সূরা নাবা’

৬- ১১ আয়াতে পৃথিবীর সৃষ্টি বৈশিষ্ট্য এবং মানবজাতির প্রয়োজন এবং এতে রয়েছে পরকাল অবশ্যম্ভাবিতার আকরঃ

أَلَمْ نَجْعَلِ الأرْضَ مِهَادًا (6) وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا (7) وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا (8) وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا (9) وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا (10) وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا (11)

আয়াত ভিত্তিক শব্দার্থ, আয়াতের অর্থ ও তাৎপর্যঃ

أَلَمْ نَجْعَلِ الأرْضَ مِهَادًا

শব্দার্থ: أَ = কি? হ্যাঁ/ না উত্তরের জন্য প্রশ্নবোধক শব্দ।  لَمْ= না বোধক শব্দ, ভবিষ্যৎ ক্রিয়ার আগে যুক্ত হয়ে অতীতের অর্থে রূপান্তরিত করে। نَجْعَلْ = আমরা বানাই। أَلَمْ نَجْعَلْ= আমরা কি বানাইনি? الْأَرْضَ = পৃথিবী। مِهَادًا = দোলনা যা বাচ্চাকে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, বিছানা, চলার জন্য উপযোগী করে প্রস্তুত করা হয়েছে। আবার এটাকে মাসদার বা ক্রিয়ামূল হিসেবেও উল্লেখ করা হয়, অর্থাৎ- مَهْدٌ।

অর্থঃ আমরা কি পৃথিবীকে বিছানা/ দোলনা বানাইনি? [আয়াত ৬]

তাৎপর্যঃ

أَلَمْ نَجْعَلِ : আমরা কি বানাইনি বা আমরা কি তৈরি করিনি? এখানে না-বোধক প্রশ্ন বলে উদ্দেশ্য হল এর বিপরীত তথা হ্যাঁ-বোধক বিবৃতিমূলক বাক্য গুরুত্ব সহকারে প্রমাণিত হওয়া। এখানে না বোধক প্রশ্ন বলতে উদ্দেশ্য হল, নিশ্চয় আমরা পৃথিবীকে বিছানা বানিয়েছি, এবং এতে কোনো সন্দেহ নেই। আরবি ভাষার কিছু রীতি রয়েছে যে, এমন কিছু বাক্য রয়েছে যেগুলো তার বিপরীত অর্থটি গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়, তন্মধ্যে থেকে এটি একটি।

الْأَرْضَ : পৃথিবী হল সূর্যের তৃতীয় গ্রহ এবং আকার ও ভরের দিক দিয়ে সৌরজগতের পঞ্চম বৃহৎ গ্রহ। এটা দেখতে উজ্জ্বলÑনিলাভ গ্রহ। অন্তস্থল থেকে বহির্ভাগের দিকে এর শ্রেণিবিন্যাস হলঃ অন্তস্থল , আবরণ , ভূত্বক , বারিমণ্ডল -প্রধানত মহাসাগরসমূহ যেটা নিচের ভূত্বক অঞ্চলগুলো পূর্ণ হয়ে আছে), বায়ুমণ্ডল  -এটা গোলাকার অঞ্চলে ভাগ হয়ে আছে, যেমন ট্রপোস্ফিয়ার যেখানে বায়ু দৃষ্ট হয়, এবং স্ট্রেটস্ফিয়ার যেখানে ওজোন স্তর অবস্থিত যেটা পৃথিবীর উপরিভাগকে রক্ষা করে এবং এর গঠনকে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে), এবং ম্যাগনেটস্ফিয়ার শূন্য জায়গায় বা স্পেইসে এটা একটা বিশাল অঞ্চল যেখানে পৃথিবীর চৌম্বকীয় অঞ্চল সূর্য থেকে আগত বৈদ্যুতিকভাবে ভরা কণাগুলোর ধর্মের উপর আধিপত্য বিস্তার করে।) এছাড়াও আরো স্তর রয়েছে। আজ অবধি এ পৃথিবীই একমাত্র জীবনবান্ধব গ্রহ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।

مِهَادًا : দোলনা, দোলনা সদৃশ, সমতল ভূমি, মেঝে। একটি দোলনা যেমন ঝুলে থাকে এবং চতুর্দিক থেকে বেষ্টনী দেয়া থাকে একটি শিশুর নিরাপত্তার জন্য, তদুপরি বিছানা হল সমতল; তেমনি এখানে পৃথিবীকে দোলনা বলতে উদ্দেশ্য হল, এট ঝুলন্ত বিছানা তবে সুরক্ষিত সমতল মেঝে। এটা ইঙ্গিত দেয় যে, পৃথিবী গোলাকার এবং এর চারদিকে সুরক্ষা বন্ধনী আছে। কারণ, যদি গোলাকার না হত, তাহলে একটা সীমানায় গিয়ে এটা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু গোলাকার হওয়ার ফলে একজন পরিব্রাজক যেদিকেই যাক না কেন, তার সম্মুখে এটা সমতল বলেই প্রতিভাত হবে। আর পৃথিবীকে বিভিন্ন সৌর আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য যদি সুরক্ষা বন্ধনী না থাকত, তাহলে এ পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীরা ধ্বংস হয়ে যেত। হয়ত প্রশ্ন আসতে পারে, বিছানা বলতে যেহেতু সমতল বোঝায়, তাহলে পৃথিবী সতমল হল কীভাবে, এর পৃষ্ঠভাগে অনেক উঁচুনিচু, খাদ রয়েছে? উত্তর হল, এই উঁচুনিচু, খাদ -এসব হল আপেক্ষিক। আর এই আপেক্ষিকতা পৃথিবীর বিছানা হওয়াতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না। তা না হলে সৃষ্টিকুল এর পৃষ্ঠভাগে চলাফেরা করতে সক্ষম হত না। এর সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি নেই। ত্রুটি থাকলে এটা আর বিছানা হিসেবে স্বীকৃতি পেত না।

