তিন তালাকের বিধানঃ

Print Friendly, PDF & Email

الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى، وبعد

তিন তালাকের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। যেমনঃ
প্রথমঃ প্রত্যেক ঋতু¯্রাবের পর একটি করে তালাক প্রদান তথা তিন ঋতু¯্রাবের পর তিনমাসে তিনটি তালাক দেয়। এটা হল সুন্নত। তবে এক তালাক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া অতি উত্তম। এভাবে যদি কেউ তিন মাসে তিন তালাক দেয় এবং উক্ত স্ত্রীকে যদি স্বামী ফিরিয়ে আনতে চায়, তাহলে উক্ত নারীকে আরেকজনের সাথে বিয়ে দিতে হবে, তাদের রতিক্রিয়া হতে হবে এবং উক্ত স্বামী যদি তাকে তালাক দেয় অথবা মারা যায় তারপর ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পর প্রথম স্বামী তাকে পুনরায় বিয়ে করতে পারবে।

দ্বিতীয়ঃ এক মাসে তিন তালাক প্রদান করা। এক মাসে তিন তালাক প্রদানের অনেক প্রকার রয়েছে। যেমন, এক কথায় বলা। স্বামী স্ত্রীকে বলল, তোমাকে তিন তালাক। আরেক ধরন হল, এক শব্দে তিন তালাক না দিয়ে তিনটি পৃথক পৃথক বাক্য দিয়ে তিনবার তালাক দেয়া। যেমন স্বামী স্ত্রীকে বলল, তুমি তালাক, তালাক, তালাক। অথবা, তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক। অথবা, তুমি তালাক, অতঃপর তালাক, অতঃপর তালাক -এভাবে দশ তালাক দিক আর একশত তালাক দিক।

এক্ষেত্রে আলেমদের মাঝে তিনটি মত রয়েছে। স্ত্রীর সাথে রতিক্রিয়া সম্পন্ন হোক বা না হোক। তবে সালফ বা পূর্ববতী আলেমগণ রতিক্রিয়া সম্পন্না স্ত্রী ও রতিক্রিয়াহীনা স্ত্রীর মাঝে পার্থক্য করেছেন। এক্ষেত্রে চতুর্থ আরেকটি মত আছে। তবে তা নবাবিষ্কৃত। এর বাস্তবতা নেই।
প্রথম মত হলঃ এমন তালাক মোবাহ বা বৈধ এবং তা আবশ্যকীয় হবে বা পতিত হবে। এ মতটি হল ইমাম শাফেয়ী ও ইমাম আহমদ-এর।
দ্বিতীয় মত হলঃ এমন তালাক হারাম, তবে তা আবশ্যকীয় হবে বা পতিত হবে। এ মতটি হল ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক-এর, এবং ইমাম আহমদ-এর আরেক মত।
তৃতীয় মত হলঃ এমন তালাক হারাম এবং তা আবশ্যকীয় নয় বা পতিত হবে না। এক্ষেত্রে মাত্র একটি তালাক পতিত হবে। আর এ মতটিই হল, অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও সালফ ও খালফদের মত।
সাহাবীদের মধ্যে থেকেঃ যুবায়ের বিন আল-আওয়াম, আব্দুর রহমান বিন আওফ, আলী বিন আবু তালেব, ইবনে মাসউদ এবং ইবনে আব্বাস-এর এক মত।
তাবেয়ীদের মধ্যে থেকেঃ তাউস, খেলাস বিন আমর, মুহাম্মাদ বিন ইসহাক, এবং এটাই ইমাম দাউদসহ তার সাথিদের মত। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ-এর অনুসারীদের অনেকের মত।
চতুর্থ মতঃ মু‘তাযেলা ও শিয়াদের মধ্যে থেকে অনেকে বলেন, এক্ষেত্রে কোনো তালাক হবে না। তবে এ ধরনের মত কোনো সালফ ও খালফদের থেকে বর্ণিত হয়নি। তাই এটি গ্রহণ যোগ্য নয়।
আর তৃতীয় মতটির ব্যাপারে কোরআন ও হাদিস প্রমাণ বহন করে। রতিক্রিয়া সম্পন্না স্ত্রীর সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যায়ে যে তালাকের বিধান আল্লাহ দিয়েছেন তা হল তালাক রজয়ী। আল্লাহ একত্রে তিন তালাকের বিধান প্রদান করেননি। এবং রতিক্রিয়া সম্পন্না স্ত্রীর ব্যাপারে প্রথমেই বায়েন তালাকেরও বিধান দেননি। তবে যদি কেউ তার স্ত্রীকে রতিক্রিয়া সম্পন্ন করার পূর্বেই তালাক দেয় তাহলে তা বায়েন তালাক হবে।( ফাতওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া, ৩৩/৭-৯)

