প্রথমঃ বর কনে নির্ধারিত হওয়া এবং তাদের সন্তুষ্টি।
যদি একজন ব্যক্তির কয়েকজন মেয়ে থাকে সে যদি কাউকে বলে আমার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। এখানে তাকে নির্ধারিত করতে হবে কোন মেয়ে। নির্ধারিত না হলে বিয়ে সঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত হল বর কনের উভয়ের রাজি থাকতে হবে। বাবা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না। যেমন হাদিসে আছে, أن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( لا تنكح الأيم حتى تستأمر ولا تنكح البكر حتى تستأذن ) . قالوا يا رسول الله وكيف إذنها ؟ قال ( أن تسكت )- রাসূলুল্লাহ স. বলেন, বিধবাকে বিয়ে দেয়া যাবে না যাবৎ তরা সাথে পরামর্শ করতে হবে, এবং কুমারীকে বিয়ে দেয়া যাবে না যাবৎ তার অনুমতি নিতে হবে। তারা বললেন, হে রাসূলুল্লাহ, তার অনুমতি কীভাবে? তিনি বললেন, যদি চুপ থাকে। [সহিহ বুখারী, ৪৮৪৩]। অর্থাৎ- কুমারী মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে সে যদি লজ্জায় কথা না বলে চুপ থাকে এটাই তার সম্মতি। এ হাদিস প্রমাণ করে, বিধবা ও কুমারী উভয়ের কাছ থেকেই অনুমতি নিতে হবে। তবে অনুমতি নেয়ার ধরন পৃথক। বিধবাকে স্পষ্ট করে বলতে হবে। কারণ, প্রথমবার বিয়ে হওয়ার ফলে এ বিষয়ে তার লজ্জা একটু কম। আর কুমারীর চুপ থাকা হল সম্মতির লক্ষণ। সুতরাং, জোর করে বিয়ে দেয়া যাবে না।
দ্বিতীয়ঃ অভিভাবকের উপস্থিত থাকতে হবে।
অভিভাবকের উপস্থিতি বিশেষ করে প্রয়োজন হল মেয়ের ক্ষেত্রে। ছেলের ক্ষেত্রে ছেলেই নিজের অভিভাবক। হাদিসে আছে, “عن عائشة قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : أيما امرأة نكحت بغير إذن وليها فنكاحها باطل. فنكاحها باطل. فنكاحها باطل” – রাসূলুল্লাহ স. বলেন, যে মেয়ে তার অভিভাবক ব্যতীত নিজে নিজে বিয়ে করবে তাহলে তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল। [সুনান আবু দাউদ, সুনান তিরমিযী, হাদিস নং ১১০২], মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং ২৪২৫১। হাদিসটি সহিহ। আরেক হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, অভিভাবক ব্যতীত বিয়ে নেই বা বিয়ে সঠিক হবে না। [সুনান আবু দাউদ, তিরমিযী, হাদিস নং ১১০১, মুসনাদ আহমদ, হাদিস নং ১৯৫৩৬] হাদিসটি সহিহ।
তবে হানাফি মাযহাবে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে অভিভাবক ব্যতীত নিজে নিজে বিয়ে করতে পারবে। তবে অভিভাবকহীন করাটা অনুচিত। হানাফী মাযহাবের দলীল হল, আল্লাহ বলেন, حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ – যাবৎ সে অন্য স্বামী গ্রহণ করে। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৩০]। আরেক আয়াতে বলেন, فَلا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَا فَعَلْنَ فِي أَنْفُسِهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ – তারা নিজেরা যেসব উত্তম কাজ করে সেসবে তোমাদের কোনো পাপ নেই। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৩৪]
এক মেয়েকে তার বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সে রাসূলুল্লাহ স. এর কাছে এসে নালিশ করে। অতঃপর তিনি তাকে বলেন, فَانْكِحِي مَنْ شِئْتِ – তুমি যাকে চাও বিয়ে কর। [আল-আওসাত লিত- তাবরানী]। আরেকটি দলীল হল, আয়েশা রাদ্বি. তার ভাইয়ের মেয়েকে তার অনুপস্থিতিতে বিয়ে দিয়েছেন।
অভিভাবকের ক্ষেত্রে হকদার হল পর্যায়ক্রমে, বাবা, দাদা, ছেলে, ভাই, সৎ ভাই, অতঃপর নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন।
তৃতীয়ঃ দুইজন সাক্ষী থাকতে হবে।
