সেজদায় যাওয়ার সময় জমিনে হাত অথবা হাঁটু রাখা প্রসঙ্গে

এ বিষয়ে বা হাত রাখা এবং হাঁটু রাখা উভয়টির ব্যাপারে হাদিস রয়েছে।

হাঁটু রাখার হাদিস হল, যেমনঃ
سَعِيدُ بْنُ مَنْصُورٍ حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ مُحَمَّدٍ حَدَّثَنِى مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ حَسَنٍ عَنْ أَبِى الزِّنَادِ عَنِ الأَعْرَجِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ – رضي الله عنه – قَالَ : قَالَ رَسُولُ اَللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – – إِذَا سَجَدَ أَحَدُكُمْ فَلَا يَبْرُكْ كَمَا يَبْرُكُ اَلْبَعِيرُ , وَلْيَضَعْ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ
অর্থাৎÑ আবু হুরায়রা রাদ্বি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যখন সেজদা করে সে যেন উটের মতো না বসে। সে তার দুই হাতকে দুই হাঁটুর আগে রাখবে।
[সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ৮৪০, তিরমিযী, হাদিস নং ২৬৯, নাসায়ী, হাদিস নং ১০৯১]।

আর হাত রাখার হাদিস হল,
الْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ وَحُسَيْنُ بْنُ عِيسَى قَالاَ حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ هَارُونَ أَخْبَرَنَا شَرِيكٌ عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ وَائِلِ بْنِ حُجْرٍ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- إِذَا سَجَدَ وَضَعَ رُكْبَتَيْهِ قَبْلَ يَدَيْهِ وَإِذَا نَهَضَ رَفَعَ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ.

অর্থাৎ- ওয়ায়েল বিন হুজর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি যখন সেজদা করতেন তার দুই হাঁটু তার দুই হাতের আগে রাখতেন। আর যখন দাঁড়াতেন তার দুই হাত দুই হাঁটুর আগে ওঠাতেন।
[আবু দাউদ, হাদিস নং ৮৩৮, তিরমিযী, হাদিস নং ২৬৮, ইমাম তিরমিযী হাদিসটিকে হাসান বলেছেন, নাসায়ী, হাদিস নং ১০৮৯, ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৮৮২]

প্রথম হাদিস তথা আগে হাঁটু রাখার ব্যাপারে আবু হুরায়রার হাদিসটিকে ইমাম বুখারী, তিরমিযী ও দারাকুতনী ত্রুটিযুক্ত করেছেন। আর আলবানী সহিহ বলেছেন। তবে এক্ষেত্রে আলবানীর কথা গ্রহণযোগ্য নয়। এর সনদে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন হাসান রয়েছেন তার ব্যাপারে ইমাম বুখারী বলেন, তাকে অনুসরণ করা যায় না। তিনি বলেন, আমি জানি না, সে আবুয যিনাদ থেকে শুনেছে নাকি শুনেনি। আর ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদিসটি গরিব বা অপরিচিত। আবুয যিনাদ থেকে হাদিসকে আমরা জানি না।
তবে ইবনে উমর থেকে এই হাদিসটির একটি শাহেদ বা সাক্ষী আছে যেটা ইমাম বুখারী সহিহ বুখারীতে মুয়াল্লাক বা সনদবিহীন ঝুলন্ত অবস্থায় বর্ণনা করেছেন। তা হল,

كَانَ ” ابْنُ عُمَرَ ” يَضَعُ يَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ
অর্থাৎ- ইবনে উমর তার দুই হাঁটু রাখার আগে হাত রাখতেন।
[বুখারী, ১/২৭৬]

আরেকটি মুতাবায়াত আছে, তা হলঃ
وَقَدْ أَخْرَجَ ابْنُ أَبِي دَاوُد مِنْ حَدِيثِ ” أَبِي هُرَيْرَةَ ” : أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إذَا سَجَدَ بَدَأَ بِيَدَيْهِ قَبْلَ رُكْبَتَيْهِ.