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল একটি হাদিস বর্ণনা করেন, রুকানা তার স্ত্রীকে তিন তালাক দেয়ার পর পেরেশান হয়ে যান। অতঃপর রাসূলুল্লাহ স. তাকে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেন এবং বলেন, এটা এক তালাক। অর্থাত উক্ত সাহাবী এক অবস্থায় তিন তালাক দিয়েছিলেন।( সুনান আবু দাউদ, ২/২২৫, হাদিস নং ২১৯৮, মুসনাদ আহমদ, ১/২৬৫, হাদিস নং ২৩৮৭)
তবে তালাক বলার বৈভিন্নের ক্ষেত্রে হুকুমের ব্যাপারে কেউ কউে পার্থক্য করেছেন। প্রথম অবস্থায় তথা তুমি তালাক তালাক তালাক বলল, এখানে কারো মতে এক তালাক হবে। পরের দুইবার প্রথমটির জন্য গুরুত্বারোপ করবে।
আবার যদি বলে, তুমি তালাক, তুমি তালাক, তুমি তালাক, তাহলে জুমহুর বা অধিকাংশদের মতে তিন তালাক হবে। কারণ, বাক্য পৃথক পৃথক হয়েছে। তবে যদি তালাকদাতা বলে যে, সে বারবার বলার দ্বারা প্রথটিকে গুরুত্ব বুঝিয়েছে, তাহলে তার নিয়তকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
কিন্তু এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন হল, একটি শব্দ যেমন আরেকটি শব্দকে গুরুত্ব প্রদান করে, তেমনি একটি বাক্যও আরেকটি বাক্যকে গুরুত্ব প্রদান করে। সুতরাং প্রথম পর্যায়ে এক তালাক হবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তিন তালাক হবে -কথাটি যুক্তিসঙ্গত নয়।
আবুল আব্বাস ইবনে তাইমিয়াসহ অনেকের মত হল, যদিও পৃথক পৃথক বাক্য দ্বারা তিন তালাক দেয়, তবুও তা এক তালাকই গণ্য হবে।

একমাসে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই হবে -এ বিধান যেভাবে আসলঃ
সহিহ মুসলিম-এ আছে, ইবনে আব্বাস রাদ্বি. বলেন, রাসূলুল্লাহ স. এর সময়কালে, আবু বকর-এর সময়কালে এবং উমর-এর শাসনামলের প্রথম দুই বছরের সময়কালে তিন তালাককে এক তালাক গণ্য করা হত। অতঃপর উমর-এর শাসনামলে লোকেরা ত্বরা করল যে বিষয়ে তাদের অবকাশ ছিল। অতঃপর তিনি বললেন, যদি আমরা এটা বাস্তবায়ন করি! অতঃপর তিনি বাস্তবায়ন করলেন।(সহিহ মুসলিম, ২/১০৯৯, হাদিস নং ১৫-১৪৭২)
অর্থাত- লোকেরা উমর রাদ্বি. এর শাসনামলে একমাসে একবারেই অধিক তালাক দিত। কারণ, তারা জানত, তালাক যে কয়টাই দেয়া হোক, তালাক একটিই পতিত হবে। সুতরাং রাগের মাথায় যে কয়টা মন চাইত, তাই দিত। কিন্তু উমর রাদ্বি. চাইলেন তাদেরকে সুন্নতের পথে ফিরিয়ে আনতে। তাই তিনি ঘোষণা দিলেন, এক মাসে যে যে কয়টি তালাক দিবে, সে কয়টি তালাকই পতিত হবে। অর্থাত- একটি দিলে একটি, দুইটি দিলে দুইটি, আর তিনটি দিলে তিনটি তালাকই পতিত হবে। এ বিধান করেছিলেন তাদেরকে সুন্নতের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য। অতঃপর এ বিধানটিই চার মাযহাবসহ সকলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইমাম ইবনে তাইমিয়া এর বিপক্ষে মত দেন।
ইবনে আব্বাসের হাদিসের ব্যাপারে কেউ কেউ বলেন, এখানে তিন তালাক বলতে উদ্দেশ্য হল, এককথায় তিন তালাক। কিন্তু তাদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, এটা উক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। দ্বিতীয়তঃ এক শব্দে তিন তালাকের বিধান যেখানে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ স. রহিত করে দিয়েছেন সেটা উমর রাদ্বি. কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন? সুতরাং, ইবনে আব্বাসের হাদিস দ্বারা পৃথক পৃথক বাক্যে তিন তালাকই উদ্দেশ্য।