বিবাহ সহিহ হওয়ার জন্য আকদের সময় দুইজন ন্যায় পরায়ণ পুরুষ ব্যক্তি সাক্ষী থাকতে হবে। আর দুইজন পুরুষ না হলে একজন পুরুষ এবং দুইজন নারী সাক্ষী থাকতে হবে। হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, لا نكاح إلا بولي وشاهدي عدل – অভিভাবক ও দুইজন ন্যায় পরায়ন সাক্ষী ব্যতীত বিবাহ হবে না। [সহিহ ইবনে হিব্বান, ৪০৭৫]। সাক্ষী রাখার বিষয়ে সকল মাযহাব ও জুমহুরগণ একমত হয়েছেন। কারণ, এটা স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের অধিকার সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। সাক্ষী না থাকলে অধিকার সংরক্ষণ হয় না। যেমন কোরআনেও আছে, وَاسْتَشْهِدُوا شَهِيدَيْنِ – তোমরা দুইজন সাক্ষী রাখ। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৮২]। যদি কোনো বিয়েতে সাক্ষী না থাকে তাহলে সে বিয়ে সহিহ হবে না। তা ফাসেদ হবে এবং স্বামী-স্ত্রী ব্যভিচারের গোনাহে লিপ্ত থাকবে।
চতুর্থঃ দেনমোহর দিতে হবে।
বিবাহ সহিহ হওয়ার জন্য মোহর দিতে হবে। এটা কিসের বদলায় তা আমরা জানি তবে এর মধ্যে হেকমত হল, মেয়েকে হাদিয়া দেয়া তাকে খুশি করার জন্য। তবে মেয়ে চাইলে সব মোহর মওকুফ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, وَآتُوا النِّسَاءَ صَدُقَاتِهِنَّ نِحْلَةً فَإِنْ طِبْنَ لَكُمْ عَنْ شَيْءٍ مِنْهُ نَفْسًا فَكُلُوهُ هَنِيئًا مَرِيئًا – তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর দাও খুশি মনে। যদি তারা খুশিমনে তোমাদেরকে তা থেকে দেয় তাহলে তা স্বাচ্ছন্যভাবে খাও। [সূরা নিসা, আয়াত ৪]
হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ স. এক পুরুষ ও এক নারীকে বিয়ে দিলেন। পুরুষটির কিছু ছিল না। তিনি বললেন, التمس ولو خاتما من حديد. فلم يجد فقال ( أمعك من القرآن شيء ) . قال نعم سورة كذا سورة كذا لسور سماها فقال ( زوجناكها بما معك من القرأن – একটি লোহার আংটি হলেও অনুসন্ধান কর। কিন্তু সে তাও পেল না। রাসূলুল্লাহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কোরআন জান? তিনি বললেন, জ্বী, আমি অমুক অমুক সূরা পারি। তখন রাসূলুল্লাহ স. বললেন, তোমাকে তার সাথে কোরআনের বিনিময়ে বিয়ে দিলাম। [সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৪৮৪২] অর্থাৎ- সে তাকে কোরআন শিক্ষা দিবে। এটাই তার মোহর হবে।
এই মোহর হল স্ত্রীর নিরঙ্কুশ অধিকার। এটা তার বাবাও তার অনুমতি ব্যতীত নিতে পারবে না এবং স্বামীও নিতে পারবে না। তবে সে যদি খুশি মনে কাউকে দেয় তাহলে তা খরচ করতে সমস্যা নেই।
পঞ্চমঃ ইজাব ও কবুল বা প্রস্তাব দেয়া এবং গ্রহণ করা।
কনের অভিভাবক বরকে বলবে, আমি অমুককে তোমার কাছে বিয়ে দিলাম। আর বর বলবে, আমি কবুল করলাম। অথবা, বর কনেকে বলবে, আমি তোমাকে বিয়ে করলাম, আর কনে বলবে, আমি কবুল করলাম। একে অপরের প্রতি ইজাব ও কবুল থাকতে হবে। উপস্থাপনায় এদিক-সেদিক হতে পারে। যেমন, অভিভাবক বরকে বলল, অমুকের স্বামী হিসেবে তোমাকে আমি গ্রহণ করলাম। বর বলল, আমি কবুল করলাম।
সারকথাঃ
বিয়ের ক্ষেত্রে যদি এই বিষয়গুলো না থাকে তাহলে বিয়ে সঠিক হবে না। তন্মধ্যে থেকে সাক্ষী রাখা অত্যাবশ্যক। বিবাহের আকদ সঠিক হওয়ার জন্য সাক্ষী শর্ত। এটা ছাড়া বিয়ে হবে না। আর কোরআন ও হাদিস অনুযায়ী প্রমাণিত যে, সাক্ষী রাখতে মানুষকে। সাক্ষী রাখার উদ্দেশ্য হল, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ঠিক রাখা এবং বিবাহকে প্রচার করা বা ঘোষণা করা। আল্লাহ এমনিতেই সাক্ষী আছেন। আল্লাহকে সাক্ষী রাখার প্রয়োজন নেই এবং আল্লাহ তায়ালা কোথাও বলেননি তাকে সাক্ষী রাখতে, এবং রাসূলুল্লাহও বলেননি আল্লাহকে সাক্ষী রাখতে। তারা বলেছেন জনগণকে সাক্ষী রাখতে। আর আল্লাহকে সাক্ষী রাখলে আল্লাহ জনগণের মাঝে প্রচার করবেন না যে অমুকে অমুকে বিয়ে করেছে, অথচ সাক্ষীর আরেকটি বিষয় হল প্রচার করা। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বিবাহ করা শয়তানের প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং, সাক্ষী ব্যতীত বিবাহের আকদ সঠিক হবে না, তা ফাসেদ হবে। ফলে, এভাবে সাক্ষী ব্যতীত বিয়ে করলে উভয়ে ব্যভিচারের গোনাহে লিপ্ত হবে।
আর খুতবা পড়া বিবাহ সঠিক হওয়ার জন্য শর্ত নয়। তা সুন্নত।