অর্থাৎ- ইবনে আবু দাউদ আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সেজদা করতেন তার হাঁটুর আগে দুই হাত দ্বারা শুরু করতেন, অর্থাৎ- হাত আগে রাখতেন। এ হাদিসটি সুবুলুস সালাম এবং নাইলুল আওতার উল্লেখ করেছে তবে আমি হাদিসের কিতাবে পাইনি।
তবে এর সনদে আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ রয়েছেন যাকে ইমামগণ দুর্বল, পরিত্যক্ত, অস্বীকৃত বলেছেন।

আরেকটি হাদিস হল,
عن ابن عمر: أن النبي صلى الله عليه وآله وسلم كان إذا سجد يضع يديه قبل ركبتيه

অর্থাৎ- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সেজদা করতেন, তিনি তার দুই হাঁটুর আগে দুই হাতকে রাখতেন।
[দারাকুতনী, হাদিস নং ১৩১৯, এবং মুসতাদরাক আলÑহাকেম, হাদিস নং ৮২১। হাকেম বলেন, মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী। তবে বাইহাকী বলেন, হাদিসটি মরফু‘ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহজনক। ইবনে উমরের উপর মওকুফ। হাদিস নং ২৪৭০। ফাতহুল বারী, ইবনে রজব, ৬/৩৬।

আর দ্বিতীয় হাদিস তথা ওয়ায়েল বিন হুজর কর্তৃক বর্ণিত হাদিসটির ব্যাপারে বুখারী, তিরমিযী, আবু দাউদ ও বাইহাকী বলেন, এটা শরীক আসেম বিন কুলাইব থেকে একাকী বর্ণনা করেছেন। শরীক যখন কোনো হাদিস একাকী বর্ণনা করেন তা সহিহ হয় না তবে হাসান হয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে তিরমিযী হাসান বলেছেন।

তবে আনাস থেকে এ হাদিসের একটি শাহেদ বা সাক্ষী আছে। যেমনঃ
عَنْ عَاصِمٍ الْأَحْوَلِ ” عَنْ ” أَنَسٍ ” قَالَ : رَأَيْت رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ انْحَطَّ بِالتَّكْبِيرِ حَتَّى سَبَقَتْ رُكْبَتَاهُ يَدَيْهِ

অর্থাৎ- আসেম আলÑআহওয়াল আনাস থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, তিনি তাকবীর বলে ঝুঁকে গেলেন বা সেজদায় গেলেন, তার দুই হাঁটু তার দুই হাতের আগে গেল। [দারাকুতনী, হাদিস নং ৭, হাকেম, হাদিস নং ৮২২, ও বাইহাকী, হাদিস নং ২৪৬৪]
হাকেম বলেন, বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী। আর বাইহাকী বলেন, এর সনদে আলা’ বিন ইসমাইল আলÑআত্তার রয়েছে। তিনি মাজহুল। আর ইবনে আবু হাতেম তার পিতার কাছ থেকে বর্ণনা করেন, মুনকার বা অস্বীকৃত।

আর ইবনে খুযায়মা তার সহিহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন,
عن مُصْعَبِ بْنِ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ ” عَنْ أَبِيهِ قَالَ : كُنَّا نَضَعُ الْيَدَيْنِ قَبْلَ الرُّكْبَتَيْنِ ، فَأُمِرْنَا بِوَضْعِ الرُّكْبَتَيْنِ قَبْلَ الْيَدَيْنِ.

অর্থাৎ- মুসআব বিন সা‘দ বিন আবু ওয়াক্কাস তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমরা হাঁটুর আগে হাত রাখতাম। অতঃপর আমাদেরকে হাতের আগে হাঁটুর রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [সহিহ ইবনে খুযায়মা, হাদিস নং ৬২৮]
এ হাদিস দ্বারা হাত আগে রাখার হাদিসটিকে মানসুখ বা রহিত হওয়ার কথা বলেন। তবে আলÑহাযেমী বলেন, এর সনদে ত্রæটি আছে। যদি এটা সুরক্ষিত থাকত তাহলে মানসুখ বা রহিতকরণের জন্য দলিল হত। আর ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, এ হাদিসটি ইবরাহীম বিন ইসমাইল তার পিতা থেকে একাকী বর্ণনা করেন। আর তারা উভয়েই দুর্বল।

আবু বকর ইবনে আবি শাইবা তার সনদ দিয়ে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেন,
عن أبي هريرة عن النبي صلى الله عليه وآله وسلم أنه قال : إذا سجد أحدكم فليبدأ بركبتيه قبل يديه ولا يبرك كبروك الفحل/ الجمل.