অর্থাৎ- আমরা কি পৃথিবীকে দোলনার মতো বানাইনি? একটি বাচ্চা যেমন দোলনায় শুয়ে থাকে, আবার এপাশ-ওপাশ হয়, তেমনি লোকেরা এখানে বাস করে, এদিক-সেদিক চলাফেরা করে। কিন্তু কাফেরদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে যাতে উত্তরটি তাদের দিক থেকেই আসে। আর উত্তর তো এখানে অবশ্যই হ্যাঁ-বোধকই হবে। আর প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে এ ধরনের প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া প্রশ্নকারীর মনে সরাসরি উত্তরের চেয়ে ইতিবাচক প্রভাব বেশি বিস্তার করে।

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা উপমা প্রদানে আধিক্য হয়েছে বা অতি উপমা হয়েছে। আয়াতটির মূল রূপ হল, أَلَمْ نَجْعَلِ الْأَرْضَ كَالْمِهَادِ

 -অর্থাৎ-আমরা কি ভূমিকে দোলনা সদৃশ বানাইনি?( তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা যুহাইলী, ৩০/৭। )

একবচনের ক্ষেত্রে বহুবচনের ব্যবহারঃ

এখানে একটি প্রশ্নের অবতারণা হয়, তা হলঃ আল্লাহ হলেন একক এক সত্তা। তাহলে তিনি এখানে এবং পরবর্তী আয়াতসমূহে এবং অন্যান্য স্থানেও বারবার বহুবচনের সর্বনাম যুক্ত ক্রিয়া তথা ‘আমরা’ ব্যবহার করেছেন কেন?

এর উত্তর হলঃ প্রথমতঃ আরবিতে সম্মানার্থে একবচনের ক্ষেত্রে বহুবচন ব্যবহার করা হয়। সেদিকে খেয়াল রেখে বহুবচনের ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আল্লাহ তায়ালা তাওহীদ বা একত্ববাদের ক্ষেত্রে বহুবচনের সর্বনাম অথবা ক্রিয়া ব্যবহার করেননি। সেখানে তিনি সর্বদা একবচন ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয়তঃ আল্লাহর যেসব কাজে ফেরেশতারাও অংশগ্রহণ করেন সেক্ষেত্রেও বহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। তখন ফেরেশতারাও এর অন্তর্ভুক্ত হয়।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

একটি বাচ্চা যেমন দোলনায় শয়ন করে, এপিঠ-ওপিঠ গড়াগড়ি করে, কিন্তু সে পড়ে যাওয়ার ভয় করে না। সে নিরাপদ থাকে। ঠিক তেমনি পৃথিবীকে দোলনা সদৃশ সমতল করে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এখান থেকে শূন্যে ছিটকে পড়বে না। সে এখানে নিরাপদে চলাফেরা করতে পারবে।

وَالْجِبَالَ أَوْتَادًا

শব্দার্থ: الْجِبَالَ = পাহাড়সমূহ। أَوْتَادًا = পেরেকসমূহ।

অর্থঃ আর পাহাড়রাজিকে পেরেক? [আয়াত ৭]

তাৎপর্যঃ

وَالْجِبَالَ : পাহাড়সমূহ। শব্দটি বহুবচন। এর একবচন- الْجَبَلُ। আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ৩৯ জায়গায় পাহাড়ের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। তন্মধ্যে থেকে এই আয়াতটিও। অর্থাৎ- আমরা কি পাহাড়সমূহকে পেরেক সদৃশ বানাইনি? এখানেও প্রশ্নটির উদ্দেশ্য হল, হ্যাঁ-বোধক বিবৃতিমূলক। অর্থাৎ-নিশ্চয় আমরা পাহাড়সমূহকে পেরেক স্বরূপ স্থাপন করেছি। আল্লাহ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করলেন তখন এটা দুলছিল, আন্দোলিত হচ্ছিল। আন্দোলিত হওয়ার কারণ এটাও হতে পারে যে, পৃথিবীর গাত্রে যে আপেক্ষিক উঁচু-নিচু রয়েছে, ফলে ভারসাম্য ছিল না -সেজন্য। তাই এটাকে স্থির করার জন্য পাহাড়কে পেরেক স্বরূপ স্থাপন করেছেন এবং সুদৃঢ় করেছেন যাতে পৃষ্ঠভাগের সৃষ্টিকুলকে নিয়ে হেলে না পড়ে, আন্দোলিত না হয়, যেমন ঘরবাড়ি, চেয়ার-টেবিলকে পেরেক মেরে সুদৃঢ় করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَأَلْقَى فِي الْأَرْضِ رَواسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ অর্থাৎ- ‘আর তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পাহাড় স্থাপন করেছেন যাতে তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে।’ [সূরা নাহল, ১৫]।

হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, ‘যখন আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, এটা আন্দোলিত হচ্ছিল। অতঃপর পাহাড় সৃষ্টি করলেন এবং এটাকে এর গাত্রে  স্থাপন করলেন এবং এটা স্থির হল। পাহাড় সৃষ্টি অবলোকন করতঃ ফেরেশতারা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি পাহাড়ের চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, লোহা। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি লোহার চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে?  তিনি  বললেন, হ্যাঁ, আগুন। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি আগুনের চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, পানি। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি পানির চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, বাতাস। তারা বলল, হে রব! আপনার সৃষ্টিরাজিতে কি বাতাসের চেয়ে আরো শক্তিশালী কোনো বস্তু আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, বনি আদম যখন ডান হাত দিয়ে দান করে এবং তা বাম হাত থেকে গোপন রাখে।’(মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১২২৭৫, হাদিসটি দ্বয়ীফ। কারণ সুলাইমান বিন আবি সুলাইমান মাজহুল বা অপরিচিত। )

প্রশ্ন আসে, আল্লাহ চাইলে তো পৃথিবীকে এমনিতেই স্থির করতে পারতেন, তাহলে পাহাড়ের প্রয়োজন দেখা দিল কেন? উত্তরে বলতে হয়, আল্লাহ চাইলে ঠিকই পারতেন। কিন্তু আল্লাহ এ জগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং এর কিছু বিধান ও কার্যকারণও নির্ধারণ করেছেন। আর উক্ত কার্যকারণের নিয়ন্তাও তিনিই। সুতরাং পাহাড় বিনে পৃথিবী সৃষ্টি অথবা পাহাড় সমেত পৃথিবী সৃষ্টি -সে আল্লাহর সকাশ একই।

أَوْتَادًا : পেরেকসমূহ। শব্দটি বহুবচন। এর একবচন-وَتَدٌ । পেরেক বানানো হয়েছে বলতে উদ্দেশ্য হল, পেরেক সদৃশ।

পাহাড়কে পেরেকের সাথে উপমা দেয়ার কারণঃ

এখানে একটি প্রশ্ন আসে, পাহাড়কে কেন পেরেকে বা লোহার সাথে তুলনা করা হল? একটি কাষ্ঠখণ্ড একটি লোহা প্রবিষ্ট করলে যেমন এর অধিকাংশ অংশই ভিতরে প্রবেশ করে এবং এর অল্পমাত্রা বহির্ভাগে থাকে উক্ত কাষ্ঠখণ্ডকে সুদৃঢ় করার জন্য, আর এর কাজ হল শক্ত, মজবুত ও সুদৃঢ়করণ। ঠিক তেমনি পাহাড়ের বেলাতেও। উত্তরকালে ভূ-বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, পাহাড়ের যে অংশ মাটির উপরে দণ্ডায়মান থাকে, এর ১০ থেকে ১৫ গুণ প্রলম্ব অংশ মাটির গাত্রে প্রোথিত থাকে যা সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরে থাকে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা যতই বেশি হবে, ভূ গাত্রের অভ্যন্তরেও এর ভাগ বেশি হবে, যাতে ভূ গাত্রের পাথুরে স্তর পেরুতে পারে এবং ভূ গাত্রের দুর্বল অঞ্চলে ভেসে থাকতে পারে। উক্ত অঞ্চল বিগলিত, কোমল, অতিমাত্রায় ঘন ও আঠালো। সেখানে পেরেক সদৃশ পাহাড়টি ভাসমান থাকে। স্থলভাগের শূন্যতা যত বেশি হবে, পাহাড়ের চূড়া তত উঁচু হবে এবং এর প্রোথিত অংশও তত প্রলম্ব হবে যাতে নিচের আঠালো অঞ্চলে পৌঁছতে পারে। তখন পাহাড় তার আন্দোলন থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। এর নিচে নানা খনিজ পদার্থের উদ্ভব ঘটে যা ঘটা সম্ভবপর নয় কিন্তু চাপ-তাপ বিহীন ব্যতিক্রম পরিবেশ ব্যতিরেকে। আর এ পরিবেশটিই বিরাজ করে উক্ত পাহাড়ের নিচে। আর এভাবে কোরআন পাহাড়ের পেরেক সদৃশ বৈশিষ্ট্যটি বর্ণনা করে।(আল-মাফহুমুল ইলমি লিল-জিবাল ফিল কুরআনিল কারীম -ড. যগলুল আল-নাজ্জার, ৩/১৮। )

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা উপমা প্রদানে আধিক্য হয়েছে বা অতি উপমা হয়েছে। মূল বাক্যটি হল, أَلَمْ نَجْعَلِ الْجِبَالَ كَالْأَوْتَادِ -অর্থাৎ-আমরা কি পাহাড়কে পেরেক সদৃশ স্থাপন করিনি?( তাফসীর মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

পৃথিবী এর অধিবাসীকে নিয়ে যাতে ঢলে না পড়ে বা এতে দুর্বলতার কারণে বিশৃঙ্খলতা দেখা না দেয়, সেজন্য এতে পাহাড়কে পেরেক সদৃশ প্রোথিত করা হয়েছে।

وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا (8)

শব্দার্থ: وَخَلَقْنَا = আর আমরা সৃষ্টি করেছি। كُمْ= তোমাদেরকে। أَزْوَاجًا = জোড়া জোড়া অবস্থায়।

অর্থঃ আর আমরা তোমাদেরকে জোড়া জোড়া অবস্থায় সৃষ্টি করেছি। [আয়াত ৮]

