সূরা নাবা’

আয়াত ১৭-২৩

পরকাল ও বিচার দিবস সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا (17) يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا (18) وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا (19) وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا (20) إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21) لِلطَّاغِينَ مَآبًا (22) لابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا (23)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ كَانَ مِيقَاتًا (17)

শব্দার্থঃ إِنَّ = নিশ্চয়। يَوْمَ = দিন। الْفَصْلِ = বিচ্ছেদ, বিচার। كَانَ = ছিল। مِيقَاتًا = নির্দিষ্ট, নির্ধারিত সময়।

অর্থঃ নিশ্চয় বিচার দিবসের দিন হল নির্দিষ্ট। [আয়াত ১৭]

তাৎপর্যঃ

إِنَّ : নিশ্চয়। এ শব্দটি সন্দেহ অপসারণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

يَوْمَ الْفَصْلِ : পৃথক করার দিন, বিচার দিবস -উদ্দেশ্য হল, কিয়ামতের দিন। এ দিনটি হল একত্র হওয়া ও পাপ-পুণ্যের হিসাবের জন্য নির্ধারিত। এ দিন আল্লাহ তার বান্দাদের মাঝে ফায়সালা করবেন। সত্য ও মিথ্যা, নেককার ও বদকারের মাঝে ফায়সালা করবেন। কবর থেকে সবাই উঠে আসবে এবং তাদের কর্মফল গ্রহণ করবে।

كَانَ مِيقَاتًا : নির্দিষ্ট সময় তথা এ দিনটির জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় রয়েছে। এ দিনটি কবে সংঘটিত হবে তা আল্লাহর কাছেই নির্ধারিত। ইমাম কুরতুবী বলেন, ‘এই আয়াতটি প্রমাণ করে, মুশরিকরা পরকাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিল। তাই আল্লাহ তাদের হুশিয়ারী করে বলেন, কক্ষনো  না,

তারা শীঘ্রই জানবে, অর্থাৎ- মুহাম্মাদ স. যে কোরআন নিয়ে এসেছেন এবং তাদেরকে পরকালের ব্যাপারে যা বলেছেন, এর সত্যতা তারা শীঘ্রই জানবে।’(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭০।)

কিয়ামত দিবসের জন্য সময়কাল নির্ধারিত। কেউ আগে যাচনা করলেই তা প্রকাশ পাবে, এমন নয়। এ-দিন পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগত সকল মানবকুল, জিনজাতিসহ সকল প্রাণীকে উত্তোলন করা হবে। এ দিবসটি নির্দিষ্ট একটি সময় দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকবে। হিসেব-নিকেশে একটু সময় বেশিও লাগবে না এবং কমও লাগবে না। বিচার শেষে, একদল জান্নাতে যাবে, আরেক দল জাহান্নামে যাবে।

এখানে হিসাব সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়, যেমন জনৈক ব্যক্তি আলী রাযিঃ এর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কীভাবে একই সময়ে একই সাথে হিসাব নেবেন? তিনি বললেন, যেভাবে তিনি সবাইকে একই সাথে রিযিক দেন।(তাফসীর রাযী, ১৯/৫।) অর্থাৎ- বিচার পদ্ধতিটি হবে একটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। ব্যক্তিকে তার আমলনামা দেয়া হবে এবং সাথে তার আমলের ফলাফলও সংযুক্ত থাকবে। যেমন বুথে গিয়ে কার্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে কত টাকা উঠাবে, কত টাকা অবশিষ্ট থাকবে তা জানতে পারে। এ জন্য দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ে না।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

বিচার দিবসের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। এটা তার সময়মতোই এসে দেখা দেবে। এটা একটি অদৃশ্যের বিষয়। এটা জানার কোনো মাধ্যম নেই।

يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَتَأْتُونَ أَفْوَاجًا (18)

শব্দার্থঃ يَوْمَ = দিন, যে সময়, বা যেদিন। يُنْفَخُ = ফুঁৎকার দেয়া হবে। فِي = মধ্যে। الصُّورِ = শিঙা। فَـ = অতঃপর। تَأْتُونَ= তোমরা আসবে। أَفْوَاجًا [বহুবচন, এর একবচন হল فَوْجٌ]= দলে দলে।

অর্থঃ যেদিন শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে, অতঃপর তোমরা দলে দলে আসবে। [আয়াত ১৮]

তাৎপর্যঃ

يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ : যেদিন শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে -অর্থাৎ- যেদিন ইসরাফিল শিঙায় ফুঁৎকার দেবেন তোমরা তা শুনে দলে দলে বিচার স্থলের দিকে আসবে। কে ফুঁৎকার দেবেন -সে কথা এ আয়াতে বলা হয় নি। কারণ, এখানে ফুঁৎকার ক্রিয়া সংঘটিত হওয়াটিই মূল লক্ষ্য। কে দেবেন সেটা মূল লক্ষ্য নয়। স্মর্তব্য যে, শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে দুইবার। প্রথম বারে সবকিছু লয় হয়ে যাবে, এবং দ্বিতীয় বারে সবকিছু পুনরুজ্জীবিত হবে। আর এখানে দ্বিতীয়বার ফুঁৎকারের কথা বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الأرْضِ إِلا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ

অর্থাৎ- আর শিঙায় ফুঁৎকার দেয়া হবে, আসমানে যারা আছে এবং জমিনে যারা আছে -সব অচেতন হয়ে যাবে; কিন্তু যাকে আল্লাহ চান সে ব্যতীত। অতঃপর তাতে আবার ফুঁৎকার দেয়া হবে, অতঃপর তারা দণ্ডায়মান হবে, অবলোকন করবে। [সূরা যুমার, আয়াত-৬৮]( )

আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘দুই ফুঁৎকারের মাঝে চল্লিশ।’ তারা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু হুরায়রা! চল্লিশ দিন? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। তারা বললেন, চল্লিশ বছর? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। তারা বললেন, চল্লিশ মাস? তিনি বললেন, আমি অস্বীকার করলাম। মানুষের সকল অঙ্গই লয় হয়ে যাবে; একমাত্র মেরুদণ্ডের নিন্মাংশে অবস্থিত পুচ্ছাস্থি (coccyx or tailbone) ছাড়া, এখান থেকেই দ্বিতীয় সৃষ্টিকে গঠন করা হবে।(সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৪৫৩৬, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৪১-২৯৫৫। )

অর্থাৎ- হাদিসে উল্লেখ আছে চল্লিশ সংখ্যার কথা। এটা কি বছর নাকি দিন নাকি মাস -এ ব্যাপারে লোকেরা আবু হুরায়রাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তা জানার কথা অস্বীকার করলেন। অর্থাৎ-তিনি জানেন না যে এ সংখ্যার দ্বারা কোনটি উদ্দেশ্য। আর পুচ্ছাস্থি হল, মানব মেরুদণ্ডের নিন্মাংশে অবস্থিত ক্ষুদ্র একটি হাড় যেটা কক্ষনো লয় হবে না, অথচ অন্য সকল কিছুই লয় হয়ে যাবে। এটা একটি বীজসদৃশ, যেটা থেকে একজন মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে, যেমন মৃত শস্য থেকে উদ্ভিদ গজায়, আবার তাতে দানা আসে।

আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত শুরু করবেন একটি মহানিনাদের মাধ্যমে। যেটার শব্দ শোনামাত্রই সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হবে -সে ঘুমে থাক অথবা জাগ্রত থাক। দৃশ্যমান বিপদের চেয়ে শ্রবণশীল বিপদ মারাত্মক পর্যায়ের। কর্ণ সব দিক থেকেই শুনতে পায়, পক্ষান্তরে, চোখের বেলায় এমন নয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে, চোখের চেয়ে কান বেশি সংবেদনশীল এবং এর পরিধি ব্যাপক। পক্ষান্তরে, দৃশ্যমানের চেয়ে শ্রবণযোগ্য শাস্তির পরিধিও ব্যাপক। এজন্যই আমাদের কানে চোখের মতো পর্দা দেয়া হয়নি। আর বড় কোনো শাস্তিই হয় বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এতে বিকট শব্দ হয়। এখন যদি চোখের মত কানেরও ঢাকনা সদৃশ পর্দা দেয়া হত এবং ঘুমানোর সময় তা বন্ধ হয়ে যেত, অতঃপর ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর আমরা না খোলা পর্যন্ত তা না খুলত, তাহলে কোনো বিস্ফোরণের শব্দ আমরা শুনতে পেতাম না। নানামূখী বিপদে নিপতিত হতাম। একজন মানুষ ঘুমালে সাথে সাথে তার প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঘুমিয়ে পড়ে একমাত্র কান ছাড়া। একজন ব্যক্তি ঘুমানোর পর তার চিন্তাশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়ে যায়। বাকি থাকে কেবল শ্রবণশক্তি। বলা বাহুল্য যে, আমাদের ঘুম ভাঙে তিনভাবে। ঘুম পূর্ণ হওয়ার দ্বারা, কোনো শব্দ শোনার দ্বারা, অথবা দেহে নাড়াচাড়া খাওয়ার দ্বারা। আর শোনার বিষয়টি হল বেশি সংবেদনশীল। চিন্তাশক্তি ঘুমিয়ে পড়ার কারণে আমরা ক্ষীণ শব্দে জাগ্রত হই না। তবে যদি শব্দের মাত্রা বেশি হলে কানের মাধ্যমে মস্তিষ্ক জাগ্রত হয় এবং চিন্তাশক্তি ফিরে পায়। তাই, যদি এতে ঢাকনা থাকত তাহলে কখন কোন দিক থেকে কোন বিপদ আসত তা বুঝতে পারতাম না। ফলে, আমরা সমূহ বিপদের মধ্যে নিপতিত হতাম। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা আমাদের কানে পর্দা না দিয়ে আমাদের প্রতি বিশাল অনুকম্পা করেছেন যাতে আমরা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারি।

فَتَأْتُونَ : فَاء মানে অতঃপর। এটা সংযুক্তি বর্ণ, পর্যায়ক্রমিক ধারা বর্ণনা করতে এসেছে। অতঃপর তোমরা আসবে – অর্থাৎ- পায়ে হেঁটে হেঁটে আসবে। تَأْتُونَ ক্রিয়ার ক্রিয়ামূল হল اِتْيَانٌ। মানে যে আসাতে তেমন কষ্ট নেই, বাধা-বিঘ্নতা নেই। তাহলে এর দ্বারা এটা বোধগম্য হয় যে, যে যেখানেই থাক তথা যার কবর বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, কিয়ামতের ময়দানে তাকে পৌঁছতে তেমন শারীরিক কষ্ট করতে হবে না। সাগরে বিস্ফোরণ এবং এ ভূমি ভিন্ন ভূমিতে রূপান্তরিত হলেও গমনপথ সহজ ও সমতল হবে।

أَفْوَاجًا : বা দলে দলে বোঝাতে যেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের লোক একসাথে থাকে। তখন মু’মিন-মুশরিক ও নেককার- বদকার সকলে একসাথে দলে দলে যাবে।(আত-তাহরীর ওয়াত তানভীর, ইবনে আশুর, ৩০/৩১।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

অতঃপর যখন শিঙায় দ্বিতীয় ফুঁৎকার দেয়া হবে তখন সকলে জাগ্রত হয়ে কবর থেকে উঠে দলে দলে কিয়ামতের ময়দানের দিকে গমন করবে।

وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا (19)

শব্দার্থঃ فُتِحَتْ = খুলে দেয়া হবে। السَّمَاءُ = আসমান। فَـ = অতঃপর। كَانَتْ = হবে, মূল অর্থ হল, ছিল। أَبْوَابًا = দরজা বা দরজা দরজা।

অর্থঃ এবং আসমানকে খুলে দেয়া হবে অতঃপর এটা দরজা দরজা হবে। [আয়াত ১৯]

তাৎপর্যঃ

فُتِحَتْ : খুলে দেয়া হবে। তবে এর মূল অর্থ হল, খোলা হয়েছে। এ কাজটি ভবিষ্যতে হবে। কিন্তু অতীতের ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে এটা বোঝাতে যে, এ কাজটি সংঘটিত হতে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া, জ্ঞানের দিক দিয়ে আল্লাহর কাছে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই।

السَّمَاءُ : আকাশ; সামা’ শব্দটির অর্থ ব্যাপক। উপরে যা কিছু আছে এবং আপনাকে ছায়া দেয় তাই আকাশ। যেমন ধরুন, আপনি ছাতার নিচে আছেন, সেটাও আপনার জন্য একটি আকাশ। ঘরের ছাদ আকাশ। মেঘমালা আকাশ। এক কথায় যা কিছু অন্য কোনো কিছুকে সংরক্ষণে কাজ করে সেটাই আকাশ। সে দৃষ্টিকোণ থেকে, বায়ুর যে স্তর রয়েছে সেসবও আকাশ বলে পরিগণিত হবে। কিন্তু এখানে আকাশ বলে উদ্দেশ্য হল শতশত আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত যে তারকারাজি রয়েছে, তারও উর্ধ্বে চারদিকে ঘিরে যে বেষ্টনী রয়েছে সেটাই হল আকাশ। এখানে আকাশ বলতে এটাই উদ্দেশ্য। তবে কোথাও কোথাও আকাশ বলতে মেঘমালা বা বৃষ্টি বরিষণও বোঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ  তায়ালা   বলেন,  يُرْسِلِ السَّمَاءَ عَلَيْكُمْ مِدْرَارًا-অর্থাৎ-  তিনি  তোমাদের  উপর  আকাশকে প্রেরণ করেন নিরবচ্ছিন্নভাবে তথা লাগাতার বৃষ্টি বর্ষণ করেন। [সূরা নূহ, আয়াত ১১]। কিন্তু বিজ্ঞানীরা আকাশের কোনো সন্ধান খুঁজে পায় না, তাই বলে, আকাশ মানে শূন্য। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটা তাদের ভুল ধারণা। কারণ, তারা অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত তারকারাজিরই সংবাদ আহরণ করতে পারেন নি, তাহলে তারা কীভাবে আকাশের সংবাদ নিয়ে আসবেন? আকাশ হল পার্থিব জগতের রক্ষাকবচ। এটা এর অভ্যন্তরে এ সৌরজগৎ, মিল্কিওয়েসহ অন্যান্য গ্যালাক্সিগুলোকে ধারণ করে আছে। এসব আলোময় তারকারাজি দ্বারা আল্লাহ তায়ালা আকাশকে সুশোভিত করেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَحِفْظًا -অর্থাৎ- আর আমরা পৃথিবীর আসমানকে সুসজ্জিত করেছি তারকা দ্বারা এবং এটাকে সুরক্ষিত করেছি। [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত ১২]

