফরজ বলা জায়েয আছে। তবে সম্ভাবনা আছে যে, আবু হানীফার সময়ে এটি মুতাওয়াতের বলে আখ্যায়িত হয়নি। ফলে, তিনি এর দ্বারা সূরা ফাতিহা পাঠকে ফরজ বলেননি। কারণ, এটা মুতাওয়াতের হওয়ার কথা বলেছেন আবু হানীফার পরের ওলামা তথা ইমাম বুখারী। যেমন তিনি এই মাসআলার ক্ষেত্রে বলেন, মুসলিমবিশ্বের সকল নামাযী তাদের দিনে ও রাতের নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠের ব্যাপারে একমত হয়েছে। আল্লাহর বাণী, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ- কোরআন থেকে যা সহজ হয় তা তোমরা পড়ো। [সূরা মুযযাম্মিলঃ ২০]। প্রমাণ করার জন্য এটাই সর্বোত্তম।
[আল-কিরাআতু খলফাল ইমাম, ইমাম বুখারী, পৃষ্ঠা ৬৩।]

ইবনে আবি শাইবা, তিরমিযী উমর, আলী ও অন্যান্য সাহাবাদের থেকে বর্ণনা করেন যে, ফাতিহা ব্যতীত নামায সঠিক হবে না এবং এ ব্যাপারে সাহাবাদের মধ্যে মতভেদ নেই। বুখারী ও বাইহাকী তেমনিভাবে জাবের থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা বলতাম যে নামায যথেষ্ট হবে না যে নামাযে ফাতিহা পাঠ করা হয় না।
[আল-মুহাল্লা ৩/৩৭, ইবনে আবি শাইবা, ১/৩৬০, আল-কিরাআতু খলাফাল ইমাম, বাইহাকী, ৪৮, আল-কিরাআতু খলফাল ইমাম, বুখারী, নং ২৮৭, তিরমিযী ২/২৬]

হানাফী মাযহাব যে, আবু উবাদার হাদিস তথা ‘যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পাঠ করল না, তার নামায নেই বা নামায হল না’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল নামায পরিপূর্ণ হওয়াকে নিষেধ করেছে, সঠিক হওয়াকে নিষেধ করেনি। এটা শরিয়তের তাৎপর্যের নিকটতম হয়। এটা হল মূল এবং এর জন্য জন্য একটি অনুমান বা ইঙ্গিতের প্রয়োজন। [নাইলুল আওতার, ৩/১১৭১, ফাতহুল বারী ২/২৪১] আর এর স্বপক্ষে ইঙ্গিতটি হল ‘যে ব্যক্তি নামায পড়ল তবে তাতে সূরা ফাতেহা পাঠ করল না তাহলে তা ত্রুটিপূর্ণ’ – এই হাদিস দ্বারা দলিল দিয়েছেন। এ হাদিসটি প্রমাণ করে সূরা ফাতিহা পাঠ না করার কারণে পরিপূর্ণতাকে নিষেধ করা হয়েছে।

এর উত্তরে জুমহুরগণ বলেন, হাদিসে لاَ صَلاَةَ বা তার নামায নেই এটা সম্ভাবনা রাখে যে এর মানে না-বোধক বলে নিষেধসূচক নির্দেশ উদ্দেশ্য। অর্থাৎ لاَ تُصَلُّوا বা তোমরা নামায পড়ো না। অর্থাৎ- তোমরা সূরা ফাতিহা পাঠ করা ব্যতীত নামায পড়ো না। যেমন এর উপমা হল, ইমাম মুসলিম আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لاَ صَلاَةَ بِحَضْرَةِ الطَّعَامِ – অর্থাৎ- খাবারের উপস্থিতিতে নামায নেই। [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৫৬০]। ইবনে হিব্বান এটাকে বর্ণনা করেন, لاَ يُصَلِّي أَحَدُكُمْ بِحَضْرَةِ الطَّعَامِ – তোমাদের কেউ যেন খাবারের উপস্থিতিতে নামায আদায় না করে। [ইবনে হিব্বান, হাদিস নং ২০৭৪]। এখানে لاَ صَلاَةَ কে لاَ يُصَلِّي বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