তাৎপর্যঃ

وَخَلَقْنَاكُمْ : আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি- সৃষ্টি বলতে বোঝায় কোনো কিছুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা, নতুনভাবে সৃষ্টি করা।

أَزْوَاجًا : জোড়া জোড়া অবস্থায় অথবা জোড়ায় জোড়ায়। এটা বহুবচন শব্দ। এর একবচন- زَوْجٌ। এটা এখানে অবস্থা বর্ণনা করেছে। সাধারণ দৃষ্টিতে জোড়া জোড়া বলতে উদ্দেশ্য হল নারী ও পুরুষ। زَوْجٌ বলতে স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই বোঝায়, যেমন ইংরেজি ংঢ়ড়ঁংব শব্দ। এটা বলতে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই বোঝায় বা উভয়ের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়। অথাৎ স্বামী হল স্ত্রীর জন্য زَوْجٌ বা জোড়া, আর স্ত্রী হল স্বামীর জন্য زَوْجٌ বা জোড়া। আল্লাহ নারী-পুরুষকে এভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন তারা একে অপরের জোড়া হতে পারে, একে অপরের প্রশান্তির কারণ হয়, সবকিছুতে অংশীদার হয়। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির প্রতি বিশেষ এক নেয়ামত। তাই তাদের উচিত তাঁর শুকরিয়া আদায় করা। তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করা।

অর্থাৎ- আল্লাহ তায়ালা বংশপ্রক্রিয়া বহাল রাখার জন্য সবকিছু জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন। আবার বলা হয় أَزْوَاجٌ মানে বিভিন্ন ধরনের অর্থেও আসে। অর্থাৎ- সাদা, কালো, লালচে, খাটো, লম্বা, ভাষা ইত্যাদি প্রকৃতির। এটা হল সকল মুফাসসিরদের ব্যাখ্যা। তবে সাইয়িদ কুতুব তার ফী যিলালিল কুরআনে একটি ভিন্ন মর্ম উল্লেখ করার প্রয়াস পান। যার সারমর্ম হল, বংশপ্রক্রিয়া বজায় রাখার জন্য নারী-পুরুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টির করার ফলে স্বামী-স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা নিবারণে যে আনন্দ, পরিতৃপ্তি রয়েছে তা বোঝার জন্য গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এখানে এ বিষয়টিকে  একটু  ভিন্ন ও গভীর ভাবে মূল্যায়ন করলে এ বিষয়টি প্রতিভাত হয় যে, বাহ্যিকভাবে শুক্রকীটে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। কিন্তু এই শুক্রকীটে দুইটি প্রকার রয়েছে। ‘ওয়াই ক্রোমোজম ও এক্স ক্রোমোজম’। তেমনি নারীর ডিম্বাণুতে রয়েছে দু’টি এক্স ক্রোমোজম। ওয়াই ক্রোমোজম নারীর ডিম্বাণুর সাথে নিষিক্ত হলে সন্তান হবে ছেলে, আর এক্স ক্রোমোজম নিষিক্ত হলে সন্তান হবে মেয়ে। সৃষ্টিকুলে এই যে ভেদ রয়েছে এই সূ² কারিগরির কার্যপ্রক্রিয়া স্বয়ং আমি আল্লাহই সন্নিবেশ করেছি। এখানে তোমাদের কোনো হাত নেই।(ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৪ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৪-পিডিএফ)। (তার কথা উপস্থাপনে কিছুটা পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে -লেখক।))

জোড়া জোড়া বলতে যা উদ্দেশ্যঃ

সাধারণভাবে বোঝা যায় নারী ও পুরুষ। কিন্তু সাইয়িদ কুতুব এর অর্থ নিয়েছেন শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর সংযোজনে জোড়া বস্তুর দ্বারা একটি মানব সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালা যেহেতু এখানে خَلَقْنَا বলেছেন, যা অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা বোঝায়, সে দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে أَزْوَاجٌ শব্দটি বলতে জোড়া জোড়া ক্রোমোজম দিয়েই সৃষ্টি করা বোঝাবে। যদি জোড়া জোড়া বলতে নারী-পুরুষ বোঝাতেন তাহলে خَلَقْنَا না বলে جَعَلْنَا বলতেন। অর্থাৎ- নারী-পুরুষকে জোড়া জোড়া বানিয়েছেন। جَعَلْنَا ব্যবহার করা হয় একটি কিছু সৃষ্টি করার পর তার জন্য যে নীতিমালা ও বিধান তৈরি করা হয় সেক্ষেত্রে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি সৃষ্টির অর্থ নিয়ে নারীÑপুরুষ জোড়া জোড়া অর্থ গ্রহণ করি, তাহলে এটি এ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত দেয় যে, একই জঠরে ছেলে ও মেয়ে একসাথে জন্ম নেবে। কিন্তু তা হয় না। যদিও দুর্লভ দু-একটি ঘটনা ঘটে যে, একই জঠরে ছেলে ও মেয়ে জমজ জন্মলাভ করেছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