আকাশ বলতে মূল উদ্দেশ্যঃ

আমাদের এ সৌরজগৎ ও অন্যান্য সৌরজগতসহ যত ছায়াপথ আছে সবগুলোকে ঘিরে আছে প্রথম আকাশ। অতঃপর দ্বিতীয় আকাশ। সৌরজগতের যেকোনো গ্রহে যেতে অতিশয় শক্তির অধিকারী হলেই গমন করা যায়। যেমন নাসাসহ অন্যান্য মানমিনারগুলো তাদের স্পেইসশিপ প্রেরণ করছে বিভিন্ন গ্রহে। কিন্তু আসমান পেরিয়ে যাওয়ার জন্য শক্তি হলেই চলবে না। উক্ত আসমান অতিশয় শক্ত। তাছাড়া, সেখানে পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত আছেন ফেরেশতা। তিনি যাকে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দরজা খুলে দেবেন কেবল সেই ভিতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন। এখানে আকাশ বলতে শূন্যস্থলে বায়ুমণ্ডলের নানাস্তর গ্রহণ করলে আকাশের মূল তাৎপর্য প্রস্ফুটিত হয় না। বায়ুমণ্ডলের এ স্তরগুলো পেরোনো অথবা অন্য গ্রহে গমন করা, এক গ্যালাক্সি থেকে আরেক গ্যালাক্সিতে যাওয়ার জন্য শক্তি ও সময় হলেই সম্ভব। কিন্তু প্রকৃত আকাশ যেটা ধ্বংস হবে, তা পেরোনো সম্ভব নয়, কিন্তু ফেরেশতার অনুমতি ব্যতীত। যেমন মে‘রাজের হাদিসে আছে, আনাস বিন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমার নিকট বোরাক নিয়ে আসা হল। বোরাক হচ্ছে চতুষ্পদ জন্তু, সাদা, লম্বা, গাধার চেয়ে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট। তার দৃষ্টির শেষ প্রান্তে সে তার পা রাখে। তিনি বললেন, ‘আমি তাতে সওয়ার হলাম। আমি বাইতুল মুকাদ্দাস-এ আসলাম। আমি তাকে সে খুঁটির সাথে বাঁধলাম যার সাথে নবীগণ বাঁধতেন।’ তিনি বলেন, ‘অতঃপর আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। তাতে দু’রাকায়াত নামায আদায় করলাম। অতঃপর বের হলাম। অতঃপর জিবরীল আমার নিকট মদের ও দুধের পাত্র নিয়ে আসলেন। আমি দুধের পাত্র গ্রহণ করলাম। জিবরীল আমাকে বললেন, আপনি ফিতরাত (স্বভাব বা প্রকৃতি) গ্রহণ করেছেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে প্রথম আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। আমি আদম (আ.)-এর সাক্ষাত পেলাম। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। তাকে বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে খালার দুই ছেলে ঈসা ইবনে মারইয়াম ও ইয়াহইয়া  বিন  যাকারিয়া আলাইহিমাস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তারা আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে তৃতীয় আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে ইউসূফ আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তাকে সৌন্দর্যের একাংশ দেয়া হয়েছে। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে চতুর্থ আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, কে আপনি? সে বলল, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? সে বলল, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে ইদরীস আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলে। আল্লাহ বলেন, “আমি তাকে সমুচ্চিত স্থানে আরোহণ করিয়েছি।” অতঃপর আমাকে নিয়ে পঞ্চম আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে হারূন আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে ষষ্ঠ আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে মুসা আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি আমাকে স্বাগতম জানালেন এবং আমার কল্যাণের জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর আমাকে নিয়ে সপ্তম আসমানে আরোহণ করলেন। জিবরীল দরজা খুলতে বললেন। তাকে বলা হল, আপনি কে? তিনি বললেন, জিবরীল। তাকে বলা হল, আপনার সাথে সে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মদ। বলা  হল, তাকে কি নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তাকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। দরজা খোলা হল। সেখানে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তিনি বাইতুল মা’মুর-এর দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। বাইতুল মা’মুর -এ প্রতিদিন সত্তর হাজার ফেরেশেতা প্রবেশ করে তথা তওয়াফ করে; তারা দ্বিতীয়বার সেখানে ফিরে আসে না। অতঃপর আমাকে নিয়ে সিদরাতুল মুনতাহা গেলেন, যার পাতাসমূহ হাতির কানের ন্যায় এবং ফলগুলো হল বড় বড় কলসির ন্যায়। তিনি বলেন, যখন আল্লাহর নির্দেশ তাকে আবর্তিত করে নিল তখন সে এমন সৌন্দর্য লাভ করল যে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি নেই যেটা তার সৌন্দর্য বর্ণনা করতে সক্ষম হবে। অতঃপর আমাকে যা ওহী প্রেরণ করার তা করা হল। দিনে-রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করা হল। আমি মুসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট আসলাম। তিনি বললেন, আপনার রব আপনার উম্মতের জন্য কী ফরজ করেছেন? আমি বললাম, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। তিনি বললেন, আপনি আপনার রবের কাছে গিয়ে বলুন হালকা করতে। কারণ আপনার উম্মত এটা পালন করতে পারবে না। আমি বনি ইসরাইলকে পরীক্ষা করেছি। আমি রবের কাছে ফিরে গেলাম এবং বললাম, হে রব, আমার উম্মতের ওপর হালকা করে দিন। তিনি পাঁচ কমালেন। আমি মুসা আ.-এর কাছে গেলাম এবং বললাম, পাঁচ কমিয়েছেন। তিনি বললেন, আপনার উম্মত এটা পারবে না। আপনি ফিরে যান এবং হালকা করতে বলুন। তিনি বলেন, আমি এভাবে আমার রব ও মুসা আ.-এর মাঝে আসা-যাওয়া করছিলাম। অবশেষে তিনি বলেন, হে মুহাম্মদ, প্রতি রাত-দিনে এ হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। প্রত্যেক নামাযের জন্য দশ। এভাবে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। যে নেক কাজ করার ইচ্ছা করে কিন্তু সে তা করে না, তার জন্য একটি নেকি লেখা হয়। আর যদি সে তা করে তাহলে তার জন্য দশটি লেখা হয়। যে পাপ করার ইচ্ছা করে কিন্তু সে তা করে না, তার জন্য কিছু লেখা হয় না। আর যদি সে তা করে তবে তার জন্য একটি পাপ লেখা হয়। তিনি বলেন, অতঃপর আমি অবতরণ করে মুসা আলাইহিস সালাম-এর নিকট পৌঁছলাম এবং তাকে সংবাদ দিলাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনার রবের নিকট ফিরে যান এবং তার নিকট হালকা করার জন্য দরখাস্ত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি বললাম, আমি আমার রবের নিকট বারবার গিয়েছি যাবৎ আমি এখন লজ্জাবোধ করছি।’(সহিহ মুসলিম ,হাদিস নং ১৬২-২৫৯, ও সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৩৬৭৪, হাদিসটি সহিহ।)