অর্থাৎ- আবু হুরায়রা রাদ্বি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ যখন সেজদা করে, সে যেন তার দুই হাতের আগে দুই হাঁটু দ্বারা শুরু করে। এবং উটের মতো না বসে।
হাদিসটি দুর্বল।
এবং আল-আছরাম তার সুনানেও আবু বকরের সনদ দিয়ে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণনা করেন। এ হাদিসটি ওয়ায়েলের হাদিস তথা হাঁটু আগে রাখার বিষয়টিকে সমর্থন করে।
[মুসনাদ আবি ইয়া‘লা, হাদিস নং ৬৫৪০, সুনান বাইহাকী আলÑকুবরা, হাদিস নং ২৪৬৭]

দুইটি হাদিসের কোনোটির সনদই ত্রæটি থেকে মুক্ত নয়। আবার উভয়টির শাহেদ আছে যা উভয়টিকে শক্তিশালী করে। তবে ওয়ায়েলের হাদিস তা হাঁটু আগে রাখার হাদিসটির শাহেদ বা সাক্ষী ও মুতাবাআদ বা অনুসরণীয় বেশি আছে।

প্রথম হাদিস তথা হাঁটুর আগে হাত রাখার হাদিসের বাহ্যিক বর্ণনা অনুযায়ী মনে হয় এটা ওয়াজিব মনে হলেও কেউ ওয়াজিব বলেননি, সকলে এটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। আর দ্বিতীয় হাদিসটি জমিতে হাঁটুর রাখার আগে হাত রাখার নির্দেশ এসেছে।

ইমাম মালেক ও আওযায়ীর মত হল, সেজদায় যাওয়ার সময় হাত আগে রাখা মুস্তাহাব।
আর হানাফী, শাফেয়ী ও জুমহুর ওলামা এবং মালেকের এক মত হল ওয়ায়েল বিন হুজরের হাদিস অনুযায়ী হাঁটু রাখার হাদিস অনুযায়ী আমল করার কথা বলেছেন। এ মতটি উমর বিন খাত্তাব রাদ্বি, নাখয়ী, মুসলিম বিন ইয়াসার, সুফিয়ান ছওরী, আহমদ ও ইসহাক থেকেও বর্ণিত।

ইমাম নববী বলেন, এখানে দুই মাযহাবের কোনোটিকেই প্রাধান্য দেয়া যাচ্ছে না। কারণ, তবে এই মাযহাব তথা শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারীগণ ওয়ায়েলের হাদিস তথা হাঁটু রাখার হাদিসকে প্রাধান্য দেন। তারা বলেন, আবু হুরায়রার হাদিসে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। এখানে দুইটি বিষয় রয়েছে।
ইবনুল কাইয়িম আল-জওযিয়্যাহ বিষয়টি যাচাই করেছেন এবং বলেন, আবু হুরায়রার হাদিসে রাবী থেকে ওলট পালট হয়েছে। কারণ, তিনি বলেছেন, তার দুই হাত তার দুই হাঁটুর আগে যেন রাখে। এটা আসলে হবে, তার দুই হাঁটু যেন তার দুই হাতের আগে রাখে। এর প্রমাণ হল হাদিসের প্রথম অংশ। কারণ, সেখানে বলা আছে, তোমাদের কেউ যেন উটের মতো না বসে। আর উটের ব্যাপারে এটা সর্বজনবিদিত যে, উট তার দুই হাত বা সামনের পা দু’টোর হাঁটু পেছনের দুই পায়ের হাঁটুর আগে রাখে। [বলা বাহুল্য যে, চতুষ্পদ জন্তুর সামনের দুই পাকে হাত বলা হয়]।
তিনি হাঁটু রাখার হাদিসের পক্ষে মোট দশটি যুক্তি উপস্থাপন করেন। [যাদুল মাআদ, ১/২১৫]

সারকথা হল, যারা হাঁটু আগে রাখার কথা বলেন তারা এ হাদিসকে হাত আগে রাখার হাদিসের উপর প্রাধান্য দেন। আর যারা হাত আগে রাখার কথা বলেন তারা এ হাদিসকে হাঁটু আগে রাখার হাদিসের উপর প্রাধান্য দেন। অথচ উভয় হাদিসের মধ্যেই হাদিসের দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচনা আছে। আবার উভয় হাদিসের স্বপক্ষে শাহেদ আছে। সুতরাং, উভয় হাদিস অনুযায়ীই আমল করা যাবে। যার যেভাবে সুবিধা হয় সে সেভাবেই আমল করবে। তদুপরি, এখানে মতভেদ হল মুস্তাহাব নিয়ে। এটা ওয়াজিব কোনো বিষয় নয়।
তবে উভয় হাদিস অনুযায়ী আমল করার উত্তম পন্থা হল, হাত হাঁটুর উপর এভাবে রাখবে যে, জমিনে হাঁটু ও হাত উভয়টি একসাথে পড়বে বা জমিনকে স্পর্শ করবে। তাহলে উভয় হাদিস মোতাবেক আমল হয়ে গেল।

[সুবুলুস সালাম, পৃষ্ঠা ২/১৬১-১৬৫, নাইলুল আওতার, শওকানী, ২/১৮১]

Share this:

Leave a Comment