خَلَقْنَا ও جَعَلْنَا ক্রিয়ার শব্দগত লেখার কয়েকদিন সূরা কিয়ামাহ পড়লাম। সেখানে একটি আয়াত যেটা বক্ষমান এ আয়াত ও এ বিষয়টির সমাধান দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, فَجَعَلَ مِنْهُ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالأنْثَى Ñঅর্থাৎ-অতঃপর তা থেকে দুইজোড়া বানিয়েছে -পুরুষ ও নারী। [সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ৩৯]। এখানে তা থেকে বলতে উদ্দেশ্য হল, বীর্যের যে শুক্রাণু থেকে তাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে আটকানো অবস্থায় অতঃপর তাকে সুগঠিত করেছেন। অতঃপর পুরুষ ও নারী দুই জোড়া বানিয়েছেন। এক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা সুগঠিতকরণের ক্ষেত্রে বা সূরা কিয়ামাহর ৩৮ নং আয়াতে خَلَقَ ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। কিন্তু পুরুষ ও নারী জোড়া বানানোর ক্ষেত্রে جَعَلَ ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। আল্লাহ তায়ালা একটি দেহকে সৃষ্টি করার পর লিঙ্গ পার্থক্যকরণের মাধ্যমে জোড়া জোড়া বানিয়েছেন। সুতরাং এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সূরা নাবা’র এ আয়াত তথা জোড়া জোড়া অবস্থায় সৃষ্টি করেছেন বলতে উদ্দেশ্য হল, একজন মানুষকে একজোড়া ক্রোমোজম দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, সে পুরুষ হোক অথবা নারী হোক। তাদেরকে পুরুষ ও নারী হিসেবে সৃষ্টি করার পর জোড়া বানিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সাইয়িদ কুতুব-এর উপর রহমত বর্ষণ করুন। তার গভীর দৃষ্টির কারণে সুন্দর একটি বিষয় সুস্পষ্ট হল। আলহামদুল্লিাহ।

আল্লাহ একজন মানুষকে একজোড়া ক্রোমোজম দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ক্রোমোজম সংযোগ ক্ষেত্রে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন ছেলে বানান, আর যাকে ইচ্ছা করেন মেয়ে বানান -তিনি যা চান তাই করতে পারেন।

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আমরা তোমাদেরকে জোড়া জোড়া ক্রোমোজম দিয়ে সৃষ্টি করেছি, যে জোড়া জোড়া ক্রোমোজমে প্রভেদ থাকার কারণে তোমাদের মধ্যে কেউ পুরুষ আর কেউ নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। অথবা, আমরা তোমাদেরকে নারী ও পুরুষ হিসেবে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছি যাতে তোমাদের দ্বারা বংশপরিক্রমা বজায় থাকে।

তাদেরকে সৃষ্টি করার পর তাদের পরিস্থিতির ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। প্রথমে ঘুমের কথা বলেছেন যা মৃত্যুর সাথে সামঞ্জস্য রাখে। এবং এই ঘুম আবার মানুষের আরাম ও ক্লান্তি দূরীকরণের কারণ হয়। তাই আল্লাহ বলেনঃ

وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا (9)

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। نَوْمَكُمْ = তোমাদের ঘুম। سُبَاتًا = বিচ্ছিন্ন, কর্তিত, শান্তি, স্থির, হালকা ঘুম বা তন্দ্রা।

অর্থঃ আর আমরা তোমাদের ঘুমকে প্রশান্তি বানিয়েছি। [আয়াত ৯]

তাৎপর্যঃ

وَجَعَلْنَا : وَ সংযুক্তি বর্ণ। এটা একটি শব্দকে আরেকটি শব্দের সাথে অথবা একটি বাক্যকে আরেকটি বাক্যের সাথে সংযুক্ত করে দেয়। আর আমরা বানিয়েছি …। এখানে আল্লাহ جَعَلْنَا বলেছেন। আর পূর্বের আয়াতে خَلَقْنَا বলেছেন। আমরা সৃষ্টি করেছি এবং আমরা বানিয়েছি -বাহ্য দৃষ্টিতে এক মনে হলেও এর মাঝে পার্থক্য রয়েছে। অনেকেই অনেক পার্থক্য বলেছেন। আমি এখানে একটি পার্থক্য উল্লেখ করছি। আমরা সৃষ্টি করেছি বলতে উদ্দেশ্য হল, একটি বস্তুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনা, যা আমরা আগেই জেনেছি। আর একটি বস্তুকে অস্তিত্বে আনার পর তার মাঝে বা তার জন্য কিছু নিয়মনীতি ও বিধান রচনা করা হয়। আর তা-ই হল جَعْلٌ বা বানানো। এছাড়াও আরো পার্থক্য রয়েছে।

نَوْمَكُمْ : তোমাদের ঘুম -ঘুম হল এমন একটি অবস্থা যখন দেহ কর্মচঞ্চলতা, অনুভূতি, সজাগতা ও রূহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে সে মৃত অবস্থায়ও থাকে না এবং জীবিত অবস্থায়ও থাকে না। উভয়ের মাঝে অবস্থান করে যাতে দিবাভাগের কাজকর্মের গøানী, ক্লান্তি-শ্রান্তি থেকে দেহ মুক্তিলাভ করে এবং পরের দিনের কাজের জন্য দেহ উদ্যমী হয়ে উঠে। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষ জানে না সে জাগ্রত অবস্থায় কেমন থাকে, আবার জাগ্রত অবস্থায় অনুধাবন করতে পারে না সে ঘুমন্ত অবস্থায় কেমন থাকে। এ কাজটি একটি অলৌকিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। এ কাজটি মানবজীবনে এতটাই অত্যবশ্যকীয় যে, যদি কাউকে না ঘুমানোর জন্য বাধ্য করা হয় তাহলে সে নির্ঘাত মারা পড়বে। তাই প্রাত্যহিক কর্মচঞ্চলতা ও ক্লান্তি অনুধাবন থেকে মুক্তিলাভের জন্য ঘুম আমাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এবং এটা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ একটি নেয়ামত। ঘুম জীবের জন্য একটি প্রশান্তি। এটা মানুষের দুশ্চিন্তা দূর করে। মনে শক্তি সঞ্চার করে এবং উদ্যমীভাব আনয়ন করে।(সংক্ষেপিত- ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৪-৪৩৫ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৫-পিডিএফ)