فَكَانَتْ أَبْوَابًا : فَاء মানে অতঃপর। এটা সংযুক্তি বর্ণ, পর্যায়ক্রমিক ধারা বর্ণনা করতে এসেছে। أَبْوَابًا শব্দটি বহুবচন, এর একবচন হল بَابٌ। দরজা দরজা হবে। সেদিন বিশ্বচরাচরে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এর বন্ধনে ভাঙন সৃষ্টি হবে। এর গঠন সুদৃঢ় থাকবে না। আসমান বিদীর্ণ করা হবে। এতে ফাটল সৃষ্টি করা হবে। ফলে, এটা দরজা দরজা সদৃশ হবে -অর্থাৎ দরজা যেমন উন্মুক্ত তেমনি আসমান এমন পরিমাণে বিদীর্ণ হবে যে, দরজার ন্যায় খোলা, উন্মুক্ত হয়ে যাবে। কোনো বাধাদানকারী ফেরেশতা থাকবে না। আসমানের ফেরেশতারা উক্ত দরজা দিয়ে অবতরণ করবেন। স্মর্তব্য যে, ফেরেশতারা অবতরণ করবেন বান্দাদের আমলনামা নিয়ে।

সৃষ্টির উপরিভাগে যেমন ধ্বংস দেখা দেবে, এর নিম্ন অংশ তথা পৃথিবীতেও ধ্বংস দেখা দেবে। লক্ষণীয় বিষয় হল, এত শক্ত, মজবুত, সুদৃঢ় একটি গঠন ভেঙে লয় হয়ে যাবে। আর এটা প্রমাণ করে, কিয়ামতের দিন হবে একটি ভয়ংকর দিন। তাহলে আদম সন্তানের উচিত এটা অনুধাবন করা যে, আল্লাহ যা চান তা তিনি করতে পারেন। সুতরাং পরকাল অবশ্যম্ভাবী।

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ  বা উপমা প্রদানে আধিক্য করা হয়েছে, ফলে উপমার অব্যয় পদ উল্লেখ করা হয় নি। আয়াতের মূল ধারা হল, وَفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ كَالْأَبْوَابِ في التَّشَقُّقِ وَالتَّصَدُّعِ- অর্থাৎ- আর আসমানকে খুলে দেয়া হবে, অতঃপর এটা দীর্ণ-চীর্ণ হওয়ার দিক দিয়ে দরজার মতো হবে।(তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/১৫। )

এখানে উপমা দেয়ার তাৎপর্য এটাও হতে পারে যে, দরজার যেমন চৌকাঠ থাকে, তেমনি আসমানের গাত্র দু’পাশে সরে গিয়ে দরজার মতো হবে। আবার এটাও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, দরজার মধ্যবর্তী স্থান যেমন খোলা, উন্মুক্ত, তেমনি আসমানের গাত্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং তা দরজার মধ্যবর্তী খোলা স্থানের ন্যায় উন্মুক্ত ও খোলা হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

সেদিন আকাশসমূহ দীর্ণ-চীর্ণ হয়ে দরজার ন্যায় উন্মুক্ত হবে। আকাশে কোনো ফেরেশতা পাহারাদার হিসেবে থাকবে না। ফেরেশতারা বান্দাদের আমলনামা নিয়ে নেমে আসবে।

وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا (20)

শব্দার্থঃ سُيِّرَتْ = প্রবল ভাবে চালিত হবে, সঞ্চালিত হবে, অপসারিত হবে। الْجِبَالُ [একচবন الْجَبَل]= পাহাড়সমূহ। فَكَانَتْ = অতঃপর হবে। মূল অর্থ অতঃপর হয়েছিল। سَرَابًا = মরীচিকা।

অর্থঃ আর পাহাড়সমূহকে পরিচালিত করা হবে, অতঃপর তা মরীচিকা হবে। [আয়াত ২০]

তাৎপর্যঃ

سُيِّرَتْ : প্রবল ভাবে চালিত হবে। এর স্থান থেকে উপড়ে ফেলা হবে। তবে মূল অর্থ অতীত ক্রিয়ার। অর্থাৎ- প্রবল ভাবে চালিত হয়েছে, উপড়ে ফেলা হয়েছে, অপসারিত করা হয়েছে। কাজটি অবশ্যম্ভাবী বোঝানোর জন্য অতীত ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে।

الْجِبَالُ : পাহাড়সমূহ হল পৃথিবীতে পেরেকস্বরূপ। যখন এটাকে উপড়ে ফেলা হবে পৃথিবী আন্দোলিত হতে থাকবে। তাহলে এটা ইঙ্গিত দেয়, কিয়ামতের বিভীষিকার সাথে পৃথিবীর গাত্রও আন্দোলিত হতে থাকবে। এতে করে, ভয়ের সাথে আরো ভয় সংযুক্ত হবে।

فَكَانَتْ سَرَابًا : فَاء মানে অতঃপর। এটা সংযুক্তি বর্ণ, পর্যায়ক্রমিক ধারা বর্ণনা করতে এসেছে। سَرَابًا মানে মরীচিকা। অর্থাৎ- পাহাড়সমূহ উন্মূলিত হয়ে মরীচিকা সদৃশ হবে। সূরা ওয়াকিয়াতে আল্লাহ বলেন, وَبُسَّتِ الْجِبَالُ بَسًّا، فَكَانَتْ هَبَاءً مُنْبَثًّا – অর্থাৎ- ‘আর পাহাড়সমূহকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে, অতঃপর তা উড়ন্ত ধূলায় পরিণত হবে।’ [আয়াত-৫,৬]

তাহলে পাহাড় ধ্বংসের বিষয়টি হল নিম্নরূপঃ প্রথমে এগুলোকে এর মূল থেকে উন্মূলিত করা হবে, অতঃপর এগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে, অতঃপর ধূলা যেমন আকাশে উড়তে থাকে, ঠিক তেমনি এগুলো ধূলা হয়ে শূন্যে ছড়িয়ে পড়বে, উড়তে থাকবে অথবা পাহাড়সদৃশ হয়ে থাকবে। অবলোকনকারী এগুলোকে মরীচিকার ন্যায় ভাববে। একজন পিপাসার্ত ব্যক্তি দূর থেকে যেমন মরীচিকাকে দেখে পানি মনে করে, অতঃপর কাছে গিয়ে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায় না; ঠিক তেমনি এসব পাহাড়গুলোও মরীচিকার মতো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ- দেখে মনে হবে পাহাড় আছে, কিন্তু যখন সেখানে যাবে, দেখবে পাহাড় নেই। পানি সদৃশ মরীচিকা যেমন পানিবিহীন, তেমনি ধূলা সদৃশ পাহাড়গুলোও পাহাড়বিহীন। আর তখন মানবকুল কবর থেকে উত্তোলিত হবে। পাহাড় ধ্বংস হওয়ার পর পৃথিবীর গাত্রে আন্দোলন সৃষ্টি হবে। এতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এ ভূমি ভিন্ন একটি ভূমিতে রূপান্তরিত হবে। মানবকুল একটি স্থির জায়গা অনুসন্ধান করবে আশ্রয়ের জন্য। আর পাহাড় যেহেতু পেরেক স্বরূপ তাই সে স্থানটি স্থির থাকাই যুক্তিযুক্ত, অথবা তারা পাহাড়ের পেছনে লুকাতে চাইবে হিসেব-নিকেশ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য, তখন তারা দূরপানে তাকিয়ে  পাহাড়  সদৃশ আবছায়া দেখতে পাবে, তা পাহাড় মনে করে সেখানে যাবে আশ্রয় নেয়ার জন্য, কিন্তু গিয়ে দেখবে সেখানে পাহাড় নেই, সেখানে আছে ধূলাবালি -যেমন একজন পিপাসার্ত ব্যক্তি পানির খোঁজে মরীচিকাকে পানি ভেবে তার পেছনে দৌঁড়ায়, গিয়ে দেখে পানি নেই -তা হল মরীচিকা, তখন হতাশায় ভোগে। অথবা, পাহাড় বিদীর্ণ হওয়ার পর উক্ত চূর্ণিত ধূলাবালি মরীচিকা সদৃশ উদ্ভূত হবে, অথচ তা ধুলাবালি। তবে এ ব্যাখ্যাটি নিলে পাহাড়ের মূল তাৎপর্য প্রস্ফুটিত হয় না যেমনটি হয় প্রথম ব্যাখ্যাটিতে। কারণ, পাহাড়কে মরীচিকার সাথে উপমা দেয়ার হেতু কী? পিপাসার্ত ব্যক্তি যেমন পানির খোঁজে মরীচিকাকে পানি মনে করে প্রতারিত হয়, তেমনি কিয়ামত দিবসে লোকেরা আশ্রয় অথবা লুকানোর জন্য দৃঢ় ও আড়াল স্থান অনুসন্ধান করবে। যেমন আল্লাহ বলেন, وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا – অর্থাৎ- আর আমরা তাদেরকে একত্র করব, কাউকে ছেড়ে দেব না। [সূরা কাহফ, আয়াত-৪৭] এখানে যেহেতু ছেড়ে না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাহলে বোঝা যায়, হিসেব-নিকেশ থেকে মুক্ত থাকার জন্য কেউ কেউ পলায়নের প্রচেষ্টা করবে এবং পাহাড়ের অন্তরালে অন্তরীত হতে যাচনা করবে, অথবা ভূমি যেহেতু আন্দোলিত হতে থাকবে, অনেকে আশ্রয়স্থল খোঁজার জন্য পাহাড়ের নিকট যাবে, কিন্তু গিয়ে দেখবে পাহাড় নেই, তা ধূলোবালি। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