এক মাসে এক বাক্যে অথবা পৃথক পৃথক তিন বাক্যে তালাকের হুকুমঃ
এটা এক তালাক পতিত হবে, এবং তালাকদাতার নিয়ত দেখতে হবে। যদি সে তালাক রজয়ী উদ্দেশ্য করে তাহলে রজয়ী হবে। নতুবা এক তালাক বায়েন হবে। আর সেক্ষেত্রে পুনরায় বিয়ে পড়াতে হবে এবং মোহর ধার্য করতে হবে। তবে আমাদের দেশে লোকেরা যেহেতু রজয়ী তালাক সম্পর্কে জানে না, তাই তিন তালাক দিলে তা বায়েন হিসেবে গণ্য করতঃ বিয়ে পড়ানই উত্তম। ফলে, সন্দেহ মুক্ত হওয়া যায়।

এক তালাক সাব্যস্ত করার কারণঃ
এক মাসে তিন তালাক জায়েয নাই। রাসূলুল্লাহ স. যখন শুনলেন জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে, তিনি রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, সে কি আল্লাহর কিতাবের সাথে খেলাধূলা করে, অথচ আমি তোমাদের মাঝে আছি?(সুনান নাসায়ী, ৬/১২৪, হাদিস নং ৩৪০১)
তালাকের বিধান হল, তিন মাসে তিনটি দিবে। আবার তা দিতে হবে প্রতি ঋতুস্রাবের পর পবিত্রাবস্থায় তাকে স্পর্শ করা ব্যতীত। সুতরাং একমাসে তিন তালাক পতিত হওয়ার অবকাশ নেই। যেহেতু অবকাশ নেই, তাই তিন তালাক পতিত হবে না।
আর উমর রাদ্বি. এর সিদ্ধান্ত ছিল সাময়িক। সেটা সর্বজনীন করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তিনি চেয়েছিলেন লোকদেরকে সুন্নতের পথে ফিরিয়ে আনতে। তাঁর নির্দেশ চিরকালের জন্য বাস্তবায়ন করতে নয়। এর দ্বারা একটি বিষয় প্রমাণিত হয়, যদি কোনো ইসলামী রাষ্ট্র একমাসে তিন তালাকের বিধান তিন তালাক হিসেবে বাস্তবায়ন করতে চায় তাহলে তা পারবে। তবে শর্ত হল, যদি তা ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং তাদেরকে সুন্নতের পথে ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু তা হতে হবে সাময়িক সময়ের জন্য, সব সময়ের জন্য নয়।
বর্তমান সময়ে যদি একমাসে তিন তালাক দিলে তা তিন তালাক হিসেবে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে পরিবারে কল্যাণ রহিত হয়, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কিন্তু যদি একমাসে তিন তালাকের বিধানকে এক তালাক সাব্যস্ত করা হয় তাহলে পরিবারে কল্যাণ বজায় থাকে, যে বিধানটি ছিল রাসূলুল্লাহ স., আবু বকর ও উমর রাদ্বি. এর শাসনামলের শুরুর দিকে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

ফাতওয়া প্রদানেঃ
কামারুজ্জামান বিন আব্দুল মালেক
আল-শিবলী আল-আযহারী

Share this:

Leave a Comment