এখানে ‘তোমাদের ঘুম’ বলে অন্যান্য প্রাণীদেরকে ঘুমপ্রক্রিয়া থেকে বের করা হয়নি। তারাও এর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আল্লাহ যেহেতু মানবজাতিকে খেতাব করেছেন যাদের কাছে ওহী প্রেরণ করেছেন তাই তাদেরকে লক্ষ্য করে ‘তোমাদের’ উল্লেখ করেছেন যাতে তারা সজাগ দৃষ্টি সম্পন্ন হয়। এখানে ঘুমের কথা উল্লেখ করার আরেকটি কারণ হল, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, আমরা মৃত্যুসদৃশ থাকি। আমরা জানিনা, পরের দিন জাগ্রত হব কিনা। কিন্তু আমরা যেহেতু অচেতন অবস্থা থেকে চেতনায় ফিরে আসি, জাগ্রত হই, আমাদের এই জাগ্রত হওয়া প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর পর পুনরায় জীবনলাভ অসম্ভব কিছু নয়।

سُبَاتًا : এখানে سُبَاتٌ মানে হালকা ঘুম বা তন্দ্রা অর্থে নেয়া যাবে না। ইমাম রাযী উল্লেখ করেন, কতিপয় নাস্তিক এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, ‘আর আমরা তোমাদের ঘুমকে ঘুম বানিয়েছি’ অর্থ হয়। ঘুমকে কীভাবে ঘুম বানানো হল? তাই এখানে বিচ্ছিন্ন অর্থে আসবে। অর্থাৎ- আমরা তোমাদের ঘুমকে (কর্মচঞ্চলতা থেকে) বিচ্ছিন্ন বানিয়েছি।(তাফসীর রাযী, ৩১/১০।)

তবে আমরা যে অর্থ করেছি, আর আমরা তোমাদের ঘুমকে প্রশান্তি বানিয়েছি, এটা ভাবার্থ যদি দীর্ঘ, লম্বা বা দীর্ঘক্ষণ ব্যাপী গভীর ঘুম উদ্দেশ্য করা হয় তখন সমস্যা নেই। যেমন, سَبَتَتِ الْمَرْأَةُ شَعْرَهَا – মানে মেয়েটি তার চুল ছেড়ে দিল, ফলে তা লম্বা হল, যেমন কেউ যখন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য শয়ন করে তখন সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে। আর এই দীর্ঘ ঘুম হল মৃত্যুসদৃশ। তাই আল্লাহ বলেন, وُهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ بِاللَّيْلِ … ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ – অর্থাৎ- তিনিই যিনি তোমাদেরকে রাত্রিবেলা মৃত্যু দেন (বা ঘুম পাড়িয়ে দেন) … অতঃপর তিনি তোমাদেরকে প্রেরণ করেন বা জাগ্রত করেন। [সূরা আনআম, ৬০]। سُبَاتٌ শব্দটি سَبْتٌ থেকে নির্গত হয়েছে, মানে বিচ্ছিন্ন বা কর্তন। যেমন, سَبَتَ الرَّجُلُ شَعْرَهُ -মানে লোকটি তার চুল কর্তন করল। আর এ কারণে শনিবারকে ইহুদীরা ‘সাবত/ সাবাত দিবস’ (ঝধনধঃয উধু) বলে। আরবিতে বলা হয় يَوْمُ السَّبْتِ। কারণ, ইহুদীরা এ দিনে বিশ্রাম নিত, কর্ম থেকে বিরত থাকত। অথবা ‘সাবত’ বলা হয়, কারণ আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিপ্রক্রিয়া রবিবার দিন শুরু করে শুক্রবার দিন শেষ করেছেন। (আর শনিবার দিন কোনো কর্ম ছিল না)। (তাফসীর কুরতুবী, ১৯/১৭১, তাফসীর তাবারী, ২৪/১৫১। )

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা অতি উপমা হয়েছে। وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا أَيْ كَالسُّبَاتِ، অর্থাৎ- আমরা তোমাদের ঘুমকে বিচ্ছিন্ন সদৃশ বানিয়েছি।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭-৮, রূহুল মাআনী, ইমাম আলুসী, ৩০/৭।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা তোমাদের ঘুমকে কর্মচঞ্চলতা থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে প্রশান্তি বানিয়েছি যাতে তোমরা পরবর্তী দিনের কাজের জন্য উদ্যমী হও, কর্মচঞ্চল হও। অবসাদগ্রস্ত দেহ ক্লান্তি মুক্ত হয়।

وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا (10)

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। اللَّيْلَ = রাতকে। لِبَاسًا = পোশাক, আবরণ, স্থির।

অর্থঃ আর আমরা রাতকে আবরণ বানিয়েছি। [আয়াত ১০]