আসমান চীর্ণ হওয়া, পাহাড় দীর্ণ হওয়া -এসব শক্তিশালী-সুদৃঢ় সৃষ্টি ধ্বংস হওয়া প্রমাণ করে প্রলয়ংকর দিবসটি অতিমাত্রায় ভয়ংকর হবে। আর এর দ্বারা মানবকুলকে সতর্ক করা হচ্ছে।

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

এখানে তাশবীহ বলীগ হয়েছে বা উপমা প্রদানে আধিক্য করা হয়েছে, ফলে উপমার অব্যয় পদ উল্লেখ করা হয় নি। আয়াতের মূল ধারা হল, وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ كالسَّرَابِ – অর্থাৎ- আর পাহাড়সমূহকে উন্মূলিত করা হবে, অতঃপর এটা মরীচিকার মতো হবে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

পাহাড়সমূহকে তাদের স্বীয় স্থান থেকে অপসারিত করা হবে, অতঃপর তা মরীচিকা সদৃশ ধূলায় পরিণত হবে। দেখে মনে হবে পাহাড়, অথচ তা ধূলা, যেমন মরীচিকাকে দেখে মনে হয় পানি, অথচ তা অস্তিত্বহীন।

إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا (21)

শব্দার্থঃ إِنَّ =  নিশ্চয়। جَهَنَّمَ = জাহান্নাম, দোযখ। كَانَتْ = ছিল, হল। مِرْصَادًا = সুরক্ষিত ঘাঁটি।

অর্থঃ নিশ্চয় জাহান্নাম হল সুরক্ষিত ঘাঁটি। [আয়াত ২১]

তাৎপর্যঃ

 إِنَّ جَهَنَّمَ: إِنَّ শব্দটি গুরুত্ববাহী শব্দ। جَهَنَّمَ শব্দটি হল ফারসী। এটাকে আরবি করা হয়েছে। এটা সাত প্রকার আগুন থেকে একটির নাম। তবে নামবাচক হিসেবে সকল জাহান্নামই উদ্দেশ্য।                                               

مِرْصَادًا : [اِسْمُ آَلَةِ وَصِفَةُ مُشَبَّهَةٍ لِلْمُبَالَغَةِ مِنْ رَاصِدَةٍ] মানে পর্যবেক্ষিত, সুরক্ষিত ঘাঁটি, রাস্তা, সুমুখে যা আছে তাই মিরসাদ, আবার এটা হল উক্ত স্থান যেখানে কেউ তার দুশমনের জন্য ওৎ পেতে বসে থাকে। 

এখানে আল্লাহ হিসেব-নিকেশের পর শাস্তির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমে বলেছেন কিয়ামতের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট সময়। আর এর পর তাদের জন্য অপেক্ষমান আছে জাহান্নাম যা হল একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। আল্লাহ এটাকে সৃষ্টি করেছেন কাফের, মুশরিকদেরকে শাস্তি প্রদানের জন্য। এখান থেকে পালাবার কোনো রাস্তা নেই। জাহান্নাম হল একটি ঘাঁটি -এ কথা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, এ ঘাঁটি মুসলিম, মুশরিক উভয়কেই পার হতে হবে। কিন্তু মুসলিমরা এ ঘাট পেরিয়ে জান্নাতে চলে যাবে। আর মুশরিক-কাফেররা জাহান্নামের অতল গহŸরে নিমজ্জিত হবে। এখানে ঘাঁটি বলতে আরেকটি বিষয় উদ্ভুত হয় যে, আমরা যেমন বিদেশে ভ্রমণ করার জন্য বিমানবন্দরে যাই, সেখানে ইমিগ্রেশনে লোক থাকে, তারা যাত্রীদের পাসপোর্টে সীল মেরে বিমানে উঠার অনুমতি দেয়। অতঃপর যাত্রীরা নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বিমানে আরোহণ করে, ঠিক তেমনি উক্ত জাহান্নামের ঘাঁটিতে জাহান্নাম ও জান্নাতের ফেরেশতারা অপেক্ষমান থাকবেন। তারা আগন্তুকদেরকে অভিবাদন জানাবেন। অর্থাৎ- যারা জান্নাতে যাওয়ার উপযুক্ত বা জান্নাতে যাওয়ার ছাড়পত্র আছে তারা জান্নাতে চলে যাবে, আর যাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

ইমাম রাযী বলেন, ‘এখানে দু’টি রূপ রয়েছে। যদি বলি ঘাঁটি বা আশ্রয়স্থল বলতে কাফেরদের আশ্রয়স্থল তখন এ আয়াতটি পরবর্তী আয়াতের সাথে সম্পর্কযুক্ত হবে, এটি পরিপূর্ণ আয়াত হবে না। অর্থাৎ- إِنَّ جَهَنَّمَ كَانَتْ مِرْصَادًا لِلطَّاغِينَ – আর مَئَابًا শব্দটি مِرْصَادًا থেকে পরিবর্তিত রূপ বা বদল হবে। আর যদি বলি مِرْصَادًا বা ঘাঁটি শব্দটি শর্তহীন, তাহলে এটা মুসলিম ও কাফের উভয়কেই উদ্দেশ করবে এবং এটি একটি পূর্ণ আয়াত হবে এবং পরেরটি পৃথক আয়াত হবে।’(তাফসীর রাযী, ৩১/১৯। )