তবে তাদের এ ব্যাখ্যায় তথা لاَ صَلاَةَ বা তার নামায নেই মানে لاَ تُصَلُّوا বা তোমরা নামায পড়ো না- এখানে দুর্বল বাক্য দ্বারা সবল বাক্যকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যা মানদণ্ডের দিক দিয়ে দুর্বল। কারণ, لاَ صَلاَةَ হল নামবাচক বাক্য এবং لاَ تُصَلُّوا হল ক্রিয়াবাচক বাক্য। আর জ্ঞাতব্য যে, নামবাচক বাক্য ক্রিয়াবাচক বাক্য থেকে উত্তম। তারা যে এই ব্যাখ্যা করেছেন তার স্বপক্ষে হাদিস উল্লেখ করেন, لاَ صَلاَةَ بِحَضْرَةِ الطَّعَامِ – অর্থাৎ- খাবারের উপস্থিতিতে নামায নেই, لاَ صَلاَةَ এখানে ইবনে হিব্বানের বর্ণনায় لاَ يُصَلِّي أَحَدُكُمْ এসেছে। এটাকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা দুর্বল হবে। কারণ, হতে পারে কোনো রাবি নামবাচক বাক্যকে অর্থগতভাবে ক্রিয়াবাচক বাক্য দ্বারা বর্ণনা করেছেন।

জুমহুরগণ আরেকটি উত্তর দেন, আবু হুরায়রার হাদিসে যে খেদাজ শব্দটি এসেছে তার অর্থ ত্রুটিপূর্ণ- এর উদ্দেশ্য হল এর সাথে নামায যথেষ্ট হবে না, এটা আবু বকর বিন খুযায়মা উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রার হাদিস দিয়ে দলিল দেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لَا تُجْزِئُ صَلَاةٌ لَا يُقْرَأُ فِيهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ – নামায যথেষ্ট হবে না যে নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা হয় না। [দারাকুতনী, ১/৩২১-৩২২] এবং বলেন সনদটি সহিহ। এটা স্পষ্ট বর্ণনা যে, উবাদা বিন আস-সামেতের হাদিসে নামায সঠিক হবে না, যথেষ্ট হবে না। পরিপূর্ণতা উদ্দেশ্য নয়। হাদিসকে এ অর্থে গ্রহণ করা উত্তম। কারণ এটা স্পষ্ট, এতে ভিন্ন অর্থের সম্ভাবনা নেই। আর ত্রুটিপূর্ণের হাদিসটি সম্ভাবনাময় বা কয়েকটি অর্থ ধারণ করে।

এখানে তাদের দলিলে لَا تُجْزِئُ মানে যথেষ্ট হবে না- এর সমার্থক শব্দ হল ত্রুটিপূর্ণ হবে, কম হবে। অর্থাৎ- تُجْزِئُ এর মাসদার হল إجزاء। এর মানে কাউকে অমুখাপেক্ষী করা, যথেষ্ট করা। যেমন কারো ৫০০ টাকার প্রয়োজন। আপনি তাকে ৫০০ টাকা দিলেন তাহলে যথেষ্ট হয়ে গেল। তবে যদি আপনি ৪০০ টাকা দেন তাহলে যথেষ্ট হল না। সে অমুখাপেক্ষী হল না। তার আরো কিছুর প্রয়োজন রয়ে গেল। তাই জুমহুরগণ যে ব্যাখ্যা করলেন সূরা ফাতিহা ব্যতীত নামায সঠিক হবে না সে ব্যাখ্যাটি সঠিক হচ্ছে না। তবে ত্রুটিপূর্ণ থাকবে। আর এটা হানাফী মাযহাব দ্বারাও বোঝা যায়। কারণ, ওয়াজিব তরক করলে নামায যথেষ্ট হয় না বা পরিপূর্ণ হয় না। তা ত্রæটিপূর্ণই থেকে যায়।