তাৎপর্যঃ

اللَّيْلَ : রাতকে আল্লাহ অন্ধকার বানিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন,  فَمَحَوْنَا ءَايَةَ اللَّيْلِÑঅর্থাৎ- অতঃপর রাতের নিদর্শনকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছি। [সূরা ইসরা, আয়াত ১২]। রাতের নির্দশনকে নিষ্প্রভ করে দেয়ার মানে হল, আলো অপসারণ করে দিয়েছেন। ফলে, বস্তুগুলো আমাদের চোখে আলো নিক্ষেপ করতে পারে না। এ কারণে আমরা দেখি না। এটা করার কারণ হল যাতে আমরা রাতের বেলা প্রশান্তি লাভ করতে পারি। আলো দেহে চঞ্চলতা সৃষ্টি করে, ফলে পরিপূর্ণ প্রশান্তি লাভে ছেদ পড়ে। রাতের বেলা কক্ষে আলো নিভিয়ে ঘুমালে ঘুম যতটা গভীর হয়, আলো জ্বালিয়ে রাখলে ততটা হয় না। তবে অনেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে।

لِبَاسًا : পোশাক বা পর্দা। আলো অপসরাণ করার ফলে বস্তু ও আমাদের দৃষ্টির মাঝে পর্দা পড়ে যায়। মনে হয় যেন এটা আমাদের চোখের পোশাক। একজন মানুষ পোশাক পরিধান করে ঠাণ্ডা ও গরম থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য, এবং নিজের দেহ ঢেকে রাখার জন্য। তেমনি রাতের অন্ধকার মানুষ ও তার কর্মচঞ্চলতার মাঝে পর্দা ফেলে দেয়। দিন হল কাজের জন্য আর রাত হল বিশ্রামের জন্য। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর আন্দোলন বা কাজকর্মকে প্রাণীকুলের আন্দোলনের অধীন করেছেন। প্রাণীরা কখন কাজকর্ম করতে পারবে -সে অনুযায়ী পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। মানুষের মাঝে যেহেতু কর্মচঞ্চলতার পর আরাম-আয়েশ ও প্রশান্তি লাভকে অপরিহার্য করেছেন, তাই পৃথিবীকে রাতের অন্ধকার চাদর দ্বারা আবৃত করার ব্যবস্থা করেছেন যাতে গভীর নিদ্রা সুখকর হয়।(ফী যিলালিল কুরআন- সাইয়িদ কুতুব, ৭/৪৩৫ (পৃষ্ঠা -৪৪৫৫-পিডিএফ )

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

এখানে تَشْبِيهٌ بَلِيغٌ বা অতি উপমা হয়েছে। মূল বাক্যটি হল, وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِباسًا أَيْ كَاللِّبَاسِ فِي السِّتْرِ অর্থাৎ- আর আমরা রাতকে পর্দার দিক দিয়ে পোশাক সদৃশ বানিয়েছি।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৭-৮)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা রাতকে তোমাদের দৃষ্টির জন্য বস্তুসামগ্রীর সুমুখে পোশাক-পর্দা বানিয়ে দিয়েছি, যাতে তোমরা প্রশান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের নিদ্রা সুখকর হয়।

وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا (11)

শব্দার্থ: وَجَعَلْنَا = আর আমরা বানিয়েছি। النَّهَارَ = দিনকে। مَعَاشًا = জীবন, জীবনধারণ, জীবিকা নির্বাহের উপায়।

অর্থঃ আর আমরা দিনকে বানিয়েছি জীবিকা নির্বাহের উপায়। [আয়াত ১১]

তাৎপর্যঃ

جَعَلْنَا : আমরা বানিয়েছি। অর্থাৎ- আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করার পর এর কিছু বিধি-বিধান দিয়েছেন। একটা কিছু শুরুতে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে خَلْقٌ -এর ক্রিয়া ব্যবহার হয়। আর তা সৃষ্টি করার পর তাতে যে বিধি-বিধান প্রদান করা হয় সেক্ষেত্রে جَعْلٌ -এর ক্রিয়া ব্যবহার হয়।

النَّهَارَ : দিন -ঝলমলে আলোময় সময় যা দেহে কর্মচঞ্চলতা এনে দেয়।

مَعَاشًا : মীম এখানে مَصْدَرٌ مِيمِيٌّ হয়েছে। জীবনযাপন বা জীবিকা নির্বাহ করা। দিনকে আল্লাহ তায়ালা জীবিকা উপার্জনের সময় বানিয়েছেন যাতে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষবাস, শিল্পসহ নানা কাজ করে প্রাত্যহিক পাথেয় অর্জন করতে পারে। কাজ করার জন্য প্রয়োজন আলো, তাই কাজের সময়ের জন্য দিনকে নির্বাচন করেছেন এবং এ দিনকে আলোময় করেছেন। কাজ করার জন্য যেহেতু দেহে শক্তি ও উদ্যম প্রয়োজন তাই দিনের আগে রাতের ব্যবস্থা করেছেন যাতে বিশ্রাম নিয়ে দিনের বেলা পূর্ণশক্তি ব্যয় করতঃ রুজি-রোজগার উপার্জন করতে পারে। উক্ত আয়াতদ্বয়ে রাতের মোকাবেলায় দিন এবং কাজের মোকাবেলায় প্রশান্তিকে উল্লেখ করেছেন। আর এই যে রাতের পর দিন, দিনের পর রাত আসে -এ ব্যবস্থাপনায় আল্লাহ ভারসাম্য বজায় রেখেছেন। যদি এমন না হয়ে রাতের সময় নাতিদীর্ঘ হত, অথবা দিনের সময় নাতিদীর্ঘ হত তাহলে মানবজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ত। কিন্তু যাতে এমনটি না হয় তাই এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা সূ² একটি প্রক্রিয়া অস্তিত্ববান রেখেছেন। তবে শীত ও গ্রীষ্মে আমরা যে দিন ও রাত খর্ব ও লম্ব হওয়ার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করি তা আপেক্ষিক যা আমাদের প্রাত্যহিক কর্মজীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না।  আর রাত ও দিনের  এই  পরিবর্তনের  মধ্যে  রয়েছে                                                       