তবে এখানে শর্তহীন হওয়া এবং পরিপূর্ণ আয়াত হওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ, কোরআনে আছে, আল্লাহ বলেন, وَإِنْ مِنْكُمْ إِلاَّ وَارِدُهَا – অর্থাৎ- তোমাদের মধ্যে কেউ নেই যে সেখানে অবতরণ করবে না। [সূরা মারইয়াম, ৭১] অর্থাৎ- মুসলিম-কাফের সবাইকেই জাহান্নামে অবতরণ করতে হবে বা জাহান্নামের ঘাঁটি পেরোতে হবে। নচেৎ কোনো মুসলিম জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। যেমন, তাফসীর তাবারীতে আছে, হাসান বসরী বলেন, ‘জান্নাতে কেউ প্রবেশ করবে না যাবৎ না সে জাহান্নাম পার হবে।’ কাতাদা বলেন, ‘এ আয়াত আমাদেরকে জানান দেয় যে, জাহান্নাম পেরোনো ব্যতীত জান্নাতে প্রবেশ করা যাবে না।’ সুফিয়ান বলেন, ‘জাহান্নামের উপর তিনটি ব্রিজ আছে।’(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫৯। )

মিকসাম ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, জাহান্নামের ব্রিজে সাতটি প্রতিবন্ধকতা বা বাধা আছে। প্রথমটায় বান্দাকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে দ্বিতীয়টিতে যাবে। সেখানে নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে তৃতীয়টিতে যাবে। সেখানে যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে চতুর্থটিতে যাবে। সেখানে রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে পঞ্চমটিতে যাবে। সেখানে তাকে হজ্জ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে সক্ষম হয় তাহলে ষষ্ঠটিতে যাবে। সেখানে তাকে ওমরা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি উত্তর দিতে পারে তাহলে সপ্তমটিতে যাবে। সেখানে তাকে অত্যাচার, নির্যাতন-নীপিড়ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি বের হতে সক্ষম হয় তাহলে তো পেরিয়ে গেল। আর সক্ষম না হলে বলা হবে, তোমরা তার নফল আমলসমূহ দেখ। যদি থাকে তাহলে তার দ্বারা পূর্ণ করা হবে। এ প্রক্রিয়া শেষ করার পর সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।(তাফসীর বঘভী, ৮/৩১৪।)

কাফের-মুশরিকরা জাহান্নামে যাবে ঠিক আছে, তবে মু’মিনদেরকে কেন জাহান্নামের ঘাঁটি পেরোতে হবে? এর উত্তর হল, প্রথমেই একটি কথা বলে নেই, মু’মিন যাদের জন্য জান্নাত ফায়সালা হয়ে গেছে, তাদের জন্য জাহান্নামে অবতরণ হবে আরামদায়ক। আগুন তাদের পোড়াবে না। তবে আগুনের ছোঁয়া লাগাতে হবে, কারণ, মানুষ মাত্রই কিছু ভুলত্রুটি থাকেই। কিন্তু আল্লাহ এই ভুলত্রুটিও মুক্ত করে জান্নাতে নেবেন, যাতে সে সকল পঙ্কিলতামুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করে। তাই জাহান্নামের অগ্নিতে একটু স্পর্শ হলেও লাগতে হবে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

কিয়ামতের হিসাব-নিকাশ পেরিয়ে যাওয়ার পর তাদের প্রত্যেকের জন্য অপেক্ষারত থাকবে জাহান্নাম। এ ঘাঁটি পেরোনোর পর যারা জান্নাতে যাওয়ার তারা জান্নাতে চলে যাবে। আর যারা জাহান্নামে যাওয়ার তারা জাহান্নামে যাবে।

لِلطَّاغِينَ مَآبًا (22)

শব্দার্থঃ لِـ = জন্য। الطَّاغِينَ = সীমালঙ্ঘনকারী। مَئَابًا = আশ্রয়স্থল।

অর্থঃ সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য আশ্রয়স্থল। [আয়াত ২২]

তাৎপর্যঃ

لِلطَّاغِينَ : এটা বহুবচন। এর একবচন হল اَلطَّاغِي। মানে সীমালঙ্ঘন কারী। সীমালঙ্ঘন করা দুইভাবে হয়ে থাকে। প্রথমতঃ কাফের যারা আল্লাহর উপর ঈমান না এনে কুফরি করেছে। নবী-রাসূলদের বিরোধিতা করেছে। এ সকল অহংকারীদের জন্য আল্লাহ জাহান্নামের আগুন নির্ধারণ করে রেখেছেন। এটা হল ধর্মের ব্যাপারে তাদের সীমালঙ্ঘন করা। অথবা উক্ত মুসলিম যারা হালাল-হারাম না মেনে বিরোধিতা করেছে। আর দ্বিতীয় প্রকার হল, মু’মিন যারা মানুষের সাথে অন্যায় আচরণ করে। তবে এর অধীনে প্রথম প্রকারও অন্তর্ভুক্ত। এটা হল পার্থিব ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করা। এই দ্বিতীয় প্রকার সীমালঙ্ঘনকারীরা যারা মু’মিন আল্লাহ যখন যাচনা করবেন তখন তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা হতে পারে নিপীড়িতদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করার মাধ্যমে, অথবা আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নিপীড়িতদেরকে কোনো প্রতিদান প্রদান করতঃ খুশি করার মাধ্যমে। তবে আয়াতের ধারাভাষ্যে যারা শিরক করেছে, কুফরি করেছে তারাই উদ্দেশ্য।

مَئَابًا : آَبَ يَؤُوبُ أُوبَةً : إِذَا رَجَعَ। প্রত্যাবর্তন করার স্থল বা আশ্রয়স্থল। এ শব্দটি প্রমাণ করে, পরকালই হল আসল ঠিকানা। এ দুনিয়া হল ক্ষণিকের জন্য ভ্রমণ স্বরূপ আসা। পরকালে আশ্রয়স্থল হল দু’টিঃ জান্নাত ও জাহান্নাম। জাহান্নাম হল কাফেরদের আশ্রয়স্থল, আর জান্নাত হল মো’মিনদের আশ্রয়স্থল যারা আল্লাহর প্রতি আশ্রয়ের পথ চয়ন করেছে।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

এই জাহান্নামই হল সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য আশ্রয়স্থল। তারা এখান থেকে পলায়ন করতে পারবে না।

لابِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا (23)

শব্দার্থঃ لاَبِثِينَ = অবস্থানকারীরা, অবস্থান করবে। فِيهَا = এতে বা জাহান্নামে। أَحْقَابًا = দীর্ঘসময় বা যুগের পর যুগ -উদ্দেশ্য হল অনন্তকাল।

অর্থঃ সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে। [আয়াত ২৩]

তাৎপর্যঃ

لاَبِثِينَ : এ শব্দটিকে দু’ভাবে পড়া যায়- لاَبِثِينَ ও لَبِثِينَ। ইমাম তাবারী বলেন, আলিফ দিয়ে বা لاَبِثِينَ পড়াটাই বেশি সঠিক।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫৯।) ইমাম র্ফারা বলেন, উভয়টার অর্থ একই। ইমাম যমখশরী বলেন, আলিফ ব্যতীত শব্দটি বা لَبِثِينَ অর্থগত দিক দিয়ে বেশি শক্তিশালী।(তাফসীর রাযী, ৩১/১৯।) কারণ এটা সিফাতের সিগা। মানে, অবস্থানকারীরা। তবে এটা বর্তমান ক্রিয়ারও অর্থ দেয়। কারণ, এটা কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া। মানে, অবস্থান করবে।

فِيهَا : এতে বা জাহান্নামে। هَا সর্বনামের আরোপ হল এক আয়াত পূর্বে উল্লেখিত জাহান্নাম।