ইমাম বুখারী নামাযে ত্রুটিকারী ব্যক্তির হাদিস সম্পর্কে বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, তুমি তাকবীর বল, আল্লাহর প্রশংসা কর বা ছানা পড় এবং উম্মুল কোরআন পড়। [আল-কিরাআতু খালফাল ইমাম লিল-বুখারী, হাদিস নং ১০০]। এটা আরেকটি বর্ণনায় যে আছে, ‘কোরআন থেকে যা সহজ তা পাঠ করো’ হাদিসকে ব্যাখ্যা করে যে যা সহজ হল বলে সূরা ফাতেহা উদ্দেশ্য। কারণ, এটা কোরআনে সবচেয়ে সহজ। শেখা ও মুখস্ত করাও সহজ। আর কোরআনের বর্ণনার উপর বৃদ্ধিকরণের যে কথা বলা হয়েছে যে, উবাদার হাদিস যেটা মাশহুরও নয় এবং মুতাওয়াতেরও নয়। এটা খবরে ওয়াহেদ যা দ্বারা কোরআনের আয়াতের উপর বৃদ্ধি করা যাবে না সে বিষয়ে ইমাম শওকানী বলেন, এটা রহিত হয়ে যায়। কারণ, فَاقْرَءُوا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ- কোরআন থেকে যা সহজ হয় তা তোমরা পড়ো – এ আয়াত দ্বারা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ করার মাঝে অনুমতি দেয়া হয়েছে যেটা সহজ হয়। আর এটা যন্নী বা ধারণাপ্রসূত হয়ে যায়। এটা আর অকাট্য থাকে না। আর খবরে ওয়াহেদ হল যন্নী যা দ্বারা কোরআনের আয়াতের ব্যাপকতাকে রহিত করা যাবে। [নাইলুল আওতার, ১/২৫২-২৫৩]

ইমাম শওকানী যে বলেছেন কোরআন থেকে যা সহজ হয় তা তোমরা পড়ো- এটা যন্নী বা ধারণাপ্রসূত। বিষয়টি এমন নয়। এ আয়াত হল আম বা ব্যাপক। ফলে এটা কাতয়ী বা অকাট্যের হুকুমে থাকবে। এখানে খবরে ওয়াহেদ যা যন্নী তা দ্বারা খাস করা যাবে না। বরং আরেকটি দলিল কাতয়ী বা অকাট্য প্রমাণ দিয়ে এখান থেকে কিছু খাস করার পর এ আয়াতটি যন্নী হবে, অতঃপর, ফাতিহা পাঠের হাদিস দ্বারা এটাকে রহিত করা বা খাস করা যাবে। কিন্তু এখানে এমন কোনো আয়াত ও অকাট্য দলিল নেই যা আয়াতের ব্যাপকতাকে খাস করে।

সারকথা হল, যে যে মত গ্রহণ করেছেন সে পক্ষে হাদিসকে সেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আর সূরা ফাতিহা ব্যতীত নামায সঠিক না হওয়ার হাদিসটি আবু হানীফার সময় মাশহুর অথবা মুতাওয়াতেরের পর্যায়ে ছিল না। ফলে এর দ্বারা তারা কোরআনের বিধানের উপর সূরা ফাতিহা পাঠ করা ফরজ হওয়ার বিধানটি প্রমাণ করেনি।

এখানে আরেকটি বিষয় হল, একজন ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর নামাযের সময় হল। সে আলহামদুল্লিাহ, আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ ইত্যাদি শব্দ ব্যতীত আর কিছু জানে না। সে যদি এসব বলে নামায আদায় করে তাহলে জুমহুরদের মতে নামায হবে না। তবে হানাফী মাযহাব মতে নামায হয়ে যাবে। কারণ, এ শব্দগুলো কোরআনের অংশ। তবে ত্রুটিপূর্ণ হবে। সুতরাং, বলা যায় এক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবে প্রশস্ততা রয়েছে। তবে সূরা ফাতিহা পাঠ করলে কোরআন ও হাদিস উভয়টি সম্পর্কে আমল হয়ে যায়। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

প্রণয়নেঃ
কামারুজ্জামান বিন আব্দুল মালেক
আল-শিবলী আল-আযহারী

Share this:

Leave a Comment