আল্লাহর নিদর্শন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْنِ فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِتَبْتَغُوا فَضْلا مِنْ رَبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ

অর্থাৎ- আর আমরা আসমান ও জমিনকে দু’টি নিদর্শন বানিয়েছি। অতঃপর রাতের নিদর্শনকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছি, আর দিনের নিদর্শনকে আমরা দৃশ্যমান করে দিয়েছি। যাতে তোমরা তোমাদের রবের অনুকম্পা অনুসন্ধান করতে পারো এবং বছর ও সংখ্যা গণনা করতে পারো।’ [সূরা ইসরা, আয়াত ১২]

শৈল্পিক সৌন্দর্যঃ

وَخَلَقْنَاكُمْ أَزْوَاجًا وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا  – আর আমরা তোমাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, এবং আর আমরা তোমাদের ঘুমকে প্রশান্তি বানিয়েছি -এ দু’টি আয়াতে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মানবজাতিকে খেতাব করা হয়েছে। এটাকে  اَلْاِلْتِفَاتُ إِلَى الْخِطَابِ مِنَ الْغَيْبِ বলা হয়। অর্থাৎ- বর্ণনার ধারা নামপুরুষ থেকে মধ্যমপুরুষে পরিবর্তন করা। আর এটা করা হয় একটা বিষয়কে অত্যাবশ্যকীয়  এবং ধিক্কার জানানোর ক্ষেত্রে আধিক্য বোঝানোর জন্য। এটা তখনই করা হয় যখন বর্ণনার ধারা নাম পুরুষ থেকে মধ্যম পুরুষে অথবা মধ্যম পুরুষ থেকে নাম পুরুষে পরিবর্তন করা হয়। আর এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শুরুতে আল্লাহ মানবজাতিকে নামপুরুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, আর এখানে মধ্যম পুরুষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর এটা করার উদ্দেশ্য হল পাঠকের রূচিতে নাব্যতা আনা ও একঘেয়েমী দূর করা।

উপরোক্ত দু’টি আয়াতে মোকাবেলা হয়েছে। আর উক্ত পাঁচ আয়াতের শেষাব্দের শব্দগুলোতে ছন্দ খচিত হয়েছে। যেমন, أَوْتادًا، أَزْواجًا، سُبَاتًا، لِبَاسًا، مَعَاشًا।(তাফসীর আল-মুনির, ড. ওয়াহবা আল-যুহাইলী, ৩০/৮।)

তাৎপর্যগত অর্থঃ

আর আমরা দিনকে সূর্য স্থাপনের মাধ্যমে আলোময় করেছি যাতে তোমরা জীবিত থাকার জন্য জীবিকা অর্জন করতে পার।

৬ থেকে ১১ নং পর্যন্ত আয়াতের সাধারণ মর্মার্থঃ

আমরা তোমাদের জন্য পৃথিবীকে দোলনা সদৃশ বানিয়েছি যাতে তোমরা এর পৃষ্ঠভাগে নিরাপদে বিচরণ করতে পার। এ ভূমি সৃষ্টি করার পর এটা দোলায়মান ছিল। অতঃপর এর গাত্রে পাহাড়কে পেরেক স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছি যাতে এটা স্থির হয় এবং তোমাদেরকে নিয়ে আন্দোলিত না হয়। তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ করে যাতে তোমরা একে অপরের কাছে প্রশান্তি ও নিরাপত্তা লাভ কর, অথবা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি জোড়া জোড়া বীজকোষ দিয়ে। তোমাদের কায়িক প্রশান্তি ও সুখকর নিদ্রার জন্য ঘুমকে দীর্ঘ করেছি, অথবা ঘুমের মাধ্যমে তোমাদেরকে কর্মের চঞ্চলতা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি। আর আলো অপসরাণের মাধ্যমে রাতকে তোমাদের দৃষ্টির জন্য বস্তুর সুমুখে পোশাক বানিয়েছি যাতে তোমরা না দেখ এবং বিশ্রাম নিতে পার। আর আলোর মাধ্যমে দিনকে বানিয়েছি ঝলমলে যাতে তোমরা কাজকর্ম করে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যমে জীবনচক্র সচল রাখতে সক্ষম হও। এতসব করার পরও তোমরা ঈমান আনবে না?

শিক্ষণীয় বিষয়ঃ

একঃ পৃথিবীকে বাসোপযোগী করার জন্য পাহাড় সংস্থাপনের মাধ্যমে আন্দোলন রহিত করেছেন।

দুইঃ সৃষ্টির নিগূঢ় তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে।

তিনঃ নিরবচ্ছিন্ন ও গভীর ঘুম হওয়ার জন্য অন্ধকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

চারঃ রুজি-রোজগারের জন্য আলোর ব্যবস্থা করেছেন।

Share this:

Leave a Comment