أَحْقَابًا : এ শব্দটি হল حُقُبٌ ও حُقْبٌ এর বহুবচন। حُقُبٌ শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। যেমন তাফসীর কুরতুবীতে আছে, ইবনে উমর, আবু মুহাইসিন ও আবু হুরায়রা বলেন, হুকুব (حُقُبٌ) মানে আশি বছর। ইবনে আব্বাস বলেন, একবছর হল তিনশত ষাট দিন। আর দুনিয়ার হিসাব অনুযায়ী একদিন হল এক হাজার বছর। ইবনে উমর রাযি. এটাকে রাসূলুল্লাহ স. এর প্রতি মারফু‘ হিসেবে বর্ণনা করেন। আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, এক বছর হল তিনশত ষাট দিনে যা এ দুনিয়ার দিনের সমান। ইবনে উমর থেকে আরো বর্ণিত আছে, হুকুব মানে চল্লিশ বছর। ইমাম সুদ্দি বলেন, সত্তর বছর। আবার বলা হয় এক হাজার মাস। বুশাইর বিন কা‘ব বলেন, তিনশত বছর। হাসান বসরী বলেন, আহকাব (أَحْقَابًا) বলতে  কত সময়  উদ্দেশ্য তা কেউ  জানে না।  অনেকে  বলেন,  একশত হুকুব। এক হুকুব হল সত্তর হাজার বছর। আর একদিন হল এক হাজার বছর তোমাদের হিসেব অনুযায়ী, তথা পৃথিবীর হিসেব অনুযায়ী।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭৮-১৭৯।)

তবে ইমাম তাবারী আবু হুরায়রা রাযি.-এর কথাকে এভাবে উল্লেখ করেন, আবু হুরায়রা বলেন, হুকুব হল আশি বছর। একবছর হল তিনশত ষাট দিনে। আর একদিন হল একহাজার বছর।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৬১-১৬২।)

ইমাম তাবারী উল্লেখ করেন, আলী রাযি. হেলাল আল-হাজারীকে বলেন, আল্লাহর কিতাবে হুকুব কতদিন পাও? তিনি বললেন, আশি বছর। প্রতি বছর বারো মাসে। প্রতি মাস ত্রিশ দিনে। প্রতিদিন একহাজার বছর।

কাতাদা বলেন, পরকালের বছর হিসেবে হুকুব হল আশি বছর। হাসান আল-বসরীকে উক্ত আয়াত (لاَبِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, আহকাব বা কয়েক হুকুব-এর নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই জাহান্নামে চিরকাল অবস্থান করা ব্যতীত। কিন্তু লোকেরা বলে, এক হুকুব হল সত্তর হাজার বছর। আর উক্ত সত্তর হাজার বছরের প্রতিটি দিন হল এক হাজার বছরের সমান তোমাদের হিসেব অনুযায়ী।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭৮-১৭৯।) তাঁর থেকে আরেকটি আছর বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আহকাব কী, এটা কেউ জানে না। তবে হুকুব হল সত্তর হাজার বছর, আর প্রতিদিন হল একহাজার বছর।(তাফসীর তাবারী, ২৪/১৬১-১৬২।)

ইমাম কুরতুবী ইমাম ছা‘লাবীর বরাত দিয়ে একটি হাদিস উল্লেখ করেন, উমর বিন আল-খাত্তাব বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যে জাহান্নামে প্রবেশ করবে সে আহকাব বা কয়েক হুকুব অবস্থান না করা পর্যন্ত সেখান থেকে বের হবে না। এক হুকুব হল আশি এবং আরো কয়েক বছর। আর একবছর হল তিনশত ষাট দিনে। আর একদিন হল এক হাজার বছর তোমাদের হিসেব অনুযায়ী।’ আল-কুরযী বলেন, তেতাল্লিশ হুকুবে এক আহকাব। প্রতি হুকুবে হল সত্তর হেমন্ত বা বছর। প্রতি হেমন্ত হল সাতশত বছরে। প্রতি বছর হল তিনশত ষাট দিনে। আর প্রতিদিন হল একহাজার বছর।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭৯।)

এ হাদিসটি ইবনে উমর রাযি.-এর বরাত দিয়ে আবু বকর আল-শাফেয়ী তার আল-ফাওয়ায়েদুশ শহীর বিল গাইলানিয়াত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

যাহোক, এ শব্দটির ব্যাখ্যায় নানা মত রয়েছে। তবে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য হল, কাফেরদের জন্য অনন্তকাল। আর মুসলিম গোনাহগার যারা জাহান্নামে যাবে তারা কয়েক হুকুব অবস্থান করার পর আল্লাহ যখন যাচনা করবেন তখন জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবার আল্লাহ শুরু থেকেও চাইলে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেন। কিন্তু গোনাহভোগের শাস্তি হল কয়েক হুকুব।

এখানে একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয়, সেখানে তারা কয়েক হুকুব অবস্থান করবে – সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝা যায়, একটি সময় পর তা শেষ হয়ে যাবে। তাহলে এর দ্বারা একটি বিষয় অনুধাবন করা যায় যে, একসময় জাহান্নাম লয় হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত হল, জান্নাত ও জাহান্নাম লয় হবে না। এটা অনন্তকাল থাকবে। জাহমিয়াদের কথা হল, জাহান্নাম লয় হয়ে যাবে। অনেকে ইবনে তাইমিয়ার প্রতি জাহান্নাম লয় হওয়ার কথাটি সম্পৃক্ত করেছেন। কিন্তু এটা তাঁর  প্রতি একটি মিথ্যারোপ করা হয়েছে। তিনি কোথাও এ কথা উল্লেখ করেননি। তবে তাঁর ছাত্র ইবনে কাইয়িম আল-জাওযিয়া এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন। তিনি তার আল-ওয়াবেল আল-সাইয়িব, তরিকুল হিজরাতাইন, শিফাউল আলীল, ও আল-সাওয়ায়েক আল-মুরসালা গ্রন্থে এ বিষয়ে বিভিন্ন কথা উল্লেখ করেছেন। তার থেকে দু’টি মত রয়েছে, একটি হল, জাহান্নাম লয় হয়ে যাবে, এবং আরেকটি হল, তিনি তার এ মত থেকে প্রত্যাবর্তন করতঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মত গ্রহণ করেছেন যে, জাহান্নাম লয় হবে না। আর এটি হল তার শেষের মত।

জাহান্নাম লয় হওয়ার চিন্তাটি এসেছে এই আয়াত ও সূরা হুদের ১০৬ ও ১০৭ নং আয়াত থেকে। সেখানে আল্লাহ বলেন,

 فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ (106) خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالأرْضُ إِلا مَا شَاءَ رَبُّكَ إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ (107)

অর্থাৎ- ‘আর যারা অবাধ্য হয়েছে বা পথভ্রষ্ট হয়েছে, তারা জাহান্নামে অবস্থান করবে। তাদের জন্য রয়েছে দীর্ঘশ্বাস ও কর্কশ আওয়াজ। তারা সেখানে অবস্থান করবে যতদিন আকাশ ও জমিন থাকে। কিন্তু আপনার রব যা যাচনা করেন। নিশ্চয় আপনার রব করিতকর্মা যা তিনি যাচনা করেন।’ [সূরা হুদ, আয়াত ১০৬-১০৭]

আমরা এ বিষয়টি নিয়ে সূরা হুদে সবিস্তারে আলোচনা করব, ইন শা- আল্লাহ। এখানে পরিমিতটুকু আলোচনা করছি। خَالِدِينَ এ শব্দটির মূল ধাতু হল, خُلُودٌ। এ শব্দের মূল অর্থ হল দীর্ঘকাল অবস্থান করা, কিন্তু যদিও এর অর্থ অনাদি-অনন্তকাল নেয়া হয়। আবার আহকাব মানে কয়েক হুকুব। তাহলে শব্দদ্বয় প্রমাণ করে জাহান্নাম চিরকাল থাকবে না। সূরা নাবা’য় উক্ত আয়াতের পরে শাস্তির কথা বলা হয়েছে, আবার সূরা হুদেও জাহান্নামে অবস্থান করার পর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তাই স্কলারদের মত হল, এখানে যে দীর্ঘকাল অবস্থানের কথা বলা হয়েছে তার উদ্দেশ্য হল, জাহান্নামীরা একই ধরনের শাস্তিতে দীর্ঘকাল বা আহকাব বা কয়েক হুকুব পর্যন্ত ভুগতে থাকবে। তারপর শাস্তির ধরন পরিবর্তন করা হবে। এভাবে পর্যায়ক্রমিক ধারা অব্যাহত থাকবে। আগুনের জাহান্নাম থেকে বরফের জাহান্নামে যাবে। কখনো দীর্ঘশ্বাস ও উচ্চবাচ্যে ভুগবে, আবার কখনো গরম পানি ও পুঁজ পানে ভুগবে -এভাবে শাস্তির ধরন পরিবর্তন হবে।

তাফসীর আল-খাযেন-এ  لاَبِثِينَ فِيهَا أَحْقَابًا -আয়াতের কয়েকটি ব্যাখ্যা করেন এভাবেঃ

প্রথমতঃ হাসান বসরী বলেন, আল্লাহ তায়ালা জাহান্নামের জন্য কোনো সময় উল্লেখ করেননি। বরং তিনি বলেছেন, তারা সেখানে কয়েক হুকুব তথা হুকুবের পর হুকুব অবস্থান করবে। এর উদ্দেশ্য হল, একটি হুকুব শেষ হবে, আরেকটি হুকুব প্রবেশ করবে- এভাবে চলতে থাকবে অনন্তকাল। সুতরাং আহকাবের অনন্তকাল অবস্থান করা ছাড়া আর কোনো অর্থ নেই। ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যদি জাহান্নামবাসীরা জানত, তারা জাহান্নামে দুনিয়ার নুড়ির সংখ্যার ন্যায় সেখানে অবস্থান করবে তাহলে তারা খুশি হত। আর যদি জান্নাতবাসীরা জানত, তারা দুনিয়ার নুড়ির সংখ্যার ন্যায় জান্নাতে অবস্থান করবে, তাহলে তারা দুশ্চিন্তা করত।

দ্বিতীয়তঃ আহকাব মানে অনন্তকাল উদ্দেশ্য নয়। বরং এই আহকাব পরিমাণ সময় তারা শীতলতা আস্বাদন করবে না, পানীয় আস্বাদন করবে না, তবে গরম পানি ও পুঁজ। তাহলে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন আহকাবে তারা ভিন্ন ভিন্ন রকম শাস্তিতে ভুগবে।

তৃতীয়তঃ এ আয়াতটি রহিত হয়ে গেছে আরেকটি আয়াত দ্বারা। আল্লাহ বলেন, فَذُوقُوا فلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا – অর্থাৎ-‘অতঃপর আমরা তোমাদের শাস্তি বৈ আর কিছু বৃদ্ধি করব না।’ [সূরা নাবা, আয়াত ৩০]। এ আয়াত দ্বারা সংখ্যা দূরীভূত হয়েছে এবং চিরকাল নির্ধারিত হয়েছে।(তাফসীর আল-খাযেন, আলাউদ্দীন আল-বাগদাদী, ৭/২০১)

তবে ইমাম কুরতুবী এই তৃতীয় নম্বর ব্যাখ্যায় মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘ সংখ্যা দূরীভূত হয়েছে এবং চিরকাল নির্ধারিত হয়েছে’-এটা একটি সংবাদ। আল্লাহ বলেন, وَلاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ -অর্থাৎ- ‘তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যাবৎ উট সূঁচের ছিদ্রে প্রবেশ করবে।’ [সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৪০] এটা হল কাফেরদের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ- উট যেমন সূঁচের ছিদ্রে কখনও প্রবেশ করতে পারবে না, তারাও কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে না। তবে যারা পাপিষ্ঠ মু’মিন, পাপ করেছে, তাদের ব্যাপারে আয়াতটি রহিত হওয়া মানে হল সময় নির্দিষ্ট হওয়া। অর্থাৎ তারা নির্দিষ্ট একটি সময় পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করতঃ জান্নাতে প্রবেশ করবে।(তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭৯।)

জাহান্নাম যে লয় হবে না সে বিষয়ক আরো প্রমাণাদিঃ

আল্লাহ বলেন, كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا أُعِيدُوا فِيهَا -অর্থাৎ- তারা যতবারই সেখান [জাহান্নাম] থেকে বের হতে চাইবে তাদেরকে সেখানে প্রত্যাবর্তন করানো হবে। [সূরা সাজদা, আয়াত ২০]

আল্লাহ বলেন, كُلَّمَا نَضِجَتْ جُلُودُهُمْ بَدَّلْنَاهُمْ جُلُودًا غَيْرَهَا-অর্থাৎ- তাদের চামড়া যতবারই পেকে যাবে বা পুড়ে যাবে, তাদের চামড়াকে ভিন্ন আরেক চাড়মায় পরিবর্তন করে দেব। [সূরা নিসা, আয়াত ৫৬]

আল্লাহ বলেন, ثُمَّ لاَ يَمُوتُ فِيهَا وَلاَ يَحْيَا – অর্থাৎ- সে সেখানে মরবে না এবং জীবিতও হবে না। [সূরা আ‘লা, আয়াত ১৩]

ইবনে উমর রাদ্বি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আল্লাহ তায়ালা জান্নাতবাসীকে জান্নাতে এবং জাহান্নামবাসীকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। অতঃপর এক ঘোষক ঘোষণা দেবেন, ওহে জান্নাতবাসীরা! আর মৃত্যু নেই। ওহে জাহান্নামবাসীরা! আর মৃত্যু নেই। যে যেখানে আছে সে সেখানে চিরকাল থাকবে।(সহিহ মুসলিম, ৪/২১৮৯, হাদিস নং ৪২-২৮৫০। (জাহান্নাম লয় হওয়ার বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য ইবনে কাইয়িম আল-জাওযিয়ার উক্ত কিতাবগুলো অধ্যয়ন করুন। আর জাহান্নাম লয় না হওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আলী আল-হারবী কর্তৃক প্রণীত: কাশফুল আসতার লি-ইবতালে ইদ্দিআয়ে ফানায়িন নার গ্রন্থটি পড়ুন।))

তাৎপর্যগত অর্থঃ

কাফের-মুশরিকরা জাহান্নামে যুগের পর যুগ, অনাদি-অনন্তকাল অবস্থান করবে যার কোনো শেষ নেই। যুগের পর যুগ আসতেই থাকবে পালাক্রমে।

Share this:

Leave a Comment

slot resmi jambitoto sumseltoto punktoto situs toto punktoto toto slot rupiahbet rupiah bet rupiahbet rupiah bet rupiah bet rupiah bet sumseltoto toto slot sumseltoto situs toto sumseltoto situs toto sumseltoto sumsel tototest